পর্যবেক্ষণ-নষ্ট শরৎ-কথা by হাসান আজিজুল হক

মানুষের বর্তমান ধূসর, না অতীতটা? মানুষের বর্তমান কি বর্ণহীন? অতীতটা কি সুবর্ণময়? মানুষ যখন জীবনযাপন করে, তখন সেই যাপনের মুহূর্তে জীবনটাকে নিয়ে কি কিছু ভাবে? নাকি ভাবতে গেলেই একটু পিছিয়ে যেতে হয়? আজকের যাপনটা গতকালের করে নিতে হয় নাকি? কিংবা গতকালকের যাপনটা তারও আগের করে নিতে হয় কি?


সবচেয়ে ভালো হয়, দশ বিশ পনেরো বছর পিছিয়ে যেতে পারলে। সেই সময় যা বর্তমান ছিল, তা এখন অতীত। তখন মনে হয়, কিছু প্রাপ্তি আছে। আসলে আমরা ঠিক জানি না, আমাদের জীবনযাপনটা কী প্রণালিতে চলে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে চলে, অনেক পরিকল্পনা করে; নাকি চিন্তাহীনভাবে? আমার মনে হয়, একটু পেছনে গেলেই আলাদা একটা ঘর আছে। সেই ঘরেই সঞ্চিত থাকে কত সব কথা। সেসবের ধরন একেবারেই আলাদা। যেমন_ মদ যত ভালোই হোক না কেন, পুরনো করতে পারলে তার স্বাদ একেবারে আলাদা।
শরৎ তো এসে গেছে। আমাদের দেশে আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষা, ভাদ্র-আশ্বিনে শরৎ আর কার্তিক-অগ্রহায়ণে হেমন্ত। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই যেন এই ঋতুবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময়ে যেগুলো নির্দিষ্ট করে দিন-তারিখ-মাসভিত্তিক ছিল, এখন সেগুলো আর সেই হিসাব কষে আসে না। আমার মনে হচ্ছে, আমার ছোটবেলায় ঋতু আরও সুনির্দিষ্ট ছিল। আষাঢ়ের বৃষ্টিটা আমার খুব ভালো লাগত। তখনও জমিতে রোপা হয়নি। তখন আরেকটা ব্যাপার ছিল; ফসলের সংখ্যা ছিল খুব সীমিত। রাঢ় এলাকায় আউশ আর আমন ছাড়া অন্য কোনো ফসল ছিল না। আউশ আবার পরিমাণে খুব সামান্যই হতো। আর আউশ ওঠার আগেই বীজতলা থেকে বীজ তুলে হতো রোপা ধান রোপণ। বীজ বড় হচ্ছে, ওদিকে তিনটি করে লাঙল পড়ছে। শেষ লাঙলটা পড়ত কাদার মধ্যে। সেটাকে বলা হতো কাদানো। জলভরা জমি, লাঙল দেওয়া হলো। এরপর মই দিয়ে সেটাকে সমান করা হলো। জমিটা তৈরি। তখন হাঁটু গেড়ে বসে একদল মুনিশ বীজতলা থেকে বীজ তুলছে, আঁটি বাঁধছে। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হতো আষাঢ় মাসের পর। আমাদের বাড়িতে মুনিশ নিয়ে আসা হতো সাঁওতাল পরগনা ও অন্য এলাকা থেকে। তখন বাড়িতেও একটা ভীষণ আনন্দের সময়, ব্যস্ততার সময়। এদের অন্তত দু'বার খাবার দিতে হতো। একবার সকাল ১০টা-১১টায়, আরেকবার দুপুর ২টার দিকে। এই খাবার নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। সবকিছুই তখন খুব ভালো লাগত। যে খালটা একেবারে শুকনো ছিল, সেটায় তখন এককোমর পানি। দেখতেও ভালো লাগত। অনেক বড় বড় বিদেশি পাখি আসত। এক জায়গায় অন্তত ৫০টি শামুকখোল পাখি থাকত। এসবের কোনোটাই এখন বাংলাদেশে দেখা যায় না। দীঘির পাড়ে যত জামগাছ ছিল, সেই জামগুলো পাকতে শুরু করেছে। গাছে তখন এত জাম ধরত আর এমন করে সেগুলো পাকত যে, মনে হতো ওখানকার আকাশে ঘন মেঘ। আমি যে বয়সের ছিলাম, এখনও তো সেই বয়সের শিশুরা আছে। জানি না, তারা কি এগুলো দেখতে পায়?
ভাদ্র মাসে এসে এই বর্ষাটাই আমাদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠত। অবিরাম বর্ষণ চলছে তো চলছেই। ছাড়েই না। আমরা বলতাম, পচা ভাদ্দর। ঘর থেকে বেরোলেই রাস্তায় একেবারে প্যাচপেচে কাদা। তারপরও এই বর্ষার মধ্যে ভিজতে আনন্দ। এর মধ্যে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে আনন্দ। চারদিকে সবুজের এক অন্য চেহারা। খুব নির্দিষ্ট সময়েই বর্ষা শেষ হয়ে শরৎ আসত। আর সেই শরতের আসাটা ছিল একেবারে স্পষ্ট। আকাশ নির্মেঘ, বায়ু নির্মল। এই দুটি কথার কোনোটিই কিন্তু এখন আর বলা যাবে না। বায়ু নির্মল তো একেবারেই বলা যাবে না। আমার ছোটবেলায়, এই সময় রাঢ়ের বিস্তীর্ণ প্রান্তরগুলো জলে টইটম্বুর থাকত। নদীতে জল কিন্তু বর্ষাকালে বাড়ত না। তা ছিল এই সময়ে। অনেক ওপর থেকে যখন হিমবাহ গলতে শুরু করত, তখন নদীতে জল বাড়ত। কারও বাড়িতে যাচ্ছি। পেছনে দেয়ালঘেরা জায়গাজুড়ে শেফালি গাছ। শেফালি ফুলের সাদা পাপড়িগুলো ফেলে দিয়ে যে বোঁটাটা থাকছে সেটা সেদ্ধ করে তা দিয়ে আমরা সাদা কাপড় শেফালি ফুলের রঙে রাঙিয়ে নিতাম।
এবার আশ্বিন মাস। একেবারে ঘোষণা দিয়ে জানান দিত। সেই ঘোষণাটা ছিল দুর্গাপূজার প্রস্তুতি। সেই সময় হয়তো ঢাকীরা তাদের ঢোল আর বাতাসভরা চামড়ার যেসব বাদ্যযন্ত্র আছে, সেগুলো রোদে দিত। আমার মা-চাচিদের দেখেছি, এই সময়টা এলেই তারা তাদের কাশ্মীরি শাল বা পশমি পোশাক বের করে পোকা মারার জন্য বাইরে রোদে দিতেন। এই সময় শণগাছ ভিজিয়ে তার ছাল ছাড়ানো হতো। ঈদ তো সারাবছর ঘুরে ঘুরে আসত। কাজেই ঈদ নিশ্চয় কোনো এক সময় শরতেও আসত। এবারে যেমন হয়েছে। এবার পূজার ক'দিন পরেই ঈদ। আমার মনে আছে, পূজার কয়েকদিন আগে আমাদের বকরিদ এসেছিল।
এক সকালে বাতাসটা সামান্য ঠাণ্ডা। ঘুম থেকে উঠে বাইরে দাঁড়াতেই বহু দূর থেকে মেঘের মতো কেমন একটা গুড়গুড় আওয়াজ পাওয়া যেত। আকাশে তো কোনো মেঘ নেই। তাহলে? খুব দূরের গ্রামে কেউ হয়তো ঢাক বাজাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যেত, এবার দুর্গাপূজা আসছে। দুর্গাপূজাটা এমন মজার যে, প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের মনের যে পরিবর্তন তার সঙ্গে দুর্গাপূজা একসুরে বাঁধা। সে কারণেই ওই আওয়াজটা শুনে আমাদের তখন প্রতিমা পূজা বা এরকম কোনো বিষয় মনেই হতো না। এই যে পৃথিবীটা, যেটাকে মনে হয় ভালো এবং বেঁচে থাকার উপযোগী, ওই আওয়াজটা কিন্তু আমাদের সেটার কথাই মনে করিয়ে দিত। বর্তমানে যারা জীবনটা কাটাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগের কাছেই জীবন দুঃসহ। কিন্তু পেছনে তাকালেই মনে হয়, জীবন দুঃসহ নয়। আমার এখন সেটাই মনে হয়। আমাদের পরিপূর্ণ চেতনা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে বোধগুলো প্রয়োজন, সুন্দরকে গ্রহণ করা, ভালোকে গ্রহণ করা, সেগুলো শরতের মধ্যে আছে।
তো, শরৎ এলেই দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। গ্রামে গ্রামে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে শুরু হতো কাজ। তৈরি প্রতিমা হয়তো পাওয়া যেত। তবে সেগুলো নয়। বাড়িতেই প্রতিমা তৈরি করা হতো। দুর্গা ঠাকুরকে বিসর্জন দেওয়ার পর তার খড়ের কাঠামোটা তুলে এনে বাড়ির বাইরে খড়ের গাদার মধ্যে সারা বছর ফেলে রাখা হতো। সবকিছু পুরনো। কতদিন ধরে পড়ে থাকে। কিন্তু যেই ঢাকটা বাজল, অমনি সবকিছু বদলে গেল। তখন গ্রামের যে যে বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো, সেগুলো জেগে উঠত। ওই সব বাড়িতে কুমোররা আসত। তারা মূর্তি তৈরি করত। প্রতিদিন একটু একটু করে গড়া হতো। দেখতে ভারি ভালো লাগত। খড়ের কাঠামোর ওপরে এক লেপা, দুই লেপা, তিন লেপা করে মাটির প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। এরপর সাদা করা হচ্ছে শুকনো খড়ি দিয়ে। তারপর রঙ করা হচ্ছে। তখনও মূর্তির গায়ে কাপড় পরানো হয়নি। মূর্তির গায়ে মাটির তৈরি গহনা পরানো হয়। তারপর দু'দিন ধরে রঙ করা চলে। এরপর বসন পরানো হয়। দুটো জিনিস আমাদের কাছে খুব মজা লাগত। এর একটা হলো চক্ষুদান। পুরো মূর্তি তৈরি। কিন্তু তার চোখ নেই। সে জায়গাটা সাদা। একদিন সেখানে রঙ দিয়ে চোখ আঁকা হতো। সেই দৃশ্যটা অসাধারণ লাগত। দুর্গাপূজাটা যে নিছকই ধর্মীয় ব্যাপার, এটা কারা মনে করেন জানি না। আর এই পূজাটা বাংলার বাইরে তেমন হয়ও না। এই পূজার মধ্যে কিন্তু বাঙালিরা একটা বিশেষ আবেগ যোগ করে দিয়েছে। তা হচ্ছে বাৎসল্য। মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর তো সে আর বাবার বাড়ির কেউ নয়। কিন্তু বছরে একবার তো সে মেয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা-মায়ের ঘরে আসবে। বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে ফলমূল, পিঠা ইত্যাদি পাঠানো আমাদের রাঢ়ে সবসময়ই ছিল। শুধু হিন্দুদের নয়, মুসলমান পরিবারেও তেমনই চল ছিল। বছরের যে সময়টা সব থেকে মধুর, মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে, সেই সময়টায় আত্মীয়-স্বজনকে আনা হতো। মেয়েকেও বিশেষভাবে আনা হতো। এই সময়টায় কত গান। পূজাকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু বোঝাই যায়, এসব গানে মানুষের একেবারে গভীরের অনুভূতি বলা থাকে।
এগুলো সবই দেখেছি। যখন দেখেছি, তখন কী মনে হয়েছিল, বলতে পারি না। সেই মুহূর্তের জীবনযাপনে এসব কী অর্থ করেছিল জানি না। কিন্তু আজকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে আমি বলব, এই বাংলাদেশে এখন কি শরৎ আছে? শহরের দিকে গেলে তো কোথাও আকাশ নেই। যাকে বলে একেবারে অট্টালিকার অরণ্য। জানি না যা বললাম তা নস্টালজিক কি-না কিংবা আধুনিক সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে কি-না। তবে এটা ঠিক, পুরো জিনিসটাই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিচ্ছে; পৃথিবীটাকে একেবারে গরম করে তোলার, ক্রমেই বসবাসযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলার। হয়তোবা আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে মানুষের বসবাসযোগ্যতা থাকবে না। যদি দূষণের হার কমিয়ে আনা না হয়। তাহলে বোঝাই যায়, ভালো আর মন্দ, উন্নয়ন আর অধঃপতন কীভাবে পাশাপাশি জড়িয়ে আছে। প্রকৃতি কি প্রতিশোধ নিচ্ছে? রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সেই রোগ কমছে। কিন্তু অন্য রোগ বাড়ছে। যেগুলো একসময় সামান্য কিছু মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ ছিল, আজ তা কোটি মানুষের দুর্ভাগ্য। তাহলে কি দুটিই সত্য? প্রকৃতিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বাড়ছে আর প্রকৃতিও অন্য উপায়ে আমাদের ধ্বংস করার রাস্তা খুঁজে বের করছে? আজ থেকে ১০ বছর পরে এই বদলটা কতটা স্মৃতিসুখকর হবে_ আমি জানি না। আর সে কারণেই আমি বলার চেষ্টা করলাম, বর্তমানটা যেভাবে কাটানো যাচ্ছে, যে ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে সেটা কি এই গ্রহের বাসিন্দাদের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত?

হাসান আজিজুল হক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.