হেমন্তের রাতে সুনীলের প্রস্থান by সুব্রত আচার্য্য

চলে গেলেন দুই বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এ যেন মহাষ্টমীর রাতে দেবী বিসর্জন। সোমবার দিবাগত রাতে অষ্টমী এবং নবমীলগ্নের মাঝখানে কলকাতার মন্দিরে মন্দিরে যখন সন্ধি পূজা চলছিল, তখনই পাঁচ দশকের জনপ্রিয়তম কবির প্রয়াণ ঘটে।


নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত ৭৯ বছরের সুনীল বাথরুমে পড়ে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি।
পারিবারিক সূত্র জানায়, অষ্টমীর ওই রাতে সবাই ব্যস্ত থাকায় দ্রুত চিকিৎসকও পাচ্ছিলেন না সুনীলপত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল এ কারণে। দেরিতে চিকিৎসক এসে গড়িয়াহাট মোড়ের একডালিয়ার মেন্ডিভিলা গার্ডেনের ৯ তলার ফ্ল্যাটে কলিং বেল যখন চাপেন, ততক্ষণে ছদ্মবেশী নীল-লোহিতের হৃদযন্ত্রে লোহিত কণিকারা সব জমাট বেঁধে গিয়েছিল। তাই চিকিৎসকের কিছু করার ছিল না। জীবনের প্রিয়তম মানুষটির নিথর হয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শোনার পর স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় হাহাকার করে বলে ওঠেন, 'হায়, মহাষ্টমীর রাতে দেবী বিসর্জনের মতো ঘটনা ঘটে গেল!'
নীল-লোহিত, সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায়ের মতো বহু বিচিত্র চরিত্রের জন্মদাতা সুনীল, মহানবমীর নীলাকাশে সূর্য ওঠার আগেই এভাবে মিলিয়ে গেলেন। খবরটি জানাজানি হলে দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর সমালোচকরাও হয়ে পড়েন অশ্রুসিক্ত।
ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়- এ প্রশ্নের উত্তরে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় জানান, 'রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ টেলিভিশন দেখে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন শরীরটা ভালো লাগছে না বলে সুনীল জানালেন। রাতে তেমন কিছু খাওয়া-দাওয়া করতে পারেননি। বেশ কিছুদিন ধরে খাওয়ায় একদম রুচি ছিল না। দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। এ কারণে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। রাত তখন পৌনে ১টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেলেন। সেখানেই পড়ে যান। আমি তাঁকে ধরে বিছানায় তুলে দিই। এরপর চিকিৎসককে ডাকার চেষ্টা করি। অষ্টমীর রাত, কাউকে পাওয়াও যাচ্ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক ডাক্তারকে পেলাম। তিনি এসে দেখলেন। প্রথমে আমাকে বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু আমি নিজেই বুঝে গিয়েছিলাম, যে সুনীল নেই।'
সুনীলের কলম থেকে এসেছে- সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো, অগ্নিপুত্র, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, পুরুষ, সরল সত্য, মনের মানুষ, প্রতিদ্বন্দ্বী, রক্তমাংস, জীবন যে রকম, মহাপৃথিবীর মতো কালজয়ী উপন্যাস। আনন্দ, সাহিত্য আকাদেমি, সরস্বতী পুরস্কার, সেরা বাঙালি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন সুনীল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিবক্ত বাংলার ফরিদপুরে ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল। যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে অনেকের সঙ্গে তিনিও ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বহু জায়গায়। তখন তাঁর কলমও গর্জে উঠেছিল মুক্তির পক্ষে, পাক হানাদারের বিরুদ্ধে। কাগজে-কলমে তিনি ভারতীয় হলেও, মনে-প্রাণে তিনি সব সময় বাংলাদেশকে লালন করেছেন। এ আবেগের প্রকাশ তাঁর সাহিত্যে ছিল। কলকাতায় থাকলেও ঢাকার ডাক পেলেই চলে গেছেন স্বগর্বে।
লেখক সত্তার বাইরেও সচেতন রাজনৈতিক সমালোচক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরোধী দল নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে শুরু করে কবি নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, আবুল বাশার, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেব সেন, প্রচেত গুপ্ত, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রসেন জিৎ, অভিনেত্রী অপর্ণা সেন প্রমুখ এই মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। শোকবার্তা দেওয়ার চেয়ে তাঁরা সবাই নিজেদের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত ছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সে দেশের অনেকে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, এই সময়ের বাঙালি বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদায়ে যেন বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রের পতন ঘটল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের বড় মাপের লেখক হারালো বাঙালি জাতি।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, 'দেশ পত্রিকায় দীর্ঘদিনের সহকর্মী আমরা দুজন ব্যক্তিগত জীবনেও প্রায় সহকর্মী হয়ে গিয়েছিলাম। কত বড় মনের মানুষ ছিলেন তা বলে ওকে ছোট করতে চাই না। তবে ওর যে লেখালেখির জন্য আরো বেশি দিন বেঁচে থাকতে হবে, এর জন্য একটু নিয়মাকানুন মেনে চলা- এতে ওর বড্ড উদাসীনতা ছিল। সুনীল আমার চেয়ে বহুগুণে মহৎ মানুষ ছিল। অনেক উঁচুদরের মানুষ ছিল। সুনীলের কাছে আমাকে ম্লান মনে হয়। সাহিত্যিক হিসেবেও তার দশ ভাগের এক ভাগ হতে পারিনি।' তিনি আরো বলেন, 'একই টেবিলে সুনীল মাংস নিয়ে খেতে বসত, আমি নিরামিষ।'
সাহিত্যিক আবুল বাশার বলেন, 'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরেই আমি আজ আবুল বাশার হয়েছি। জীবনে এ ঋণ শোধ করার মতো নয়। একজন লেখকের মৃত্যু নয়, আমার অভিভাবকেরও মৃত্যু হয়েছে। এই শোক সহ্য করার মতো নয়।'
কবি নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, 'ওর আগেই তো আমার চলে যাওয়ার কথা ছিল। ১৪-১৫ বছর বয়সে সুনীলের লেখা আমিও মনোনীত করেছিলাম দেশে। ওই বয়সে চশমা বলে একটি গল্প লিখেছিল। ওই রকম একটি বাচ্চা ছেলে এ ধরনের একটি গল্প লিখতে পারবে ভাবতেই পারছিলাম না। সুনীলের চলে যাওয়া বড় শূন্যতা সৃষ্টি করল।'
প্রচেত গুপ্ত মনে করেন, কোনো শূন্যতা নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আসলে পাঠকের মনে পূর্ণতা দিয়ে গেছেন। তিনি আলোর লেখক ছিলেন। অন্ধকার তাঁকে ছুঁতেই পারেনি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, 'আশি ছুঁইয়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যৌবনের টগবগে তরুণের মন লালন করেছে। ওর ভেতর বুড়ো মানুষের কোনো ছায়া ছিল না। সে কারণেই ওর লেখা সব সবই আধুনিক ও বর্তমান।'
কলকাতায় সুনীলভক্তরা দুঃসংবাদটি অবশ্য একটু দেরিতেই পেয়েছেন। অষ্টমীতে অনেকেই রাতভর পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রতিমা দেখেছেন। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে তাঁদের অনেকেই ভোর সকালে উঠতে পারেননি। টেলিভিশনগুলোতে ব্রেকিং নিউজ দিতেও দেরি হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে খবর দেওয়া হচ্ছিল টিভিতে। কারণ গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে টেলিভিশন কর্মীরাও সকালে অফিসে ঢুকেছেন দেরি করে। আর পূজার কারণে দৈনিক পত্রিকাগুলোও বন্ধ টানা চার দিন।
ভোরবেলায়ই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মরদেহ মধ্যকলকাতার হিমঘর 'পিস হেভেন'-এ নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওই প্রতিবেশী নবনিতা দেবসেন ছাড়া তেমন কোনো লেখক-সাহিত্যিক আসতে পারেননি।
বোস্টনপ্রবাসী ছেলে শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতায় এলেই শেষকৃত্যানুষ্ঠান হবে বলে জানান স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি এ-ও বলেন, 'সুনীল তো এখন আমাদের নন। তিনি সবার। তাই সবাই মিলে যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমি সেটাতেই রাজি। তবে সুনীলপত্নীর একটাই আপেক্ষ, ছোটদের মহাভারত রচনাটি তিনি শেষ করতে পারলেন না।
বাংলাদেশেও শোক : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশেও তাঁর ভক্তরা মুষড়ে পড়েন। শোকবার্তা দেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা থেকে শুরু করে অনেকেই। শোকবার্তায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, 'সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অসমান্য অবদানের জন্য বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাঁকে চিরদিন স্মরণে রাখবে।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।' 'সেই সময়', 'পূর্ব পশ্চিম' এবং 'প্রথম আলো' প্রভৃতি উপন্যাস, নিখিলেশ ও নীরা কবিতার সিরিজসহ অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রম্যরচনা ও নাটকের মাধ্যমে তিনি পাঠকের কাছে অমর হয়ে থাকবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।"
মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সেই সময় তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার সাহস জুগিয়ছিল।'
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, 'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রেখেছেন অসামান্য অবদান। তাঁর সৃষ্টিকর্মে বাংলা সাহিত্য আরো বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় তাঁর অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, একুশে চেতনা পরিষদ, কবিসংসদ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট প্রভৃতি।

No comments

Powered by Blogger.