‘কথা রেখে’ চলে গেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় by পরিতোষ পাল
চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গতরাত দুইটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এ লেখক। তার এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সোমবার রাত ২টা ৫ মিনিটে দক্ষিণ কলকাতার পারিজাত আবাসনের আটতলার নিজের ফ্ল্যাটে তার জীবনাবসান হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স গয়েছিল ৭৯ বছর। মঙ্গলবার সকালে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতের বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্বরা ছুটে যান তার বাড়িতে। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার অগনিত গুণমুগ্ধ পাঠকেরাও ছুটে এসেছিলেন। তবে সকালের মধ্যেই তার মরদেহ পিস হেভেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার শীতল কফিনে আপাতত তিনি শান্তিতে কাটাবেন ২৪ ঘন্টা। তার একমাত্র পুত্র আমেরিকার বোস্টন থেকে ফিরে এলেই বুধবার তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে তার একনিষ্ট পাঠক ও ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় একান্তভাবে মর্মাহত হয়েছেন। তিনি এক শোকবার্তায় জানিয়েছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার চলে যাওয়া আসলে সাহিত্য জগতে একটি উজ্জ্বল তারকার পতন। এই শূণ্যস্থান সহজে পূরণ হবার নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন গল্প উপন্যাসও।
তবে কবিতা ছিল সুনীলের নিজের প্রথম ভালবাসা। প্রখ্যাত কবি অ্যালেনস গিনসবার্গ ছিলেন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। নিজের আসল নামের পাশাপাশি তিনি নীল লোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপাধ্যায় নামেও অনেক লেখা লিখেছেন। তবে তার লেখনীর স্পর্শ পড়েনি বাংলা সাহিত্যের এমন শাখা খুব কমই আছে। তার নিজের জীবন নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ আত্মজৈবনিক উপন্যাস ’অর্ধেক জীবন’। আবার লালন ফকিরকে নিয়ে লিখেছেন অসাধারন উপন্যাস ’মনের মানুষ’। অসাধারণ মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন সুনীল। তিনি তরুন কবি ও লেখকদের কখনও প্রত্যাখ্যান করতেন না। তার কাছে তাই তরুণ লেখকদের জন্য দ্বার ছিল অবারিত। জীবনে অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু তিনি বলতেন, দু হাত খুলে লিখে যাও। সময় বিচার করবে কোন লেখাটি থাকবে আর কোন লেখাটি হারিয়ে যাবে। তিনি নিজেও তাই সব্যসাচীর মত কলম চালিয়েছেন। অসাধারণ সব চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষ সুনীল ছিলেন অনন্য মনের অধিকারী । সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন। বাংলাদেশে সুনীলের জন্ম। তাই বাংলাদেশের প্রতিও তার ভালবাসা ছিল অফুরাণ। তিনি কতবার যে বাংলাদেশে গিয়েছেন তা সংখ্যায় গুনে বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বহু কবি তার সান্নিধ্য পেয়েছেন তার কাছে থেকেছেন। অনেকের কবিতার বই কলকাতায় প্রকাশের ব্যাপারে অকৃপণভাবে সাহায্য করেছেন। বাংলাদেশের ফরিদপুরে সুনীলের জন্ম। ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন পিতার চাকুরির সুত্রে। তার পিতা তখন কলকাতার টাউন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। উত্তর কলকাতাতেই সুনীলের বড় হয়ে ওঠা তবে মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় বোমার ভয়ে অনেকে যেমন পালিয়েছিলেন তেমনি সুনীলও পিতার সঙ্গে ফরিদপুরে ফিরে এসেছিলেন টানা এক বছর। পরে দেশভাগের সময় তিনি পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। ছোটবেলা থেকেই সুনীলের সাহিত্য র্চ্চার শুরু। মাত্র ১৫ বছর বয়সে দেশ পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছিল। এই কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানান, সেই সময় তিনি দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগটি স¤পাদনা করতেন। একদিন কবিতার ফাইল ঘাটতে ঘাটতে সুনীলের একটি কবিতা পান। সেটি পড়ে তার এত ভাল লেগেছিল যে, তিনি সেটি ছেপে দেন। এমনকি পোস্টকার্ডে চিঠি লিখে নীরেন্দ্রনাথ কবিকে ডেকে পাটিয়ে প্রশংসা করেছিলেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আরও বলেন, সুনীলের গল্পও প্রথম আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কিনা বলতে পারবো না। তবে এই বালক বয়সেই সুনীলের একটি গল্প আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ছাপা হয়েছিল। নীরেন্দ্রনাথ তখন রবিাসরীয়ও সম্পাদনা করতেন। তিনি গল্পটি পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে সেই গল্পের নাম আজও তিনি মনে রেখেছেন। গল্পটির নাম ছিল ’চশমা’। আসাধারণ রূপক গল্প ছিল সেটি। কলেজে পড়তে পড়তেই সুনীল তার বন্ধু দীপক মজুমদার ও সেই সময়ের পরিচিত কবি আনন্দ বাগচীর সঙ্গে মিলিতভাবে ’কৃত্তিবাস’ নামে একটি কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করেন। করুণ কবিদের এই মুখপত্রটি একটি কবিতা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। তার পর থেকে লেখনী চালিয়ে গেছেন অবিশ্রান্তভাবে। ১৯৫৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা ও কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ সালে ‘আত্মপ্রকাশ’ নামে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সুনীল প্রথম যুগে বাংলার প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তার প্রেমের উপন্যাসগুলি জন্য। তার নিখিলেশ ও নীরা সিরিজের কবিতাগুলিও তরুণদেও মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার পর তিনি নানা ধরণের লেখা লিখেছেন। তার রহস্য গল্প-উপন্যাসের নায়ক কাকাবাবু ছোটদের পাশাপাশি বড়দের কাছেও বিশেষ জনপ্রিয়। সুনীল আড়াইশ’র বেশি বই লিখেছেন। আর পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্য। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে আনন্দ পুরস্কার (১৯৭২), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কার (২০১১) ও সারস্বত সম্মান (২০০৪) পেয়েছেন এই গুনী লেখক। তিনি ২০০২ সালে কলকাতার শেরিফ পদও অলঙ্কৃত করেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি স্বাতী বন্দোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। তার একমাত্র সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
No comments