স্বামীর মৃত্যু ও বিধবার ভবিষ্যৎ by মোঃ জাহিদ হোসেন
প্রমি (ছদ্ম নাম) চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে আনার্স শেষ বর্ষ পরীক্ষা দিয়েছে। তার পরিবারে রয়েছেন মা-বাবা ও তার ছোট দুই বোন। এই নিয়ে তাদের ছোট্ট ও টানাটানির পরিবার।
প্রমির বাবা একটি সরকারী চাকুরী করতেন। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে দুই বছর আগে তাঁর চাকরী চলে যায়। এর পর অফিস থেকে পাওয়া কিছু টাকা ও সামান্য জমানো টাকা দিয়ে সাধারণ একটা মুদির দোকান দিয়ে সংসার চালিয়ে যান। এভাবেই চলছিল...।
অপর দিকে প্রমি ও তার ছোট দুই বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। “একেতো টানাটানির সংসার তার ওপর কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা”- এসব কথা চিন্তা করে প্রমির বাবা দ্রুত প্রমির বিয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে হাসান (ছদ্ম নাম) নামের এক ব্যবসায়ী সাথে প্রমির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কোন রকম জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়ই প্রমি ও হাসানের বিয়ে হয়।
বিয়েতে মোহরানা ঠিক হয় পাঁচ লক্ষ টাকা। কাবিননামায় কোন রুপ উছুলের কথা উল্লেখ ছিল না।
বিয়ের পর সব ঠিকমতই চলছিল। প্রমি তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকত। এরিমধ্যে প্রমির ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
কন্যা সন্তানের বয়স যখন প্রায় এক বছর আট মাসের মত তখন হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রমির স্বামী হাসান মারা যায়। এতে প্রমি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
মারা যাওয়ার সময় হাসানের নিজের নামের ঐ ফ্ল্যাট ও ব্যাংকে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা জমা ছিল। এর বেশ কিছু দিন সময় ধরে প্রমি হাসানের ফ্ল্যাটে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থেকে যায়।
কিন্তু হাসানের পরিবার কন্যা সন্তানটিকে তাদের নিজের কাছে রেখে দিয়ে প্রমিকে বাবার বাড়ীতে একেবারে চলে যাওয়ার জন্য ও কোন সম্পর্ক না রাখার জন্য বলে দেয়।
অপরদিকে প্রমি তার বাচ্চা মেয়েকে না নিয়ে বাবার বাড়ীতে যেতে রাজী হয় না। তাছাড়া প্রমি তার বিয়ের সময় যে মোহরানা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার কিছুই সে পায়নি।
উচ্চ শিক্ষিত হয়েও প্রমি নিজের মেয়ে ও নিকট ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চোখে- মুখে অন্ধকার দেখতে লাগল। এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে প্রমি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পূর্ব পরিচিত আইন বিভাগের এক বান্ধবী আয়েশা সিদ্দিকার (ছদ্ম নাম) কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য আসে এবং তার পূর্বের ও বর্তমান দুরাবস্থার কথা খুলে বলে।
আয়েশা এই ক্ষেত্রে তাকে তার অধিকার ও ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেন।
তিনি বলেন হাসানের পরিবার জোর করে তার নাবালক মেয়েকে তাদের কাছে রেখে দিতে পারে না। কারণ মুসলিম আইনে স্বাভাবিকভাবে কন্যা সন্তানের বয়স প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের মা-ই তার তত্ত্বাবধানের অধিকারী। সেই মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে না করে তবেই তাঁর এই অধিকার অব্যাহত থাকবে। আর বাবা বেঁচে থাকলে তিনিই সন্তানের একমাত্র স্বাভাবিক অভিভাবক।
মোহরানা সম্পর্কে বলেন প্রমিকে তার মোহরানা পরিশোধ না করে হাসানের পরিবার তাকে তার বাবার বাড়ীতে একেবারে চলে যাওয়ার জন্য বা সম্পর্ক না রাখতে বাধ্য করতে পারে না।
কারণ স্ত্রী যত দিন না পর্যন্ত তার মোহরানা আদায় করতে পারবে ততদিন পর্যন্ত সে শক্তি প্রয়োগ না করে আইন সম্মত উপায়ে স্বামীর সম্পত্তি দখলে রাখতে পারবে।
মৃত স্বামীর অবর্তমানে তিনি স্বামীর সম্পত্তি হতে অথবা যারা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে তাদের কাছ থেকে নিজ নিজ অংশ অনুসারে মোহরানা সম্পূর্ণ আদায় করতে পারবেন।
তবে উত্তরাধিকারীরা তার দেনমোহর ঋণের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী নয়।
আবার স্ত্রীকে যদি অন্যায়ভাবে মৃত স্বামীর সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয় তাহলে সে পুনর্দখলের জন্য স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছয় মাসের মধ্যে এবং অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে তিন বছরের মধ্যে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারবে।
তিনি বলেন মোহরানা হল স্ত্রীর কাছে স্বামীর একটি ঋণ। মোহরানা একজন স্ত্রীকে সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াও আর্থিক নিরাপত্তা দেয়।
প্রমি তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কে আয়েশার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিধবা স্ত্রী কোন অবস্থাতেই তার স্বামীর সম্পত্তি হতে বঞ্ছিত হয় না।
তাই যারা যারা তার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাদের মধ্যে সেও একজন অংশীদার। সেও স্বামীর রেখে যাওয়া মোট সম্পত্তি অর্থাৎ ফ্ল্যাট ও ব্যাংকে জমানো টাকা হতে ভাগ পেতে পারে।
কারণ মৃত স্বামীর কোন সন্তান থাকলে বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ(১/৮) পায়। আর যদি মৃত স্বামীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ(১/৪) পায়। তবে ঐ সম্পত্তি থেকে যদি মোহরানা আদায় করে নেন তাহলে মোহরানার টাকা বাদ দিতে হবে। আর বাকী সম্পত্তি আইন অনুযায়ী সে পাবে।
এছাড়াও প্রমি বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর ভরণপোষণের অধিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে আয়েশা তাকে বলেন, তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্ত্রী ইদ্দদকালে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হয়। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মৃত্যুর পর ইদ্দতকালে বিধবা ভরণ-পোষণ পাবার অধিকারী হবে না।
প্রমি সব কিছু বুঝার পর এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং তার বান্ধবী আয়েশাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল।
লেখকঃ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও মানবাধিকার কর্মী
বিয়েতে মোহরানা ঠিক হয় পাঁচ লক্ষ টাকা। কাবিননামায় কোন রুপ উছুলের কথা উল্লেখ ছিল না।
বিয়ের পর সব ঠিকমতই চলছিল। প্রমি তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকত। এরিমধ্যে প্রমির ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
কন্যা সন্তানের বয়স যখন প্রায় এক বছর আট মাসের মত তখন হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রমির স্বামী হাসান মারা যায়। এতে প্রমি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
মারা যাওয়ার সময় হাসানের নিজের নামের ঐ ফ্ল্যাট ও ব্যাংকে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা জমা ছিল। এর বেশ কিছু দিন সময় ধরে প্রমি হাসানের ফ্ল্যাটে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থেকে যায়।
কিন্তু হাসানের পরিবার কন্যা সন্তানটিকে তাদের নিজের কাছে রেখে দিয়ে প্রমিকে বাবার বাড়ীতে একেবারে চলে যাওয়ার জন্য ও কোন সম্পর্ক না রাখার জন্য বলে দেয়।
অপরদিকে প্রমি তার বাচ্চা মেয়েকে না নিয়ে বাবার বাড়ীতে যেতে রাজী হয় না। তাছাড়া প্রমি তার বিয়ের সময় যে মোহরানা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার কিছুই সে পায়নি।
উচ্চ শিক্ষিত হয়েও প্রমি নিজের মেয়ে ও নিকট ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চোখে- মুখে অন্ধকার দেখতে লাগল। এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে প্রমি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পূর্ব পরিচিত আইন বিভাগের এক বান্ধবী আয়েশা সিদ্দিকার (ছদ্ম নাম) কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য আসে এবং তার পূর্বের ও বর্তমান দুরাবস্থার কথা খুলে বলে।
আয়েশা এই ক্ষেত্রে তাকে তার অধিকার ও ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেন।
তিনি বলেন হাসানের পরিবার জোর করে তার নাবালক মেয়েকে তাদের কাছে রেখে দিতে পারে না। কারণ মুসলিম আইনে স্বাভাবিকভাবে কন্যা সন্তানের বয়স প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের মা-ই তার তত্ত্বাবধানের অধিকারী। সেই মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে না করে তবেই তাঁর এই অধিকার অব্যাহত থাকবে। আর বাবা বেঁচে থাকলে তিনিই সন্তানের একমাত্র স্বাভাবিক অভিভাবক।
মোহরানা সম্পর্কে বলেন প্রমিকে তার মোহরানা পরিশোধ না করে হাসানের পরিবার তাকে তার বাবার বাড়ীতে একেবারে চলে যাওয়ার জন্য বা সম্পর্ক না রাখতে বাধ্য করতে পারে না।
কারণ স্ত্রী যত দিন না পর্যন্ত তার মোহরানা আদায় করতে পারবে ততদিন পর্যন্ত সে শক্তি প্রয়োগ না করে আইন সম্মত উপায়ে স্বামীর সম্পত্তি দখলে রাখতে পারবে।
মৃত স্বামীর অবর্তমানে তিনি স্বামীর সম্পত্তি হতে অথবা যারা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে তাদের কাছ থেকে নিজ নিজ অংশ অনুসারে মোহরানা সম্পূর্ণ আদায় করতে পারবেন।
তবে উত্তরাধিকারীরা তার দেনমোহর ঋণের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী নয়।
আবার স্ত্রীকে যদি অন্যায়ভাবে মৃত স্বামীর সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয় তাহলে সে পুনর্দখলের জন্য স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছয় মাসের মধ্যে এবং অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে তিন বছরের মধ্যে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারবে।
তিনি বলেন মোহরানা হল স্ত্রীর কাছে স্বামীর একটি ঋণ। মোহরানা একজন স্ত্রীকে সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াও আর্থিক নিরাপত্তা দেয়।
প্রমি তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কে আয়েশার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিধবা স্ত্রী কোন অবস্থাতেই তার স্বামীর সম্পত্তি হতে বঞ্ছিত হয় না।
তাই যারা যারা তার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাদের মধ্যে সেও একজন অংশীদার। সেও স্বামীর রেখে যাওয়া মোট সম্পত্তি অর্থাৎ ফ্ল্যাট ও ব্যাংকে জমানো টাকা হতে ভাগ পেতে পারে।
কারণ মৃত স্বামীর কোন সন্তান থাকলে বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ(১/৮) পায়। আর যদি মৃত স্বামীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে বিধবা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ(১/৪) পায়। তবে ঐ সম্পত্তি থেকে যদি মোহরানা আদায় করে নেন তাহলে মোহরানার টাকা বাদ দিতে হবে। আর বাকী সম্পত্তি আইন অনুযায়ী সে পাবে।
এছাড়াও প্রমি বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর ভরণপোষণের অধিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে আয়েশা তাকে বলেন, তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে স্ত্রী ইদ্দদকালে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হয়। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মৃত্যুর পর ইদ্দতকালে বিধবা ভরণ-পোষণ পাবার অধিকারী হবে না।
প্রমি সব কিছু বুঝার পর এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং তার বান্ধবী আয়েশাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল।
লেখকঃ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও মানবাধিকার কর্মী
No comments