বিশেষ সাক্ষাৎকার : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে তুমুল জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই। তিনি সোমবার রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিছুদিন আগে তিনি কালের কণ্ঠকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। কবির বাসভবনে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আমাদের কলকাতা প্রতিবেদক সুব্রত আচার্য্য
কালের কণ্ঠ : এই যে চারদিকে এক-দেড় বছর ধরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মসার্ধশততম বর্ষ উদ্যাপন এবং তাঁকে নিয়ে এই যে বাঙালিদের তুমুল আগ্রহ; অথচ কলেজ স্ট্রিট কিংবা পুরান ঢাকায় এখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বই গরম কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতাদের সেলফে একই তাকে সাজানো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুনীলের লেখা বই। এ প্রসঙ্গে কি বলবেন আপনি?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ ১০০ ভাগ বাংলা ভাষার মানুষের কবি। কারণ তিনি সারা জীবনে পৃথিবীর কত দেশে গেছেন। অন্য কোনো দেশ নিয়ে কিছু লিখেননি, লিখেছেন এখানকার বর্ষা, এখানকার প্রকৃতি, এখানকার মানুষজন এবং যে বাংলা ভাষায় তিনি লিখেছেন, সে ভাষা যে জানেন না, তাঁর পক্ষে আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝাও সম্ভব নয়।
এই যে রবীন্দ্রসংগীতের মাধুর্য, যাঁরা এ কথাগুলো বুঝবেন না, তাঁরা এই সংগীত থেকে রস খুঁজে পাবেন না। রবীন্দ্রসংগীত বাঙালিদের প্রাণের গান। যেমন বাংলাদেশের, তেমন এখানে। বাংলাদেশে এখন রবীন্দ্রসংগীতের ভালো ভালো শিল্পী আছেন। সুতরাং বাইরে কী হয়েছে- রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কি না, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি চিন্তা কী ছিল- এগুলো ঠিক সাহিত্যের বিচার্য নয়। ওগুলো অন্য রকম বিশ্লেষণ। আর ইংরেজি অনুবাদ পড়ে, গীতাঞ্জলির কতটা রস পাওয়া যাবে! এখন তো আর সাহেবরা রস পাচ্ছেন না। সাহেবরাও এখন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন কবির সৃষ্টি থেকে।
তাই হয়তো ভারতের অন্য রাজ্যে রবীন্দ্রনাথকে আবার তুলে ধরার একটা চেষ্টা চলছে। যাঁরা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন রবিকে। সুতরাং জন্মসার্ধশততম বর্ষের মতো উৎসব করে তাঁকে কিছুটা ফিরিয়ে আনা যাবে।
তবে বড় কিছু পরিকল্পনার কথাও আমি শুনেছি, যেমন রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দি ও ভারতের অন্য ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ, নাটকগুলো অন্য ভাষায় মঞ্চস্থ করার চেষ্টা হচ্ছে। এভাবে অন্য ভাষার লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কতটা পৌঁছতে পারবে, সেটা আমি বলতে পারছি না বাপু!
তবে শুরুতেই যা বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদেরই কবি। তাঁর প্রতিভা কতটা, সেটি বাঙালিরাই বুঝেছেন। বুঝবেন। বাইরের লোকদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
কালের কণ্ঠ : রবীন্দ্রনাথ অন্য গান থেকে নানা শব্দ কিংবা সুর আহরণ করে নিজের মতো করে তাঁর সংগীতে ব্যবহার করেছেন, এই মন্তব্যের পক্ষে আপনার ব্যাখ্যা কী?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আমাদের ভাষায় অন্য ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করি। উর্দু, আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি, পর্তুগিজ কিংবা ফরাসি ভাষার বহু শব্দই বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। ঠিক সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন পাশ্চাত্যের সংগীত গ্রহণ করেছেন, তেমন আমাদের পল্লীর সংগীত, যেমন লালনের গানও নিয়েছেন, গগন হরকরার গান নিয়ে মিশিয়ে যেটা তৈরি করেছেন, সেটা অনবদ্য। এখন পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত তুল্য কোনো গান আমাদের নেই। পৃথিবীতে এ ধরনের নজিরও নেই। যে লেখক একই সঙ্গে এক হাজার ৪০০ কবিতা লিখেছেন, আবার দুই হাজার ২০০ গান লিখেছেন, লেখার সঙ্গে সুরও বেঁধেছেন। এ ধরনের লেখক আছে পৃথিবীতে? নেই। আবার দেখুন, সেই লেখক শেষ জীবনে এমন সব ছবি আঁকলেন, যে ছবি বোদ্ধারাও বলতে লাগলেন, এ যে বিরাট আধুনিক শিল্পী! আর সেই লেখক, চিত্রশিল্পী একটি ছোট্ট স্কুল গড়েছিলেন, সেটাও বিশ্বভারতী বলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল। এত দিকে ছড়ানো তাঁর প্রতিভা।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে রবীন্দ্র সার্ধশততম বর্ষ উদ্যাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে কি কবিকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : সবটা না হলেও কিছুটা তো সম্ভব। কারণ এর আগেও তো বাংলাদেশে রবীন্দ্র জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবস পালন করা হতো। তবে এখন সরকারিভাবে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই আয়োজন বড়। অন্য দেশ থেকে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এসবের কারণে অতি-সাধারণ মানুষ, যারা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তারাও প্রচারের ঢাকঢোলের শব্দে কিছুটা হলেও জানতে পারবে। কিছুটা তো ফল আসবেই। কিন্তু আসল ফল তাঁরাই পাবেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিজেরা উপভোগ করবেন। নিজেরা পড়বেন। নিজেরা গান শুনবেন।
কালের কণ্ঠ : সুনীল-শীর্ষেন্দুর কফি হাউস ও প্রচেত গুপ্ত কিংবা গৌতম বসু মল্লিকের বা জয় গোস্বামীর কফি হাউসের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করুন না!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : একটা বাড়ি আজ থেকে ৬০ বছর আগের করা হলে সেই বাড়িটির চেহারা কি এক থাকে? পরিবর্তন হয়। সব কিছুই বদলায়। কফি হাউস যখন হয়েছিল তখন ছিল কফি বোর্ডের আন্ডারে। কফি খাওয়ার প্রচার ছিল বোর্ডের আসল উদ্দেশ্য। লাভ-লোকসানের কোনো প্রশ্নই ছিল না। সেই সময় কর্মচারীদের মাইনেও কফি বোর্ড দিত। আমরা অল্প বয়সে যখন কফি হাউসে আড্ডা দিতে যেতাম, পয়সা থাকত না পকেটে, তিন কাপ কফি নিয়ে পাঁচজনে বসতাম। ভাগ করে খেতাম। ফ্রিতে চিনি পেতাম অনেক। খিদের চোটে সেই চিনি এমনি এমনি খেয়ে নিতাম। কারণ এর তো আলাদা পয়সা দিতে হতো না আমাদের! কফির সঙ্গে চিনি ফ্রি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আড্ডা দিলে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলত না কেউ। এরপর কফি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিল, উঠে যাবে। ওরা আর চালাবে না। কিন্তু তখনো অনেক কর্মচারী ছিলেন। আমরাও ওখানে বসে আড্ডা দিতাম। কফি বোর্ডের সিদ্ধান্তে আমাদের সেই জায়গাটা নষ্ট হবে! ওরাও বেকার হবে- তাই আমরা সবাই মিলে বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছিলাম। সেই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন সরকার কফি হাউসের মধ্যে কর্মীদের ইউনিয়ন গড়ে দেয় এবং সেই কর্মী ইউনিয়ন চালায় কফি হাউস। তবে এর পরও একবার আশঙ্কা তৈরি হয়, কফি হাউস ভেঙে যাচ্ছে। কারণ ওই বাড়িটির আংশিক মালিক হঠাৎই দাবি করে বসলেন, কফি হাউস ভেঙে শপিং মল করবেন। এরপর আরো একবার আমরা আন্দোলন করি। সেবারও সেটি রক্ষা পায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা শঙ্খ ঘোষের মতো কবিদের সঙ্গেই আমি আড্ডা দিয়েছে সেখানে। গল্প লেখকের জন্য কফি হাউসে একটি টেবিল বরাদ্দ ছিল। আবার কবিতা লেখকের জন্যও ছিল আরেকটি টেবিল। তো, আমার দুই নৌকায় পা ছিল। কবিদের দলেও আছি, গল্প লেখকের দলেও। তবে বেশির ভাগ কবিদের সঙ্গেই বসেছি।
প্রায় ঘরবাড়ির মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। একটির পর একটি সিগারেট শেষ করেছি। কবিতার ভাষা, লাইন নিয়ে কথা হয়েছে। কাকে মনে করে লিখেছি, কোথায় ছাপা হতে পারে। এসব নানা কথা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলেছে আড্ডা। সঙ্গে কফি খাওয়া। চিনি খাওয়া... চলছে তো চলছেই। এখন কি আমাদের সেখানে বসে পাঁচ-সাত ঘণ্টা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ দেবেন বেয়ারারা? কিংবা সেই ফ্রিতে চিনি? ফ্রিতে কিছুই পাওয়া যাবে না এখন। তাই কফি হাউসের চরিত্রটাও পাল্টেছে।
কালের কণ্ঠ : তিস্তা, টিপাইমুখসহ নানা ইস্যুতে সম্পর্কের উত্থান-পতন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অনেকেই বলেন, আপনি বামপন্থী লেখকও। প্রতিবেশী দুই বাংলার সম্পর্ক নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আসলে বামফ্রন্টের সরকার যখন ছিল তখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক, বাংলাদেশের সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক কী হবে, সেটি নির্ধারণ করে দিল্লি। রাজ্য সরকার এই নীতি ঠিক করে না। তবে এখন দিল্লির সরকারের সঙ্গেও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাই আমার মনে হয়, এই সম্পর্কটার প্রতি রাজ্যের চেয়ে দিল্লির বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ ১০০ ভাগ বাংলা ভাষার মানুষের কবি। কারণ তিনি সারা জীবনে পৃথিবীর কত দেশে গেছেন। অন্য কোনো দেশ নিয়ে কিছু লিখেননি, লিখেছেন এখানকার বর্ষা, এখানকার প্রকৃতি, এখানকার মানুষজন এবং যে বাংলা ভাষায় তিনি লিখেছেন, সে ভাষা যে জানেন না, তাঁর পক্ষে আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝাও সম্ভব নয়।
এই যে রবীন্দ্রসংগীতের মাধুর্য, যাঁরা এ কথাগুলো বুঝবেন না, তাঁরা এই সংগীত থেকে রস খুঁজে পাবেন না। রবীন্দ্রসংগীত বাঙালিদের প্রাণের গান। যেমন বাংলাদেশের, তেমন এখানে। বাংলাদেশে এখন রবীন্দ্রসংগীতের ভালো ভালো শিল্পী আছেন। সুতরাং বাইরে কী হয়েছে- রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কি না, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি চিন্তা কী ছিল- এগুলো ঠিক সাহিত্যের বিচার্য নয়। ওগুলো অন্য রকম বিশ্লেষণ। আর ইংরেজি অনুবাদ পড়ে, গীতাঞ্জলির কতটা রস পাওয়া যাবে! এখন তো আর সাহেবরা রস পাচ্ছেন না। সাহেবরাও এখন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন কবির সৃষ্টি থেকে।
তাই হয়তো ভারতের অন্য রাজ্যে রবীন্দ্রনাথকে আবার তুলে ধরার একটা চেষ্টা চলছে। যাঁরা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন রবিকে। সুতরাং জন্মসার্ধশততম বর্ষের মতো উৎসব করে তাঁকে কিছুটা ফিরিয়ে আনা যাবে।
তবে বড় কিছু পরিকল্পনার কথাও আমি শুনেছি, যেমন রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দি ও ভারতের অন্য ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ, নাটকগুলো অন্য ভাষায় মঞ্চস্থ করার চেষ্টা হচ্ছে। এভাবে অন্য ভাষার লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কতটা পৌঁছতে পারবে, সেটা আমি বলতে পারছি না বাপু!
তবে শুরুতেই যা বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদেরই কবি। তাঁর প্রতিভা কতটা, সেটি বাঙালিরাই বুঝেছেন। বুঝবেন। বাইরের লোকদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
কালের কণ্ঠ : রবীন্দ্রনাথ অন্য গান থেকে নানা শব্দ কিংবা সুর আহরণ করে নিজের মতো করে তাঁর সংগীতে ব্যবহার করেছেন, এই মন্তব্যের পক্ষে আপনার ব্যাখ্যা কী?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আমাদের ভাষায় অন্য ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করি। উর্দু, আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি, পর্তুগিজ কিংবা ফরাসি ভাষার বহু শব্দই বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। ঠিক সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন পাশ্চাত্যের সংগীত গ্রহণ করেছেন, তেমন আমাদের পল্লীর সংগীত, যেমন লালনের গানও নিয়েছেন, গগন হরকরার গান নিয়ে মিশিয়ে যেটা তৈরি করেছেন, সেটা অনবদ্য। এখন পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত তুল্য কোনো গান আমাদের নেই। পৃথিবীতে এ ধরনের নজিরও নেই। যে লেখক একই সঙ্গে এক হাজার ৪০০ কবিতা লিখেছেন, আবার দুই হাজার ২০০ গান লিখেছেন, লেখার সঙ্গে সুরও বেঁধেছেন। এ ধরনের লেখক আছে পৃথিবীতে? নেই। আবার দেখুন, সেই লেখক শেষ জীবনে এমন সব ছবি আঁকলেন, যে ছবি বোদ্ধারাও বলতে লাগলেন, এ যে বিরাট আধুনিক শিল্পী! আর সেই লেখক, চিত্রশিল্পী একটি ছোট্ট স্কুল গড়েছিলেন, সেটাও বিশ্বভারতী বলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল। এত দিকে ছড়ানো তাঁর প্রতিভা।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে রবীন্দ্র সার্ধশততম বর্ষ উদ্যাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে কি কবিকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : সবটা না হলেও কিছুটা তো সম্ভব। কারণ এর আগেও তো বাংলাদেশে রবীন্দ্র জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবস পালন করা হতো। তবে এখন সরকারিভাবে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই আয়োজন বড়। অন্য দেশ থেকে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এসবের কারণে অতি-সাধারণ মানুষ, যারা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তারাও প্রচারের ঢাকঢোলের শব্দে কিছুটা হলেও জানতে পারবে। কিছুটা তো ফল আসবেই। কিন্তু আসল ফল তাঁরাই পাবেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিজেরা উপভোগ করবেন। নিজেরা পড়বেন। নিজেরা গান শুনবেন।
কালের কণ্ঠ : সুনীল-শীর্ষেন্দুর কফি হাউস ও প্রচেত গুপ্ত কিংবা গৌতম বসু মল্লিকের বা জয় গোস্বামীর কফি হাউসের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করুন না!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : একটা বাড়ি আজ থেকে ৬০ বছর আগের করা হলে সেই বাড়িটির চেহারা কি এক থাকে? পরিবর্তন হয়। সব কিছুই বদলায়। কফি হাউস যখন হয়েছিল তখন ছিল কফি বোর্ডের আন্ডারে। কফি খাওয়ার প্রচার ছিল বোর্ডের আসল উদ্দেশ্য। লাভ-লোকসানের কোনো প্রশ্নই ছিল না। সেই সময় কর্মচারীদের মাইনেও কফি বোর্ড দিত। আমরা অল্প বয়সে যখন কফি হাউসে আড্ডা দিতে যেতাম, পয়সা থাকত না পকেটে, তিন কাপ কফি নিয়ে পাঁচজনে বসতাম। ভাগ করে খেতাম। ফ্রিতে চিনি পেতাম অনেক। খিদের চোটে সেই চিনি এমনি এমনি খেয়ে নিতাম। কারণ এর তো আলাদা পয়সা দিতে হতো না আমাদের! কফির সঙ্গে চিনি ফ্রি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আড্ডা দিলে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলত না কেউ। এরপর কফি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিল, উঠে যাবে। ওরা আর চালাবে না। কিন্তু তখনো অনেক কর্মচারী ছিলেন। আমরাও ওখানে বসে আড্ডা দিতাম। কফি বোর্ডের সিদ্ধান্তে আমাদের সেই জায়গাটা নষ্ট হবে! ওরাও বেকার হবে- তাই আমরা সবাই মিলে বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছিলাম। সেই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন সরকার কফি হাউসের মধ্যে কর্মীদের ইউনিয়ন গড়ে দেয় এবং সেই কর্মী ইউনিয়ন চালায় কফি হাউস। তবে এর পরও একবার আশঙ্কা তৈরি হয়, কফি হাউস ভেঙে যাচ্ছে। কারণ ওই বাড়িটির আংশিক মালিক হঠাৎই দাবি করে বসলেন, কফি হাউস ভেঙে শপিং মল করবেন। এরপর আরো একবার আমরা আন্দোলন করি। সেবারও সেটি রক্ষা পায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা শঙ্খ ঘোষের মতো কবিদের সঙ্গেই আমি আড্ডা দিয়েছে সেখানে। গল্প লেখকের জন্য কফি হাউসে একটি টেবিল বরাদ্দ ছিল। আবার কবিতা লেখকের জন্যও ছিল আরেকটি টেবিল। তো, আমার দুই নৌকায় পা ছিল। কবিদের দলেও আছি, গল্প লেখকের দলেও। তবে বেশির ভাগ কবিদের সঙ্গেই বসেছি।
প্রায় ঘরবাড়ির মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। একটির পর একটি সিগারেট শেষ করেছি। কবিতার ভাষা, লাইন নিয়ে কথা হয়েছে। কাকে মনে করে লিখেছি, কোথায় ছাপা হতে পারে। এসব নানা কথা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলেছে আড্ডা। সঙ্গে কফি খাওয়া। চিনি খাওয়া... চলছে তো চলছেই। এখন কি আমাদের সেখানে বসে পাঁচ-সাত ঘণ্টা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ দেবেন বেয়ারারা? কিংবা সেই ফ্রিতে চিনি? ফ্রিতে কিছুই পাওয়া যাবে না এখন। তাই কফি হাউসের চরিত্রটাও পাল্টেছে।
কালের কণ্ঠ : তিস্তা, টিপাইমুখসহ নানা ইস্যুতে সম্পর্কের উত্থান-পতন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। অনেকেই বলেন, আপনি বামপন্থী লেখকও। প্রতিবেশী দুই বাংলার সম্পর্ক নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আসলে বামফ্রন্টের সরকার যখন ছিল তখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক, বাংলাদেশের সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক কী হবে, সেটি নির্ধারণ করে দিল্লি। রাজ্য সরকার এই নীতি ঠিক করে না। তবে এখন দিল্লির সরকারের সঙ্গেও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাই আমার মনে হয়, এই সম্পর্কটার প্রতি রাজ্যের চেয়ে দিল্লির বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন।
No comments