রেলের অর্থ কেলেঙ্কারি- প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চান গাড়িচালক আজম by মুহাম্মদ জাকির হোসেন

সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক আজম খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা পেলে তিনি যেকোনো তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হতে রাজি আছেন।


আজম খান গত সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে মুঠোফোনে এ কথা জানান। তিনি বলেন, দুদকের তদন্তে তাঁর আস্থা নেই। কারণ অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কথা না বলেই দুদক বলেছিল, ঘটনার সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
গত ৯ এপ্রিল রাতে আজম সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি নিয়ে জিগাতলার পাশের মূল ফটক দিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই আজম চিৎকার করে বলেন, গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা আছে। ওই গাড়িতে সাবেক এপিএস ওমর ফারুক, রেলওয়ের তখনকার পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ের নিরাপত্তা বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ছিলেন।
একটি অপরিচিত মুঠোফোন নম্বর থেকে গত সোমবার বিকেল চারটা ৩৯ মিনিটে প্রথম আলোর চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা প্রতিনিধির মুঠোফোনে ফোন আসে। ফোনকারী নিজেকে গাড়িচালক আজম খান পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। কথোপকথনের মূল অংশ নিচে দেওয়া হলো:
প্রথম আলো: হ্যালো, কে?
আজম: যাকে আপনারা সবাই খুঁজছেন।
—কে বলছেন?
—আমি আজম, মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িচালক।
—আমার মুঠোফোনে চার্জ নেই। আপনি এই নাম্বারে (অন্য একটি নম্বর দেওয়া হয়) ফোন করেন।
—আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর অন্য আরেকটি নম্বর থেকে ফোন আসে।
প্রথম আলো: হ্যালো, কে?
—হ্যাঁ, আজম।
—শুনেন, আমি যেখান থেকে নিউজ পাঠাই, এটা সেই দোকানের নম্বর।
ভয় নাই, বলেন। আপনি এখন কোথায়?
—আছি। আমি এখন অনেক দূরে...।
—আপনার ভাই শাহ আলম আমাকে ফোন করে বলেছেন, কে বা কারা তাঁকে বলেছে, আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছেন। আসলে কী? —না, না! এটা সম্পূর্ণ ভুয়া। বাড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগ নাই। কিন্তু পেপার-পত্রিকা দেখতাছি। বাড়িতে দুদক চিঠি দিছে। বাড়িতে চিঠি দিয়া লাভ কী? আমি তো বাড়িতে নাই। আপনাকে আমি ফোন দিছি এই কারণে যে পিএম (প্রধানমন্ত্রী) যদি আমাকে নিরাপত্তা দেন; পিএম, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং মানবাধিকার কমিশন—এই তিনজন যদি আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমি বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর যেকোনো তদন্তে হাজির হব।
—মানবাধিকার কমিশন আর কে?
—প্রধানমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশন, স্বরাষ্টমন্ত্রী আমাকে নিরাপত্তা দিলে আমি যেকোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে রাজি আছি। আর না হলে না।
—দুদকের তদন্তে গত রোববার আপনি হাজির হন নাই?
—না, না।
—টিভিতে দেখেছি দুদক আপনাকে হাজির হওয়ার জন্য আরও সময় দিয়েছে। আপনি কি হাজির হবেন না?
—না। একটা কথা বলি, দুদক কিন্তু আমাকে ছাড়াই সেনবাবুকে খালাস দিয়ে দিছে। বলছে, এ ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা নাই। আমি সাক্ষী। ঘটনা ঘটিয়েছি আমি। আমাকে ছাড়াই দুদকের চেয়ারম্যান তাঁকে খালাস করে দিল। আমার কথা আপনি রেকর্ড করেও রাখতে পারেন।
—হ্যাঁ, রেকর্ড তো করবই। কারণ, আমার পত্রিকা যদি আমাকে প্রশ্ন করে এটা যে আজমের ফোন আপনি কী করে বুঝলেন? তখন আমি কী বলব?
—আমার কথা হচ্ছে, আমি দুদকে যাইতাছি না। এ কারণে যে আমাকে ছাড়াই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সে খালাস বলেছে এবং বলেছে, ওনার সঙ্গে ঘটনার কোনো কানেকশন নাই। এ জন্য দুদকের প্রতি আমার কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নাই। যে তথ্য ফাঁস করে, তার (সুরক্ষার) জন্য আইন আছে। সে আইন অনুসারে যদি আমাকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্টমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশন নিরাপত্তা দেয়, তাহলে আমি যেকোনো তদন্তে যেতে রাজি আছি। আমি পারসোনালি (ব্যক্তিগতভাবে) পিএমের কাছে নিরাপত্তা চাচ্ছি।
—পিএমের কাছে নিরাপত্তা চান?
—হ্যাঁ।
—আপনার মেয়েটার নাম যেন কী?
—আমার? এটা বলা কি ঠিক হবে? আমারই তো নিরাপত্তা নাই। আবার বউ-বাচ্চার...।
—মেয়েটার নাম যেন কী?
—আসলে এগুলো বললে সমস্যা। বাচ্চা-কাচ্চার বয়স কম, ভয় পাবে।
—আপনি যে আজম খান, আমি এর নিশ্চয়তা কীভাবে পাব?
—ও (হাসি দিয়ে), এটা সবাই বলে। আমার মেয়ের নাম...(প্রকাশ করা হলো না)। আর ওয়াইফের নাম হচ্ছে...(প্রকাশ করা হলো না)।
—আপনার মূল বক্তব্য কী?
—আমি পারসোনালি চাচ্ছি, এ তিনজন আমাকে নিরাপত্তা দেক। তাহলে শুধু দুদক কেন, যেকোনো তদন্তে হাজির হব।
—স্বরাষ্টমন্ত্রী নিরাপত্তা দিলে হবে?
—না, না। পিএমকে দিতে হবে। কারণ, আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে যদি আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমি যেকোনো তথ্য দিতে অর্থাৎ আমি যা জানি তা দিতে রাজি আছি।
—আপনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত?
—হ্যাঁ। আমি গতবার ভোট আওয়ামী লীগকে দিয়েছি। আমি কেন, আমার ফ্যামেলির সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। আমার নিরাপত্তা না দিয়া আমার নামে চিঠি দিল, আমার নামে মামলা করব বলে বলছে, দুদক জজ মিয়া নাটক করব...। আমি ভালো করে বুঝি, তারা কী চায়। এ সমস্ত নাটক কইরা লাভ নাই। আন্তর্জাতিকভাবে আমার নিরাপত্তার কথা বলেন। আমার কাছে আরও তথ্য আছে। এগুলো এখনো আমি বলিনি। দরকার কী? তবে প্রয়োজন হলে সব বলব।
—আচ্ছা।
—দেখেন, এপিএস মন্ত্রীর, জিএম রেলওয়ের, টাকাটা যাচ্ছিল ঝিগাতলায়। মন্ত্রী হলো সুরঞ্জিত, কমান্ডার এনামুল—সে-ও রেলওয়ের লোক। তার পরও যদি বলে যে মন্ত্রী সুরঞ্জিতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই—এই দুদকের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস নাই। তারা যে আমার জন্য কিছু করবে, এ রকম কিছু আমি দেখি না। সাধারণ পাবলিকও একই কথা বলবে। একটা কথার কথা বলি, এখন আমাকে নিয়ে যদি মাইরা ফেলে, তাহলে আর কোনো সাক্ষী নাই। আমি কেন এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করব? বঙ্গবন্ধু এ দেশ স্বাধীন করছে, ওনার সঙ্গেই এ দেশের মানুষ বেইমানি করছে। আর আমার মতো আম-পাবলিকের সাথে বেইমানি করব না, এটা কোনো কথা অইল?
—আচ্ছা।
—যেহেতু দুদক সুরঞ্জিতকে ডাকে না, জিজ্ঞাসাও করে নাই। তাহলে আমাকে ডাকে কেন? আমি কি আসামি নাকি? এপিএস, জিএম—সবাই বরখাস্ত হলো অথচ ওনার কিছুই হলো না। আমার কী হবে? আমার তো কোনো নিরাপত্তা নাই।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
—রিপোর্টটা করেন। করলে ভালো হবে। না করলে আমি অন্য ব্যবস্থা নেব।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
আজম: আসসালামুআলাইকুম।
প্রথম আলো: ওআলাইকুম আস-সালাম।
সর্বশেষ সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে আটটায় আজম খান আবার এই প্রতিবেদককে আরেকটি নম্বর থেকে ফোন করেন। তিনি জনতে চান সংবাদটি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে কি না?

No comments

Powered by Blogger.