কয়লা খনন- ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেষ বিকেলে মাটি কাটবেন না’ by বদরূল ইমাম

অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী প্রবন্ধের শিরোনামে দেওয়া এ কথা প্রধানমন্ত্রীর ঘোর সমর্থক একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের, যিনি নানা দিক ভেবে-চিন্তে রাজনৈতিক চাল-চলনের সর্বোত্তম পন্থা বা পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিয়ে থাকেন।


যদি খবরটি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বিজ্ঞ এই ব্যক্তিত্ব তাঁর বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যা বলতে চেয়েছেন, তা সম্ভবত এই যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি স্থাপন করার পক্ষে সরকার-নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ দল সম্প্রতি যে মতামত দিয়েছে, তা গ্রহণ করার সময় এটি নয়। আরও স্পস্ট করে বললে বলা যায়, সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লাখনি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির কয়লাখনি নিয়ে কথা বলা কঠিন এ কারণে যে, ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিপক্ষে আন্দোলনকারী ফুলবাড়ী জনগণের মিছিলে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তিন ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর আন্দোলনের যে উত্তাল ঢেউ জেগেছিল, তারই প্রেক্ষাপটে সে সময়ের বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তিনি উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিপক্ষে, এ পদ্ধতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তিনি ফুলবাড়ীর জনগণের পক্ষে। তিনি আরও বলেছিলেন, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সঙ্গে উন্মুক্ত খনন নিষিদ্ধ করার পক্ষে যে চুক্তি বিএনপি সরকার করেছে, তা বাস্তবায়ন না করার ফল হবে ভয়াবহ (প্রথম আলো, ২৬ আগস্ট ২০১২)।
একইভাবে বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া সে সময়ের সরকারপ্রধান হিসেবে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির কয়লাখনির বিপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করে জনগণের পক্ষে তাঁর সরকারের অবস্থান জানিয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, দেশের দুই প্রধান দলনেত্রী উভয়ই কি উন্মুক্ত পদ্ধতির খনন কয়লাখনি স্থাপন না করার পক্ষে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ? আর যদি তা-ই হয়, তবে রাজনৈতিক দায় ভঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে জনগণের সমর্থন হারাতে কি প্রস্তুত এ দুই নেত্রী? অন্তত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ দায় সম্ভবত নিতে চান না, যা কিনা তাঁর বক্তব্য থেকে অনেকটা আঁচ করা যায়। কিছুদিন আগেও তিনি সংবাদমাধ্যমগুলোয় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, দেশের মজুদ কয়লা বর্তমানে ওঠানোর পরিবর্তে তা আগামী প্রজন্মের জন্য রাখা হবে। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানিসংকট নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে ব্যস্ত অর্থনীতিবিদ, খনিবিদ বা নীতিনির্ধারক বিশেষজ্ঞ মহল এ বক্তব্য যেভাবেই নেন না কেন, ফুলবাড়ীর আন্দোলনরত জনগণ যে তাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রীত হয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর সরকারের সামনে নির্বাচনের যে পরীক্ষা হওয়ার কথা, তাতে এ প্রীতি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই কাজ করবে, এতেও সন্দেহ নেই। আর প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বিকেলে মাটি না কাটার যে পরামর্শ সেই বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব দিয়েছিলেন, তা আগেভাগে বোঝার ক্ষমতা যে প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে, তা তাঁর উপরিউক্ত বক্তব্যে প্রমাণিত হয়।
তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? বিশেষজ্ঞ মহল বছরের পর বছর গবেষণা চালায়, তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক সব খতিয়ে দেখে মত দেয় যে কী পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সর্বোত্তম; তারপর তারা লম্বা প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে পেশ করে। কিন্তু কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি যদি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিয়েই নির্ধারিত হয়, তবে কেন এই লোক দেখানো বিশেষজ্ঞ জরিপ? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে একজন পর্যবেক্ষক সম্প্রতি মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের কয়লা একটি রাজনৈতিক ফুটবল, যা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল খেলে চলেছে।
দেশের জ্বালানিসংকট যে কী রকম ভয়াবহ, তা অনেকভাবেই ব্যক্ত করা যায়। গ্যাস চাহিদার তুলনায় মজুদ পর্যাপ্ত নেই, নিজস্ব তেল সম্পদ নেই, নতুন জলবিদ্যুৎ তৈরির বাস্তবসম্মত উপায় নেই, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা সরকার করছে, তা ২০২০ সালের আগে জাতীয় গ্রিডে আনা যাবে না এবং তা চাহিদার তুলনায় আংশিক। সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ২০ হাজার মেগাওয়াট। আর এর মধ্যে অন্তত প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মত দেন একাধিক দেশি-বিদেশি পরামর্শক। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদন করতে হলে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন কয়লা প্রয়োজন হবে। বর্তমানে দেশে একমাত্র ভূগর্ভস্থ কয়লাখনি থেকে বছরে প্রায় এক মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদন করা হয়। সুতরাং, এ সময়ের মধ্যে এই বাড়তি কয়লার জোগান দেওয়া যাবে কীভাবে, তা বড় প্রশ্ন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে দুটি পক্ষ পরস্পরবিরোধী দুটি পদ্ধতির পক্ষে দুটি মেরুতে অবস্থান করছে। এই সর্বাত্মক মেরুকরণের পক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি না যতটুকু, তার চেয়ে রাজনৈতিক উপাদানই বেশি। বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতি (মূলত উর্বর কৃষিজমি, কৃষির ওপর নির্ভরশীল ঘন জনবসতি এবং কয়লাস্তরের ওপর পুরু পানিবাহী নরম বালুস্তরের অবস্থান) যেমন অন্য অনেক দেশের তুলনায় এখানে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করা কঠিন করেছে, একইভাবে দেশের চাহিদার তুলনায় সীমিত জ্বালানি সম্পদের অবস্থান এখানে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি অবলম্বন করার যুক্তিকে সমর্থন জোগায়। এই প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি কেবল জটিলই হয়েছে এবং এর একটি সহজ ও সাধারণ সমাধান বের করা প্রকৃতপক্ষেই দুরূহ বলে অনেকেই মনে করেন। এ ছাড়া কয়লাখনি প্রতিষ্ঠা করার নামে মানুষকে গুলিবিদ্ধ করে মেরে ফেলার ঘটনা (ফুলবাড়ী ২০০৬) কেবল বিষয়টিকে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠার মতোই করে তুলেছে। আর সামগ্রিকভাবে এর ফলে যা হয়েছে, তা হলো কারিগরি, অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো বিষয়কে ছাপিয়ে রাজনৈতিক উপাদানই কয়লা উত্তোলনের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
তাহলে এর সমাধান কী? ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অধ্যাপক মতিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে গঠিত সর্ববিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক সরকারকে দেওয়া খসড়া কয়লানীতির চূড়ান্তকরণ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে কয়লা মজুদগুলোর ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থা বিচার করে, অবস্থান বুঝে সুড়ঙ্গ পদ্ধতি বা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লাখনি স্থাপন করতে হবে, ওই কয়লা রপ্তানি করা যাবে না বরং দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানির জোগান হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, কোলবাংলা নামে কয়লাবিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়লা কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হলে পরিবেশ ও পানি ব্যবস্থাপনাকে নিরাপদ ও সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যার জন্য বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আগে পরীক্ষামূলক ব্যবহারিক উদাহরণ প্রদান করতে হবে, কৃষিজমিকে খনন-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন ও পুনরায় কৃষিযোগ্য করে তুলতে হবে, খনি এলাকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই কেবল উন্মুক্ত খনন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। আর ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক কয়লা খনন সম্পর্কিত যে প্রতিবেদন সরকারকে দেওয়া হয়, তা মূলত উপরিউক্ত সুপারিশগুলোরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় নিজস্ব কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কে দেশের দুটি পক্ষ দুটি মেরুতে অবস্থান করছে, যার প্রকৃতি পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক। এর ফলে কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি কারিগরি, অর্থনৈতিক বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে এ বিষয়কে নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ানোর সুযোগ ও প্রবণতা প্রকট। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে দেশের কয়লা উত্তোলনের সুষ্ঠু ধারা প্রতিষ্ঠিত হবে না। সব রাজনৈতিক দলকে অন্তত একটি বিষয়ে একমত হতে হবে যে দেশের চরম জ্বালানিসংকট থেকে দেশকে রক্ষা করা জনগণকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বদরূল ইমাম, অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.