দুর্ভোগে ঘরমুখো মানুষ গাবতলীতেই ছয় ঘণ্টা by শরীফুল আলম সুমন

প্রতিবছর ঈদে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হলেও এবার চিত্র ভিন্ন। যানজটে বাসের শিডিউল বিপর্যস্ত। ঘরমুখো মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাস টার্মিনালে। কিন্তু বাসের কোনো দেখা নেই। সময়মতো কোনো বাসই ছাড়তে পারছে না টার্মিনাল থেকে।


গতকাল মঙ্গলবার ষাটোর্ধ্ব মো. হাছান আলী পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে টার্মিনালের এক কোনে বসে শুকনো পাউরুটি চিবুচ্ছিলেন। তিনি বলেন, 'ঈগল পরিবহনে খুলনা যাওয়ার জন্য গত ১৯ অক্টোবর অগ্রিম টিকিট কেটেছি। সকাল ১১টায় বাস। ১০টার দিকে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে গাবতলী এসে পৌঁছেছি। এখন আড়াইটা বাজে। যারা ৯টার টিকিট কেটেছিল, তারাই এখনো যেতে পারেনি। শুনেছি, ঘাটেও অনেক যানজট।'
ঈগল পরিবহনের কাউন্টার ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন বলেন, 'আমাদের কী করার আছে? পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটেই সাত থেকে আট ঘণ্টা বাস আটকে থাকছে। আবার আজ (গতকাল) রাস্তা অবরোধের কারণে সাভারে গাড়ি আটকে ছিল দুই ঘণ্টা। আমিনবাজারে গরুর জন্য আরো এক ঘণ্টা। যে গাড়ি ভোর ৪টায় গাবতলী আসার কথা, সেই গাড়ি এসেছে দুপুর ১২টায়। যাত্রীদেরও বলতে পারছি না কখন বাস ছাড়তে পারব।'
মাওয়া-কাওরাকান্দি ফেরিঘাটের একটি ঘাট বিকল, একটিতে কোনো রকমে ছোট গাড়ি পার করা হচ্ছে আর আরেকটি দিয়ে পার হচ্ছে যাত্রীবাহী বাস। ফলে সব মাল ও গরুবাহী ট্রাকই পার হচ্ছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া হয়ে। তাই এ স্থানে প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টার যানজট অবধারিত। গতকাল সাভারের হেমায়েতপুরে হলমার্কের কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করায় এর সঙ্গে আরো দুই ঘণ্টা যানজট যোগ হয়েছে। ফলে যাত্রা শুরুর আগে বাস টার্মিনালেই প্রায় ছয় ঘণ্টা দেরি করতে হচ্ছে। আবার বাস ছেড়ে যাওয়ার পর যানজটসহ নানা কারণে আরো পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে। সে হিসাবে ছয় ঘণ্টার পথে যাত্রীদের জন্য আরো যোগ হচ্ছে দুর্ভোগের ১২ ঘণ্টা।
আমাদের লৌহজং প্রতিনিধি জানান, মাওয়ায় মাত্র দুটি নতুন ঘাটে জোড়াতালি দিয়ে চলছে যানবাহন পারাপার। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় লঞ্চ-টার্মিনাল ফেরিঘাটে যান নামানোর জন্য ছয়টি ফেরি অপেক্ষা করছিল। যান নামিয়ে আবার লোড করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঋষিবাড়ী ফেরিঘাট তেমন কাজে আসছে না। সংযোগ সড়ক অতি সরু হওয়ায় শুধু হালকা ছোট যান পারাপার করা হচ্ছে। কিন্তু এই রুটে বড় যান প্রায় ৯০ শতাংশ। সংকট মোকাবিলায় ঋষিবাড়ী ঘাটের পাশে নতুন আরো একটি ফেরিঘাট তৈরির কাজ গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে। এটি নির্মাণে অন্তত তিন দিন সময় লাগবে। মাওয়ায় ঈদের আগের তিন দিন ও পরের তিন দিন মোট ছয় দিন পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া সব ট্রাক পারাপার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিআইডাবি্লউটিসির ম্যানেজার সিরাজুল হক এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ঋষিবাড়ীর পাশের নতুন ঘাট ঈদের আগের দিন শুক্রবার নাগাদ চালু হতে পারে। এদিকে এ পথেও পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ লাইন পড়েছে। কোরবানির গরুভর্তি ট্রাকও রয়েছে।
যাত্রাবাড়ীর যানজট পার হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা-দাউদকান্দিতেও প্রতিদিনই লাগছে বড় আকারের যানজট। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের যমুনা সেতুর দুই পাশ এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের খণ্ড খণ্ড যানজটও যেন লাগছে সমান তালে। ফলে রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া কোনো বাসই শিডিউল মেলাতে পারছে না। গাবতলীর মতো এসব রুটে যাত্রীদের এত দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে না হলেও দু-তিন ঘণ্টার অপেক্ষা এখন অবধারিত।
আমাদের দাউদকান্দি প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট তৈরি হয় সোমবার ভোর থেকে। তবে দুপুরের দিকে তা কেটে যায়।
গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা গেল মানুষের হতাশা। সকাল সাড়ে ৭টার বাস ছাড়ছে দেড়টায় আর ৯টার বাস ছাড়ছে আড়াইটায়। যেসব পরিবহন কম্পানি অতিরিক্ত ট্রিপের জন্য রিজার্ভ বাস রেখেছিল, তারা সে বাসগুলো দিয়ে কোনো রকম চালিয়ে নিলেও যাদের এ ব্যবস্থা নেই তারা আছে মহাবিপদে। একদিকে যাত্রীদের চাপ অন্যদিকে ব্যবসায়িক ক্ষতি। অনেক কাউন্টার থেকে স্টাফরা যাত্রীদের ভয়ে আশপাশে ঘুরছেন আর বারবার ফোনে বাসের অবস্থান জানছেন।
দুপুর ১টার দিকে হঠাৎই গাবতলীর জেআর পরিবহনের সামনে হট্টগোল শোনা গেল। কিছু যাত্রী ঘিরে ধরেছেন কাউন্টারের লোকজনকে। ইলিয়াস নামের এক যাত্রী বলেন, 'ভাই, আমরা দর্শনা যাব। সকাল সাড়ে ১০টায় বাস ছাড়ার কথা, এখনো দেখা নেই। কাউন্টার থেকে কয়েকবার বলেছে, এই আধা ঘণ্টার ভিতরে চলে আসবে। এ অবস্থায় কি মাথা ঠিক থাকে।'
এসেনশিয়াল ড্রাগসের কর্মী সাবিনা বেগম সকাল ১০টা থেকে অপেক্ষা করছিলেন গাবতলীতে। খুলনার এহসান পরিবহনের দুপুর ৩টার টিকিট কেটেছেন তিনি। এহসান পরিবহনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সকাল ১১টার বাসই এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। এ ছাড়া বরিশাল রুটের সাকুরা পরিবহনের পৌনে ৯টার বাস ছেড়েছে ২টায়। বরগুনার লাবিবা পরিবহনের সাড়ে ৯টার বাস ২টা পর্যন্তও ছাড়া সম্ভব হয়নি।
পরিবহন মালিক ও স্টাফ সূত্রে জানা যায়, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে যানজটের মূল কারণ ট্রাকের অত্যধিক চাপ, মাওয়ায় ঘাট সংকট, ফেরি সংকট ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। আজ থেকে শুক্রবার পর্যন্ত যাত্রীদের চাপ আরো বাড়বে। যাত্রীদের দাবি, ফেরিঘাটে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এ যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
ঈদ উপলক্ষে নিয়মিত ট্রেনের সঙ্গে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতিদিনই ছাড়ছে ১৪টি বিশেষ ট্রেন। ছয়টি চলাচল করছে পূর্বাঞ্চলে এবং আটটি চলাচল করছে পশ্চিমাঞ্চলে। তবে সব ট্রেনেরই স্ট্যান্ডিং টিকিট ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে যাত্রীদের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থায় ঈদ পরবর্তী অগ্রিম টিকিট সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে।
রেল সূত্রে জানা যায়, গত রোজার ঈদের চেয়ে এবারের ঈদে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে। প্রায় ১৩০টি পুরনো বগি ইতিমধ্যে সংস্কার করে যুক্ত করা হয়েছে। ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে কিছু যাত্রী বাসে যাতায়াত করছে। এবার ট্রেন সময়মতো ছেড়ে যাচ্ছে। ফলে স্টেশনে যাত্রীদের ভিড় তেমন দেখা যাচ্ছে না। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. খায়রুল বশীর বলেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.