ভাষা হারাল লেখক দেশ হারাল বন্ধু by নওশাদ জামিল

শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন যেন হরিহর আত্মা। গভীর হৃদ্যতা ছিল দুজনের। সুনীল তাঁর লেখায় বহুবার তুলে এনেছেন শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তি। লিখেছেন তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ নানা স্মৃতির কথা।


শামসুর রাহমানও লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে। দুজন দুই দেশের বাসিন্দা হলেও কাঁটাতারের দেয়াল বাধা হতে পারেনি তাঁদের বন্ধুত্বে। গতকাল মঙ্গলবার ২৩ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ৮৩তম জন্মদিন। বন্ধুর জন্মদিনেই চলে গেলেন তাঁর পরম বন্ধু সুনীল। কী অদ্ভুত তাঁদের বৈপরীত্য আর মিল!
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান শুধু নন, এ দেশের নবীন-প্রবীণ অনেক লেখক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিককর্মীর সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে গভীর শোক প্রকাশ করে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, 'বাংলা সাহিত্য হারাল বরেণ্য একজন লেখক, আর বাংলাদেশ হারাল পরম এক বন্ধু। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃতুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে জাতীয় কবিতা পরিষদ। সংগঠনের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী এ কবি জীবনের প্রধান অংশ পশ্চিমবঙ্গে কাটালেও বাংলাদেশের মানুষ ছিল তাঁর একান্তই আপন। যেকোনো সংকটে- তা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক- তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পরম বন্ধু।
কবি মহাদেব সাহা গভীর শোক প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে জানান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ দেশেরই মানুষ। এ দেশের জল-হাওয়ায় কেটেছে তাঁর শৈশব। ফলে আমৃত্যু এ দেশের জন্য তিনি উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর গভীর অনুরাগ, ভালোবাসা।
কবি মহাদেব সাহা বলেন, 'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ মুহূর্তে মহত্তম কবিদের একজন। যদিও তিনি প্রচুর গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখালেখির সঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু সুনীলদা আমার কাছে কবিই। প্রথমত ও শেষপর্যন্ত তিনি কবিই। অসাধারণ তাঁর কবিতা। প্রচুর গদ্যের ভিড়ের আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর কবিতাগুলো।'
গতকাল সকালে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর শোকের ছায়া নেমে আসে এ দেশের লেখক-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে। তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎ। লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সম্পাদক থেকে শুরু করে নবীন ও তরুণ লেখকদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শোকের আবহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগসহ নানা মাধ্যমে তাঁরা প্রকাশ করেন শোকার্ত পঙ্‌ক্তিমালা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুজ বন্ধু ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন কানাডার অটোয়া থেকে তাঁর ফেসবুকে শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, 'আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনকে রাঙিয়ে দেয়া মানুষদের একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমার বিকশিত হবার বাঁকগুলোয় তিনি যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন বই হাতে, একজন মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের মতো। নিজের ঐশ্বর্য-বৈভবের প্রাচুর্যসমুদ্র থেকে একটার পর একটা বই যেন তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। আমি বেড়ে উঠেছি সুনীলদা আপনার বই পড়তে পড়তে। এই কানাডার প্রবাস জীবনেও আপনি তো আমার সঙ্গেই ছিলেন! এখনো বিছানায় শুয়ে হাত বাড়ালে উঠে আসে আপনার 'অর্ধেক জীবন'। আপনি আমার বুকের মধ্যে ছিলেন। আমাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে এভাবে আপনার চলে যাওয়াটা কি ঠিক হলো সুনীলদা?'
কথাসাহিত্যক আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, 'প্রেম ও বিষণ্নতার কবি, অতুলনীয় কথাকার, প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- আপনি আমার বহু দিন-রাত্রি, বহু একাকী মুহূর্ত ভরিয়ে দিয়েছিলেন আপনার অপূর্ব লেখনী দিয়ে। আপনার এ প্রস্থানে আমার একাকিত্ব আরো কিছুটা বাড়ল। যাওয়ার সময় আরো একবার আমার ভালোবাসা আর অভিবাদন গ্রহণ করুন!'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে অনেকে উল্লেখ করেছেন আরেক জনপ্রিয় লেখক সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। তাঁদের দুজনের মধ্যে ছিল গভীর আত্মিক সম্পর্ক। দুজনই তাঁদের লেখায় তুলে এনেছেন দুজনের নানা স্মৃতি, আনন্দঘন নানা মুহূর্ত। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এবার চলে গেলেন তাঁর অতি কাছের বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। অতি স্বল্প সময়ে এ দুই লেখকের প্রস্থানকে বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক আবদুশ শাকুর, কথাসাহিত্যক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি ফরিদ কবির, কথাসাহিত্যক নাসরীন জাহান প্রমুখ।
১৯৫৩ সাল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'কৃত্তিবাস' নামের একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি পরে হয়ে ওঠে তরুণ কবিদের মুখপত্র। এ জন্য দুই বাংলার তরুণ কবিদের সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃতুতে এ দেশের তরুণ কবিরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তরুণ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, 'ভারতে বাংলাদেশের কাছের মানুষ বলতে আর তেমন কেউ রইল না।'

No comments

Powered by Blogger.