বহে কাল নিরবধি-এখনো অনিশ্চিত পদ্মা সেতুর ভাগ্য! by এম আবদুল হাফিজ

রাজনীতিসহ জীবনের যেকোনো সংকটে কুইক ফিক্স (Quick fix) বা তাৎক্ষণিক সমাধান বলে কিছু নেই। আবার কোনো সংকট যদি ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত বিচ্যুতির কারণে ঘটে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। অনেক মাথা কুটতে হয় সেই বিচ্যুতি শোধরানোর এবং এর প্রক্রিয়া অনেক জটিল, সময়সাপেক্ষ ও অনিশ্চিত।


পদ্মা সেতুর জন্য প্রায় হাতে পাওয়া ১২০ কোটি ডলারের বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন সেই যে কথিত দুর্নীতির কারণে ফসকে গেল, তারপর উভয় পক্ষ থেকে অনেক কৈফিয়ত উপস্থাপন, দূতিয়ালি এবং এমনটি না হওয়ার কিরা-কসমের পরও আর কৃত ভুলের জট খুলছে না তো খুলছেই না। বুক ভরা আশা নিয়ে অপেক্ষমাণ এ দেশের মানুষের জন্য এ এক নির্মম পরিহাস!
যদিও অনেক প্রচেষ্টার পর কিছুটা আশার ঝিলিক আমরা গত মাসে দেখেছিলাম বিশ্বব্যাংকের একটি ক্ষীণ আশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে- এখন মনে হচ্ছে, সে আশায়ও গুড়েবালি। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্যানেল আমাদের দুদকের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় প্রেরণের প্রতিশ্রুতিকেই আমরা ভেবেছিলাম আলো, এখন দেখা যাচ্ছে যে তা ছিল নিছক আলেয়া। সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়েও ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন সফরকারী তদন্ত প্যানেলকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দুদকের পরিচিতি সভার সুযোগ বলে উল্লেখ করেন- যদিও দুদক চেয়ারম্যানের এই প্যানেলের সঙ্গে তাঁর সংগঠনের আলোচনায় উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেন তিনি।
সফরকারী প্যানেলের দাবি অনুযায়ী প্যানেল এই সফরে দুদকের তদন্তপ্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেছে এবং বাংলাদেশের আইন ও দুর্নীতির গতিধারা সম্বন্ধে ধারণা গ্রহণ করেছে। বিশ্বব্যাংক প্যানেলের এজেন্ডায় না থাকলেও প্যানেলের সদস্যরা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ড. কামাল হোসেন ও মিডিয়ার মুখপাত্র ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চেষ্টা করেন এক নৈশভোজে। অবশ্য এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ছিল। তাঁর ধারণায় এক-এগারোর পরেও এই স্বঘোষিত বিশিষ্টজনদের ভূমিকা ছিল রহস্যাচ্ছন্ন।
এ ছাড়াও ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্যানেল দুই দিনে দুদক ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করে। কিন্তু তাদের ঢাকা ছাড়ার আগ পর্যন্ত প্যানেলের ঢাকা আগমন ও এখানে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ফলাফল সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়নি। অজ্ঞাতই থেকে গেছে প্যানেলের মনোভাবের আভাস। কেউ বলতে পারে না যে তারা ইতিবাচক বা নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে ফিরেছে। ঋণের ভবিষ্যৎও স্বভাবতই এখনো রয়ে গেছে অনিশ্চিত।
যদিও বিশ্বব্যাংক তদন্ত প্যানেল আমাদের একটি অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তার মধ্যেই রেখে গেল। তবু আমাদের প্রত্যাশা থাকবে অব্যাহত। এটি আমাদের স্বপ্নের সেতু, আমাদের দেশের এক বিশাল অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সোপান। যদিও তদন্ত প্যানেলটির সফরসূচিটি ছিল একটি নাজুক সময়ে- যখন হলমার্ক, ডেসটিনি এবং আরো অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দুর্নীতির পঙ্কে ভাসছিল বাংলাদেশ। জানি না, সেগুলো থেকে কী ধারণা নিয়ে গেল তদন্ত প্যানেল।
আমরা তো আশা করতেই থাকব যে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেল অবশ্যই অসংখ্য গুজব ও নিন্দাবাদ থেকে তাদের প্রয়োজনের তথ্যটি বের করে আনতে পারবে। অনেকেই অর্থায়নের চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছার পথে প্রফেসর ইউনূস-সদৃশ প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। কোনো বিবেকবান ব্যক্তি তেমনি বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। তিনি সরকার কর্তৃক যতই কোণঠাসা হয়ে থাকুন না কেন, জনগণের কল্যাণই তো সরকার এবং তার মতো অতি বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিন্ন লক্ষ্য। একদিন তিনিও থাকবেন না এবং সরকারেরও পালা বদল হবে; কিন্তু জনগণ উভয়ের কৃতকর্মের সাক্ষী হয়ে থাকবে। ইতিহাসের সেই প্রক্রিয়ায় তিনি অবশ্যই জনগণের আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চাইবেন না। প্রফেসর ইউনূস ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোসসা সত্ত্বেও কিন্তু পদ্মা সেতু অর্থায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। সেটাই প্রমাণ করে যে আশার বর্তিকা যতই ক্ষীণ হোক, এখনো তা সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়নি।
জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের প্যানেল আবারও ঢাকা সফরে আসছে। তবে এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, এই প্রক্রিয়ায় ঠিক কত সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতুর বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত শর্ত পূরণে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনসহ ৯ জনকে দুদক ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আসবেন।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ডস্টেইনের তথ্যানুযায়ী তদন্ত প্যানেলের ঢাকা সফরের একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন শিগগিরই দুদককে দেওয়া হবে। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন কবে নাগাদ দেওয়া হবে সে সম্বন্ধে গোল্ডস্টেইন কিছু বলেননি। ফলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঘোষণা অনুযায়ী চলতি মাসে দরপত্র আহ্বান এবং আগামী বছরের এপ্রিলে পদ্মা সেতু প্রকল্প শুরুর সময়সূচি রক্ষিত হবে বলে মনে হয় না।
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে ভেস্তে যাওয়া বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। ঋণদাতার প্রদত্ত শর্তগুলো পূরণে আমাদের শুধু যত্নবানই নয়, ধৈর্যের পরীক্ষাও দিতে হবে। যে কথা দিয়ে নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই। সমস্যার কোনো 'কুইক ফিক্স' বা তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। তা ছাড়া যাদের receiving end-এ অবস্থান তাদের পছন্দ-অপছন্দের কিছু নেই। সেই যে বলা হয়- 'ভিখিরির জন্য চাল কাড়া বা আকাড়া। সেই উপলব্ধি নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। এ-ও সত্য যে সবুরে মেওয়া ফলেই।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইএসএস

No comments

Powered by Blogger.