উড়তে চাই, পড়তে চাই by তৌহিদা শিরোপা
মেয়েরা বিদেশে যাবে উচ্চশিক্ষা নিতে।অচেনা দেশ, অচেনা পরিবেশ; অভিভাবকদের তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব—এই অবস্থা থেকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। তবে এখনো স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার জন্য মেয়েরা যখন বিদেশে যেতে চান, তখন অভিভাবকের মন পুরো সায় দেয় না।
হয়তো ভাবেন—মেয়েটা বিদেশ যাক, তবে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে যাক...
মেয়েরা যাবে বিদেশে পড়তে? একটা সময় এ কোথা শুনলে গুরুজনদের চোখ কপালে উঠত। এখনো পুরোপুরি এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তবে অনেক অভিভাবক এখন ছেলেমেয়েতে ভেদাভেদ করেন না। দেখা যায়, এ লেভেল বা ও লেভেল পাস করার পর আগ্রহ নিয়েই মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠাচ্ছেন মা-বাবা। কিন্তু আপত্তি ওঠে স্নাতকোত্তর পাস করা মেয়েটির বেলায়। অনেক সময় মা-বাবা নিরাপত্তাহীনতাবোধ থেকে মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বিয়ের বয়স, মেয়েটা কবে না কবে ফেরে, কে আবার কী বলে...আপত্তি তোলেন। শেষে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিলেও শর্ত জুড়ে দেন। একা পড়তে যাওয়া যাবে না। যেতে হলে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে যেতে হবে কিংবা প্রবাসী কোনো ছেলেকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন।
নুসাইবার কথাই ধরা যাক। বছর খানেক হলো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ফলাফলও ভালো। স্নাতক শেষ করার পর ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে পড়ার। মা-বাবা রাজি হননি। বেশ কিছুদিন মন খারাপ থাকলেও এটা ভেবে সান্ত্বনা পান নুসাইবা যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন। সব ভুলে আবার পড়ালেখায় মন দিলেন। এবার যে মা-বাবাকে রাজি করাতেই হবে। কিন্তু বিধি বাম। ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও যেতে পারলেন না বিদেশে। নুসাইবা বলেন, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাব, কত স্বপ্ন ছিল আমার। প্রবাসী কোনো ছেলেকে বিয়ে করে এই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই না। ওয়েবসাইট ঘেঁটে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। সেখানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ পড়ার সুযোগও মিলল। কিন্তু বাসায় কেউ রাজি নয়। একা যেতে দেবেন না মা-বাবা। বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। যিনি নিজেও বিদেশে থাকেন বা পড়তে যাবেন। এখন পাত্র পাওয়ার ওপর আমার উচ্চশিক্ষা নির্ভর করছে। মা-বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।’
অন্যদিকে শবনমের (ছদ্মনাম) একা উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবার কোনো সুযোগই দেননি মা-বাবা। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞানে দুর্দান্ত ভালো ফলাফল করা মেয়েকে কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। তাই মেয়ের অনার্স শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে থাকেন। পেয়েও গেলেন। পাত্র পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে মেয়েকেও সেখানেই যেতে হবে। শবনমের যুক্তরাষ্ট্রের নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার কষ্ট কাউকে বলতেও পারছেন না। স্বামী ছাড়া কেন একটা মেয়ের ওপর মা-বাবা নির্ভর করতে পারেন না, এটি তাঁকে এখন ভীষণ ভাবাচ্ছে। খানিকটা হতাশার সুরে শবনম বলেন, ‘সামনের মাসেই চলে যাব যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে স্বামীর পছন্দের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস করতে হবে। নিজের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে।
এটি খুব কষ্টের। আমি চাই, উচ্চশিক্ষার পর দেশে ফিরতে কিন্তু স্বামীর তাতেও আপত্তি। দেখা যাক, ভবিষ্যতের দিনগুলো কেমন কাটে?’
তবে সবার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে তা নয়। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে সচেতন মা-বাবাও আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের সুমনা আহমেদ কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর বাবা সরকারি কর্মকর্তা মোবাশ্বের আহমেদ বেশি আগ্রহী ছিলেন মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর জন্য। ‘মেয়ে বিদেশে পড়ে—এটা সব মা-বাবার জন্য গর্বের। তাঁর ইচ্ছা দেখে আমরাও সমানভাবে উৎসাহ দিয়েছি। তবে মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলেও খুঁজেছি। পছন্দসই কাউকে পাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একা যাওয়ায় ভালো হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। পৃথিবীটাকে একা চেনার সুযোগ পাচ্ছে, যা ভীষণ প্রয়োজন।’
মাহ্রুখ মহিউদ্দীন দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডে কর্মরত। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘বাবা-মাকে ভাবতে হবে, মেয়েটিকে বিয়ে না দিয়ে বিদেশে যেতে দিচ্ছি না, এতে হয়তো তার আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পথ আগলে ধরা হচ্ছে। তা ছাড়া বিদেশযাত্রা মানে নতুন একটি জীবনের দিকে যাত্রা করা। সে সময় বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়। মা-বাবা যদি মেয়ের ওপর আরেকটু ভরসা ও বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাঁদের সন্তানের মূল্যবোধের শিকড়টি যথেষ্ট মজবুত করে আগেই তৈরি করে দিতে পারেন, তা হলে মেধাবী মেয়েটিকে একা একা বিদেশে পাঠানো নিয়ে তাঁরা একটুও চিন্তিত হবেন না! আর আশপাশে খোঁজ নিলেই তাঁরা দেখবেন, আমাদের মেয়েরা একটু সুযোগ পেলেই সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারে, গর্বিত করতে পারে তাদের পরিবার আর দেশকে।’
সামর্থ্য-সুযোগ থাকলে ছেলেরা চাইলে যেকোনো সময় বিদেশে যেতে পারে। তাতে পরিবারের কোনো বাধা থাকে না। এমনকি বিয়ের পরদিনও ছেলে চাইলে বিদেশে যেতে পারে, যা অনেক মেয়ের কাছে কল্পনাতীত। পরিবার থেকে ছেলেমেয়ের বেলায় সমান সমর্থন আসে না। বরং মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মা-বাবারা সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা বিয়ে নামক মাধ্যমকে বেছে নেন। তাঁরাও অচেনা দেশে মেয়ে কতটা নিরাপদে থাকবে সেটা যেমন ভাবেন, ভাবেন বিয়ের সময় এ নিয়ে কথা হবে কিংবা বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে। তাই স্বামীসহ বিদেশে গেলে চিন্তামুক্ত থাকেন। কিন্তু বিয়ে একটি মেয়ের নিরাপত্তার একমাত্র মাধ্যম হতে পারে না। বরং মেয়েরা বিদেশে পড়তে গেলে জগৎটাকে চিনতে পারে, জানতে পারে। উচ্চশিক্ষা একজন মানুষের জীবনে বড় প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ইংরেজি ভাষা বিভাগের প্রভাষক কামরুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগ এখন। মা-বাবাকে আগের চেয়ে উদার হতে হবে। বিদেশে পড়তে গেলে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ে তা নয়, পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসে। চিন্তা-ভাবনায় প্রখরতা আসে। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধন হয়। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়। এটি একজন মানুষের চলার পথে ভীষণ দরকার। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে, বিদেশে পড়তে গেলে মেয়ে যত শিক্ষিত হবে, তত তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নত হবে।’
নারীর উচ্চশিক্ষা সমাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটা সমাজপতিদের বুঝতে হবে। অনেক সময় পরিবার চাইলেও সমাজের নানা অসংগতির কথা ভেবে তাঁরা বাধা দেন। ফলে সমাজকে আগে এর জন্য প্রস্তুত করতে হবে। মেয়েরা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এলে তা দেশ-সমাজ, সবার জন্যই কল্যাণকর হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও আমাদের দেশের পরিবেশ এখনো পুরোপুরি নারীবান্ধব হয়নি। মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারেন না অনেক মা-বাবা। কিন্তু সন্তানকে অবিশ্বাস করলে ফলাফল হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্বাস করলে সে প্রতিদানে ভালো কিছুই দেয়।’
একজন অভিভাবক এগিয়ে এলে, মেয়েকে সমর্থন দিলে তাঁকে অনুসরণ করে আরও অভিভাবক এগিয়ে আসবেন—এমনটাই প্রত্যাশা সমাজবিজ্ঞানীর।
মেয়েরা যাবে বিদেশে পড়তে? একটা সময় এ কোথা শুনলে গুরুজনদের চোখ কপালে উঠত। এখনো পুরোপুরি এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তবে অনেক অভিভাবক এখন ছেলেমেয়েতে ভেদাভেদ করেন না। দেখা যায়, এ লেভেল বা ও লেভেল পাস করার পর আগ্রহ নিয়েই মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠাচ্ছেন মা-বাবা। কিন্তু আপত্তি ওঠে স্নাতকোত্তর পাস করা মেয়েটির বেলায়। অনেক সময় মা-বাবা নিরাপত্তাহীনতাবোধ থেকে মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বিয়ের বয়স, মেয়েটা কবে না কবে ফেরে, কে আবার কী বলে...আপত্তি তোলেন। শেষে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিলেও শর্ত জুড়ে দেন। একা পড়তে যাওয়া যাবে না। যেতে হলে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে যেতে হবে কিংবা প্রবাসী কোনো ছেলেকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন।
নুসাইবার কথাই ধরা যাক। বছর খানেক হলো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ফলাফলও ভালো। স্নাতক শেষ করার পর ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে পড়ার। মা-বাবা রাজি হননি। বেশ কিছুদিন মন খারাপ থাকলেও এটা ভেবে সান্ত্বনা পান নুসাইবা যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন। সব ভুলে আবার পড়ালেখায় মন দিলেন। এবার যে মা-বাবাকে রাজি করাতেই হবে। কিন্তু বিধি বাম। ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও যেতে পারলেন না বিদেশে। নুসাইবা বলেন, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাব, কত স্বপ্ন ছিল আমার। প্রবাসী কোনো ছেলেকে বিয়ে করে এই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই না। ওয়েবসাইট ঘেঁটে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। সেখানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ পড়ার সুযোগও মিলল। কিন্তু বাসায় কেউ রাজি নয়। একা যেতে দেবেন না মা-বাবা। বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। যিনি নিজেও বিদেশে থাকেন বা পড়তে যাবেন। এখন পাত্র পাওয়ার ওপর আমার উচ্চশিক্ষা নির্ভর করছে। মা-বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।’
অন্যদিকে শবনমের (ছদ্মনাম) একা উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবার কোনো সুযোগই দেননি মা-বাবা। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞানে দুর্দান্ত ভালো ফলাফল করা মেয়েকে কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। তাই মেয়ের অনার্স শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে থাকেন। পেয়েও গেলেন। পাত্র পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে মেয়েকেও সেখানেই যেতে হবে। শবনমের যুক্তরাষ্ট্রের নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার কষ্ট কাউকে বলতেও পারছেন না। স্বামী ছাড়া কেন একটা মেয়ের ওপর মা-বাবা নির্ভর করতে পারেন না, এটি তাঁকে এখন ভীষণ ভাবাচ্ছে। খানিকটা হতাশার সুরে শবনম বলেন, ‘সামনের মাসেই চলে যাব যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে স্বামীর পছন্দের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস করতে হবে। নিজের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে।
এটি খুব কষ্টের। আমি চাই, উচ্চশিক্ষার পর দেশে ফিরতে কিন্তু স্বামীর তাতেও আপত্তি। দেখা যাক, ভবিষ্যতের দিনগুলো কেমন কাটে?’
তবে সবার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে তা নয়। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে সচেতন মা-বাবাও আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের সুমনা আহমেদ কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর বাবা সরকারি কর্মকর্তা মোবাশ্বের আহমেদ বেশি আগ্রহী ছিলেন মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর জন্য। ‘মেয়ে বিদেশে পড়ে—এটা সব মা-বাবার জন্য গর্বের। তাঁর ইচ্ছা দেখে আমরাও সমানভাবে উৎসাহ দিয়েছি। তবে মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলেও খুঁজেছি। পছন্দসই কাউকে পাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একা যাওয়ায় ভালো হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। পৃথিবীটাকে একা চেনার সুযোগ পাচ্ছে, যা ভীষণ প্রয়োজন।’
মাহ্রুখ মহিউদ্দীন দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডে কর্মরত। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘বাবা-মাকে ভাবতে হবে, মেয়েটিকে বিয়ে না দিয়ে বিদেশে যেতে দিচ্ছি না, এতে হয়তো তার আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পথ আগলে ধরা হচ্ছে। তা ছাড়া বিদেশযাত্রা মানে নতুন একটি জীবনের দিকে যাত্রা করা। সে সময় বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়। মা-বাবা যদি মেয়ের ওপর আরেকটু ভরসা ও বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাঁদের সন্তানের মূল্যবোধের শিকড়টি যথেষ্ট মজবুত করে আগেই তৈরি করে দিতে পারেন, তা হলে মেধাবী মেয়েটিকে একা একা বিদেশে পাঠানো নিয়ে তাঁরা একটুও চিন্তিত হবেন না! আর আশপাশে খোঁজ নিলেই তাঁরা দেখবেন, আমাদের মেয়েরা একটু সুযোগ পেলেই সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারে, গর্বিত করতে পারে তাদের পরিবার আর দেশকে।’
সামর্থ্য-সুযোগ থাকলে ছেলেরা চাইলে যেকোনো সময় বিদেশে যেতে পারে। তাতে পরিবারের কোনো বাধা থাকে না। এমনকি বিয়ের পরদিনও ছেলে চাইলে বিদেশে যেতে পারে, যা অনেক মেয়ের কাছে কল্পনাতীত। পরিবার থেকে ছেলেমেয়ের বেলায় সমান সমর্থন আসে না। বরং মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মা-বাবারা সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা বিয়ে নামক মাধ্যমকে বেছে নেন। তাঁরাও অচেনা দেশে মেয়ে কতটা নিরাপদে থাকবে সেটা যেমন ভাবেন, ভাবেন বিয়ের সময় এ নিয়ে কথা হবে কিংবা বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে। তাই স্বামীসহ বিদেশে গেলে চিন্তামুক্ত থাকেন। কিন্তু বিয়ে একটি মেয়ের নিরাপত্তার একমাত্র মাধ্যম হতে পারে না। বরং মেয়েরা বিদেশে পড়তে গেলে জগৎটাকে চিনতে পারে, জানতে পারে। উচ্চশিক্ষা একজন মানুষের জীবনে বড় প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ইংরেজি ভাষা বিভাগের প্রভাষক কামরুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগ এখন। মা-বাবাকে আগের চেয়ে উদার হতে হবে। বিদেশে পড়তে গেলে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ে তা নয়, পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসে। চিন্তা-ভাবনায় প্রখরতা আসে। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধন হয়। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়। এটি একজন মানুষের চলার পথে ভীষণ দরকার। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে, বিদেশে পড়তে গেলে মেয়ে যত শিক্ষিত হবে, তত তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নত হবে।’
নারীর উচ্চশিক্ষা সমাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটা সমাজপতিদের বুঝতে হবে। অনেক সময় পরিবার চাইলেও সমাজের নানা অসংগতির কথা ভেবে তাঁরা বাধা দেন। ফলে সমাজকে আগে এর জন্য প্রস্তুত করতে হবে। মেয়েরা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এলে তা দেশ-সমাজ, সবার জন্যই কল্যাণকর হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও আমাদের দেশের পরিবেশ এখনো পুরোপুরি নারীবান্ধব হয়নি। মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারেন না অনেক মা-বাবা। কিন্তু সন্তানকে অবিশ্বাস করলে ফলাফল হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্বাস করলে সে প্রতিদানে ভালো কিছুই দেয়।’
একজন অভিভাবক এগিয়ে এলে, মেয়েকে সমর্থন দিলে তাঁকে অনুসরণ করে আরও অভিভাবক এগিয়ে আসবেন—এমনটাই প্রত্যাশা সমাজবিজ্ঞানীর।
No comments