প্রশাসক যদি হয় ভয়ানক! by জুয়েল মাজহার
অনেক আগে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় পড়েছিলাম: ``তোমার প্রেম সরকারি প্রেসনোটের মতোই মিথ্যা’’। মিথ্যা এবং সরকারি প্রেসনোট দুজনে দু’জনার---এ ধারণা সর্বক্ষেত্রে সত্য না হলেও মানুষ যে এমনটাই মনে করে!
যা কিছুই সরকারি তাতেই মানুষের অবিশ্বাস---এটা এক প্রকার স্বত:সিদ্ধ ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের জবাবটাও কমবেশি সবার জানা। মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের নামে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা বন্ধের জন্য সরকার কোম্পানি আইনে একটা সংশোধন এনেছে। আর তাতেই ঈশান কোনে দেখা দিয়েছে আতংক আর অবিশ্বাসের মেঘ। চলছে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক।
এই সংশোধনের আওতায় সরকার এখন থেকে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। অন্যভাবে বললে, যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে পারবে। আর যাকে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে তিনি ‘’সরল বিশ্বাসে’’ যা খুশি তা-ই করতে পারবেন। তার ভূমিকার কারণে ওই কোম্পানি যদি লাটেও ওঠে বা কাত হয়ে মুখ থুবড়েও পড়ে তাহলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কেননা তিনি যা করবেন তা ‘’সরল বিশ্বাসে ‘’ করবেন বলে ধরে নিতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই গোটা ব্যবসায়িক সমাজ, অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সংশোধিত ধারাটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনসহ (এফবিসিসিআই) দেশের সাতটি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত এ ধারাটিকে ‘অগণতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রণমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে, এই ধারাটিকে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানির কাজে ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া একে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও অভিহিত করেছেন তারা। কেননা এ ধারাবলে নিযুক্ত প্রশাসকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
আর দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনেরাও বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আইনের অপব্যবহারের নজির ভুরিভুরি, সেখানে এমন একটি একচোখা ব্যবস্থা ভয়ানক কুফলই বরং বয়ে আনবে।। নতুন এই ধারাটি সংযোজনের আগে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। বেসরকারি খাতের জন্যে সংশোধিত এই আইন যে রাতারাতি হয়ে উঠতে পারে ‘‘এক কালো আইন’’—এই আশংকা তাই এখন সবার।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বেসরকারি কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে ‘কোম্পানি আইন-২০১২’-এ নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় ‘কোম্পানি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১২’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ডেসটিনি গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের অবর্তমানে সেখানে যাতে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর অধীনে প্রশাসক নিয়োগ করা যায় সেজন্যই এ উদ্যোগ। ওইদিন বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূইঞা প্রেস বিফ্রিংয়ে জানান, ডেসটিনি ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ ব্যবসা ও প্রতারণা করে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে।। এই প্রেক্ষাপটে সরকার সেখানে প্রশাসক নিয়োগের জন্যই কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সরকার কোম্পানি আইনে যে পরিবর্তনটা আনলো তাকে সুচিন্তিত বলা যাবে না। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই এটা করেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে কোনো কথা না বলায় সরকারের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবসায়ীরা এই একতরফা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। এতে তারা ‘‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’’ দেখতে শুরু করেছেন। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রশাসকের চূড়ান্ত দায়মুক্তির বিধান রাখার ব্যাপারটি সরকারের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের সন্দিহান করে তুলেছে। কারণ এদেশের সরকারগুলোর অতীত ভূমিকা বিবেচনায় নিলে স্বীকার করতেই হবে ব্যবসায়ীদের আশংকাটি অমূলক নয়।
আর্থিক অন্যায়-অনিয়ম রোখার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করার পর সেই প্রশাসকই যদি অনিয়ম দুর্নীতির পথে হাঁটেন তখন? বেড়া নিজেই যদি ধান খায়? প্রশ্ন হলো, প্রশাসকের বেলায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা কেন থাকবে না? অর্থাৎ তিনি যা করবেন তা সবই ‘’সরল বিশ্বাসে করেছেন’’ বলে কেন ধরে নিতে হবে? এভাবে কেনই বা তাকে প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে রাখা হবে? সংবিধানের মূল স্পিরিটের বাইরে গিয়ে কেন তাকে এই ইমিউনিটি দেওয়া? একদেশে কেন দু’রকম বিধান? স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঁধে কেন অগণতান্ত্রিক অসাংবিধানিক বিধানের জোয়াল চাপানো?--এরকম হাজার প্রশ্ন এখন সামনে চলে আসছে।
এ মুহুর্তে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ভাবার আছে:
এক. সরকার ইচ্ছে করলেই-- –আর সেই ইচ্ছাটি যদি অশুভ-অসৎ ইচ্ছেও হয়--- যে কোনো স্বাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারবে। এটা করতে গিয়ে সরকারকে কোনো আদালতের অনুমতি নিতে হবে না। সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসক ন্যায় প্রতিষ্ঠার নাম করে যদি নিজেই অন্যায়, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি-অনিয়মের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেন তাহলেও করার কিছু নেই। এসব ঠেকানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকার নিজেই সিদ্ধান্তদাতা, নিজেই শাস্তিদাতা এবং আবার নিজেই বিচারক। অতএব ‘‘কে বা এসে রোখে তারে, কেবা শক্তি ধরে!’’
দুই. সরকার প্রশাসক নিয়োগ করার পর প্রশাসকের ভুল সিদ্ধান্ত, অদক্ষতা, অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচার যে হবে না সে গ্যারান্টি সরকার কি করে দেবে? প্রশাসকের কারণে যদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বড় কোনো আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, তখন? তখনো সরকারকে বা ওই প্রশাসককে দায়ী করা চলবে না। প্রতিকার চাওয়া যাবে না। সরকারকে ‘‘সরল’’ আর প্রশাসককে ‘‘ধোয়া তুলসীপাতা’’ বলেই গণ্য করতে হবে।
তিন. এর মানে, বেসরকারি খাতকে এখন প্রকারান্তরে সরকারের দয়া নিয়েই চলতে হবে; অথবা চলতে হবে সরকারি জুজুর ভয় মাথায় নিয়ে। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা কি করে সম্ভব----যেখানে সম্ভাব্য অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই থাকবে না?
চার. প্রচলিত আইনেই যেখানে প্রতারণামূলক ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে সেখানে প্রশাসককে সকল আইনের ঊর্ধ্বে রাখাই বা কেন? সরকার আসলে কি চায়? আর কেনই বা চায়---এ নিয়ে ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে।
পাঁচ. প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, সরকার কি প্রচলিত আইন অনুযায়ী মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল? প্রচলিত আইনে কোনো সমবায় সমিতির বা সংস্থার কোনো ধরনের ব্যাংকিংয়ে জড়িত হবার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও কিভাবে ডেস্টিনির মতো ‘‘হায় হায় কোম্পানিগুলো’’ বছরের পর বছর ধরে জনগণের সাথে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে?
সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় টু শব্দটিও কেন করেনি এতোদিন? তারা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থেকেছে। কিন্তু ‘‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?`` জনগণের ওপর দিয়ে প্রলয় ঠিকই বয়ে গেছে। ক্ষতি যা হওয়ার তা ষোল আনাই হয়েছে। ডেসটিনির মতো এরকম ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কতোশত মানুষ যে অর্থবিত্ত সবর্স্ব হারিয়ে পথে বসেছেন তার কোনো লেখাজোখা নেই। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং মন্ত্রণালয়--- সবাই সবকিছু দেখে গেছে আর আয়েসে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। সরকারের কুম্ভকর্ণসুলভ সুখনিদ্রাটি যখন ভেঙ্গেছে, তার আগেই হাজার হাজার মানুষের কপাল পুড়ে চারখার। অর্থাৎ ‘‘রোগী মারা যাইবার পর ডাক্তার আসিল’’---সরকার এখন যা করছে তাকে আর কিসের সাথে তুলনা করা যায়?
প্রতারণামূলক ব্যবসা যখন জমজমাট, যখন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় বছরের পর বছর ধরে এসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছিল, তখন কেন সরকার নীরব ছিল? তখন সরকার কি এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো রেগুলেটরি বডি গঠন করেছিল? কিন্তু এতোদিন পর হুট করে `‘যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা’’ কেন অনুভব করলো সরকার? কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ছুতো ধরে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর (বা তার টার্গেট করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর) নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতলব নেই তো সরকারের? ‘‘বদ মতলব নেই’’ বলে সরকার যতোই চেঁচাক, সরকারের কথায় ব্যবসায়ীরা কি আস্থা রাখতে পারবেন?
অবৈধ ব্যবসা বা প্রতারণার দুষ্টচক্রকে শায়েস্তা করা এক কথা, আর সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সব ব্যবসায়ীর সামনে এরকম একটা বিতর্কিত আইনের খড়্গ ঝুলিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ জিইয়ে রাখা অন্য কথা। এটা করে সরকার আগামীদিনের সম্ভাব্য শত অনিয়মের আশংকাকেই জাগিয়ে তুলেছে। সরকার ব্যবসায়ীদের মনে উস্কে দিয়েছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনিরাপত্তাবোধ আর অস্বস্তির কাঁটা। এদেশে অতীত সরকারগুলোর হাতে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের হয়রান হওয়ার যে ভুরি ভুরি নজির, তাতে করে ``ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ`` দেখাটাই স্বাভাবিক।
ধরা যাক, নতুন সরকার এসে তাদের অপছন্দের ও ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসধারী ব্যবসায়ীদের একে একে ‘টাইট দিতে’ চাইল, তখন তাদের কে বাঁচাবে? আদালত? না, আদালতে যাবার পথ তো এই আইনে সিলগালা করে বন্ধ। তাহলে তারা কোথায় যাবেন? হ্যাঁ, তাদের সামনে তখন একটা পথই থাকবে খোলা---ইহুদিদের মতো কোনো ‘বিলাপ-প্রাচীর’ খুঁজে নেওয়া, যেখানে গিয়ে কেবল মাথা কুটে মরা যায় কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যায় না।
ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই, অনিয়ম দূর করতে গিয়ে সম্ভাব্য শত অনিয়মের ফ্লাডগেট খুলে দেওয়া। হতাশা-অবিশ্বাস, আশংকা, উদ্বেগের ``প্যান্ডোরার কৌটা খুলে দেওয়া আর সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া; ---------মানে, আপদ তাড়াতে গিয়ে উল্টো বিপদ ডেকে আনা বুঝি একেই বলে! ``জুতা আবিষ্কার`` নামের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন, ``ধুলাকে করিয়া দিতে দূর/ জগৎ করিল ধুলায় ভরপুর।’’
মানে সরকার চাইলে যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যেনতেনপ্রকারেণ একটা কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠাতে পারবে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান যথার্থ জবাব দিলেও সেটিকে ``অযথার্থ`` বলে রায় দিয়ে বসতে পারে সরকার। কেননা এক্ষেত্রে সরকারের কথাই যে চূড়ান্ত---আর যদি তা অন্যায়ও হয়! মানেটা দাঁড়াচ্ছে, সরকার শত অন্যায় করলেও সরকারের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়া, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। বিচার বিভাগের ভূমিকাকে আর নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে এভাবেই খর্ব করা হয়েছে প্রস্তাবিত এই সংশোধনীতে। কিন্তু কে না জানে, ক্ষমতা যতো নিরঙ্কুশ, ক্ষমতার অপব্যবহারও ততই বেশি----পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাব্সলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি! (``POWER CORRUPTS, ABSOLUTE POWER CORRUPTS ABSOLUTELY``) আর বাংলাদেশের মতো অতি-রাজনীতিদুষ্ট প্রশাসনে ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির তো ভুরিভুরি!
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কোথায় যেন সরকারের একটা আলগা তাড়া আছে। এতোই তাড়া যে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে কথা বলারও প্রয়োজন বোধ করেননি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। যেসব ব্যবসায়ীর সাথে সরকারের লোকদের নিত্যদিন ওঠাবসা আছে বা যারা আদর্শগত দিক থেকে সরকারের নিজের বা কাছের লোক তাদেরও ঘূণাক্ষরে কিছু জানানো হয়নি।
কেন আর কিসের এই তাড়া? বিচার বিভাগের ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে সরকার কেন নিজেই সবকিছুর নিয়ামক হয়ে উঠতে চাইল হঠাৎ? ব্যবসায়ীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব কেন করতে গেল? শেষ সময়ে এসে সরকার তার সব কাজে অস্থিরতা-অসহিষ্ণুতার ছাপ রেখে চলেছে। এই সংশোধিত কোম্পানি আইনটি সরকারের চলার পথে আরো একটি চোখা পেরেক হিসেবেই গাঁথা থাকবে। এটা একদিন সবার পায়েই বিদ্ধ হয়ে রক্ত ঝরাবে। ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের সম্পর্কের মাঝখানে এই জংধরা পুরনো পেরেক বিভেদের প্রতীক হয়েই থাকবে। এরকম পেরেকের সংখ্যা যত কম হবে, জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক যতো খোলামেলা হবে, ততোই মঙ্গল। আর সেটা হলে তো সরকারেরই লাভ। নইলে আজকের তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য আগামী দিনে উল্টো ফলই বয়ে আনবে। নিজের হঠকারি সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত। সুচিন্তিত ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এখনো ঢের সময় সরকারের হাতে আছে। তবে ‘‘সময় গেলে সাধন হবে না।’’
এদেশে সরকার ও রাজনীতিকদের কথা ও কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একতারে বাজে না। তাদের কথা যদি উত্তর মেরু ঘেঁষে চলে, তবে কাজ চলে দক্ষিণ মেরু পানে শনৈ: শনৈ:। আর রাজনীতিতে যেহেতু `‘শেষ কথা বলে কিছু নাই`` সেহেতু আজ সরকার যা বলছে কাল যে তা থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা বা কে দেবে?
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে প্রয়াত সাবেক সোভিয়েত নেতা নিকোলাই ক্রুশ্চেভকে সবাই রাগী বলেই জানতেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে এক পর্যায়ে রেগেমেগে বাঁ পায়ের জুতো খুলে তিনি লেকচার ডেস্কে পেটাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ জাদুঘরে বাঁ-পায়ের সেই একপাটি জুতো নাকি এখনো সযতনে রাখা আছে। যাক সেকথা, ক্রুশ্চেভ কিন্তু বেশ রসিকও ছিলেন। তার অসংখ্য সরস উক্তি আজো ঝানু কূটনীতিকদের মুখে মুখে ফেরে। রাজনীতিকদের লম্বা বুলি কতো লম্বা যে হতে পারে, সেটা তার করা একটি চিরায়ত উক্তি থেকে টের পাওয়া যায়। ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতিকেরা এমন লোক যে, যেখানে কোনো নদী নাই সেখানেও তারা দিব্যি সেতু বানিয়ে ফেলতে পারেন (``politicians are those who can make bridge where there is no river``---kruschev)। আমাদের ভয়টা তো এখানেই। কিন্তু ‘‘ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে’’---এই ভরসাটুকু সরকার ব্যবসায়ীদের দেবে তো, দিতে পারবে তো?
স্বাভাবিকভাবেই গোটা ব্যবসায়িক সমাজ, অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সংশোধিত ধারাটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনসহ (এফবিসিসিআই) দেশের সাতটি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত এ ধারাটিকে ‘অগণতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রণমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে, এই ধারাটিকে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানির কাজে ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া একে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও অভিহিত করেছেন তারা। কেননা এ ধারাবলে নিযুক্ত প্রশাসকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
আর দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনেরাও বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আইনের অপব্যবহারের নজির ভুরিভুরি, সেখানে এমন একটি একচোখা ব্যবস্থা ভয়ানক কুফলই বরং বয়ে আনবে।। নতুন এই ধারাটি সংযোজনের আগে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। বেসরকারি খাতের জন্যে সংশোধিত এই আইন যে রাতারাতি হয়ে উঠতে পারে ‘‘এক কালো আইন’’—এই আশংকা তাই এখন সবার।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বেসরকারি কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে ‘কোম্পানি আইন-২০১২’-এ নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় ‘কোম্পানি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১২’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ডেসটিনি গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের অবর্তমানে সেখানে যাতে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর অধীনে প্রশাসক নিয়োগ করা যায় সেজন্যই এ উদ্যোগ। ওইদিন বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূইঞা প্রেস বিফ্রিংয়ে জানান, ডেসটিনি ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ ব্যবসা ও প্রতারণা করে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে।। এই প্রেক্ষাপটে সরকার সেখানে প্রশাসক নিয়োগের জন্যই কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সরকার কোম্পানি আইনে যে পরিবর্তনটা আনলো তাকে সুচিন্তিত বলা যাবে না। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই এটা করেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে কোনো কথা না বলায় সরকারের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবসায়ীরা এই একতরফা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। এতে তারা ‘‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’’ দেখতে শুরু করেছেন। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রশাসকের চূড়ান্ত দায়মুক্তির বিধান রাখার ব্যাপারটি সরকারের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের সন্দিহান করে তুলেছে। কারণ এদেশের সরকারগুলোর অতীত ভূমিকা বিবেচনায় নিলে স্বীকার করতেই হবে ব্যবসায়ীদের আশংকাটি অমূলক নয়।
আর্থিক অন্যায়-অনিয়ম রোখার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করার পর সেই প্রশাসকই যদি অনিয়ম দুর্নীতির পথে হাঁটেন তখন? বেড়া নিজেই যদি ধান খায়? প্রশ্ন হলো, প্রশাসকের বেলায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা কেন থাকবে না? অর্থাৎ তিনি যা করবেন তা সবই ‘’সরল বিশ্বাসে করেছেন’’ বলে কেন ধরে নিতে হবে? এভাবে কেনই বা তাকে প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে রাখা হবে? সংবিধানের মূল স্পিরিটের বাইরে গিয়ে কেন তাকে এই ইমিউনিটি দেওয়া? একদেশে কেন দু’রকম বিধান? স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঁধে কেন অগণতান্ত্রিক অসাংবিধানিক বিধানের জোয়াল চাপানো?--এরকম হাজার প্রশ্ন এখন সামনে চলে আসছে।
এ মুহুর্তে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ভাবার আছে:
এক. সরকার ইচ্ছে করলেই-- –আর সেই ইচ্ছাটি যদি অশুভ-অসৎ ইচ্ছেও হয়--- যে কোনো স্বাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারবে। এটা করতে গিয়ে সরকারকে কোনো আদালতের অনুমতি নিতে হবে না। সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসক ন্যায় প্রতিষ্ঠার নাম করে যদি নিজেই অন্যায়, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি-অনিয়মের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেন তাহলেও করার কিছু নেই। এসব ঠেকানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। অর্থাৎ সরকার নিজেই সিদ্ধান্তদাতা, নিজেই শাস্তিদাতা এবং আবার নিজেই বিচারক। অতএব ‘‘কে বা এসে রোখে তারে, কেবা শক্তি ধরে!’’
দুই. সরকার প্রশাসক নিয়োগ করার পর প্রশাসকের ভুল সিদ্ধান্ত, অদক্ষতা, অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচার যে হবে না সে গ্যারান্টি সরকার কি করে দেবে? প্রশাসকের কারণে যদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বড় কোনো আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, তখন? তখনো সরকারকে বা ওই প্রশাসককে দায়ী করা চলবে না। প্রতিকার চাওয়া যাবে না। সরকারকে ‘‘সরল’’ আর প্রশাসককে ‘‘ধোয়া তুলসীপাতা’’ বলেই গণ্য করতে হবে।
তিন. এর মানে, বেসরকারি খাতকে এখন প্রকারান্তরে সরকারের দয়া নিয়েই চলতে হবে; অথবা চলতে হবে সরকারি জুজুর ভয় মাথায় নিয়ে। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা কি করে সম্ভব----যেখানে সম্ভাব্য অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই থাকবে না?
চার. প্রচলিত আইনেই যেখানে প্রতারণামূলক ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে সেখানে প্রশাসককে সকল আইনের ঊর্ধ্বে রাখাই বা কেন? সরকার আসলে কি চায়? আর কেনই বা চায়---এ নিয়ে ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে।
পাঁচ. প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, সরকার কি প্রচলিত আইন অনুযায়ী মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল? প্রচলিত আইনে কোনো সমবায় সমিতির বা সংস্থার কোনো ধরনের ব্যাংকিংয়ে জড়িত হবার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও কিভাবে ডেস্টিনির মতো ‘‘হায় হায় কোম্পানিগুলো’’ বছরের পর বছর ধরে জনগণের সাথে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে?
সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় টু শব্দটিও কেন করেনি এতোদিন? তারা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থেকেছে। কিন্তু ‘‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?`` জনগণের ওপর দিয়ে প্রলয় ঠিকই বয়ে গেছে। ক্ষতি যা হওয়ার তা ষোল আনাই হয়েছে। ডেসটিনির মতো এরকম ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কতোশত মানুষ যে অর্থবিত্ত সবর্স্ব হারিয়ে পথে বসেছেন তার কোনো লেখাজোখা নেই। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং মন্ত্রণালয়--- সবাই সবকিছু দেখে গেছে আর আয়েসে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। সরকারের কুম্ভকর্ণসুলভ সুখনিদ্রাটি যখন ভেঙ্গেছে, তার আগেই হাজার হাজার মানুষের কপাল পুড়ে চারখার। অর্থাৎ ‘‘রোগী মারা যাইবার পর ডাক্তার আসিল’’---সরকার এখন যা করছে তাকে আর কিসের সাথে তুলনা করা যায়?
প্রতারণামূলক ব্যবসা যখন জমজমাট, যখন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় বছরের পর বছর ধরে এসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছিল, তখন কেন সরকার নীরব ছিল? তখন সরকার কি এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো রেগুলেটরি বডি গঠন করেছিল? কিন্তু এতোদিন পর হুট করে `‘যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা’’ কেন অনুভব করলো সরকার? কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ছুতো ধরে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর (বা তার টার্গেট করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর) নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতলব নেই তো সরকারের? ‘‘বদ মতলব নেই’’ বলে সরকার যতোই চেঁচাক, সরকারের কথায় ব্যবসায়ীরা কি আস্থা রাখতে পারবেন?
অবৈধ ব্যবসা বা প্রতারণার দুষ্টচক্রকে শায়েস্তা করা এক কথা, আর সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সব ব্যবসায়ীর সামনে এরকম একটা বিতর্কিত আইনের খড়্গ ঝুলিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ জিইয়ে রাখা অন্য কথা। এটা করে সরকার আগামীদিনের সম্ভাব্য শত অনিয়মের আশংকাকেই জাগিয়ে তুলেছে। সরকার ব্যবসায়ীদের মনে উস্কে দিয়েছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনিরাপত্তাবোধ আর অস্বস্তির কাঁটা। এদেশে অতীত সরকারগুলোর হাতে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের হয়রান হওয়ার যে ভুরি ভুরি নজির, তাতে করে ``ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ`` দেখাটাই স্বাভাবিক।
ধরা যাক, নতুন সরকার এসে তাদের অপছন্দের ও ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসধারী ব্যবসায়ীদের একে একে ‘টাইট দিতে’ চাইল, তখন তাদের কে বাঁচাবে? আদালত? না, আদালতে যাবার পথ তো এই আইনে সিলগালা করে বন্ধ। তাহলে তারা কোথায় যাবেন? হ্যাঁ, তাদের সামনে তখন একটা পথই থাকবে খোলা---ইহুদিদের মতো কোনো ‘বিলাপ-প্রাচীর’ খুঁজে নেওয়া, যেখানে গিয়ে কেবল মাথা কুটে মরা যায় কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যায় না।
ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই, অনিয়ম দূর করতে গিয়ে সম্ভাব্য শত অনিয়মের ফ্লাডগেট খুলে দেওয়া। হতাশা-অবিশ্বাস, আশংকা, উদ্বেগের ``প্যান্ডোরার কৌটা খুলে দেওয়া আর সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া; ---------মানে, আপদ তাড়াতে গিয়ে উল্টো বিপদ ডেকে আনা বুঝি একেই বলে! ``জুতা আবিষ্কার`` নামের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন, ``ধুলাকে করিয়া দিতে দূর/ জগৎ করিল ধুলায় ভরপুর।’’
মানে সরকার চাইলে যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যেনতেনপ্রকারেণ একটা কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠাতে পারবে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান যথার্থ জবাব দিলেও সেটিকে ``অযথার্থ`` বলে রায় দিয়ে বসতে পারে সরকার। কেননা এক্ষেত্রে সরকারের কথাই যে চূড়ান্ত---আর যদি তা অন্যায়ও হয়! মানেটা দাঁড়াচ্ছে, সরকার শত অন্যায় করলেও সরকারের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়া, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না। বিচার বিভাগের ভূমিকাকে আর নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে এভাবেই খর্ব করা হয়েছে প্রস্তাবিত এই সংশোধনীতে। কিন্তু কে না জানে, ক্ষমতা যতো নিরঙ্কুশ, ক্ষমতার অপব্যবহারও ততই বেশি----পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাব্সলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি! (``POWER CORRUPTS, ABSOLUTE POWER CORRUPTS ABSOLUTELY``) আর বাংলাদেশের মতো অতি-রাজনীতিদুষ্ট প্রশাসনে ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির তো ভুরিভুরি!
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কোথায় যেন সরকারের একটা আলগা তাড়া আছে। এতোই তাড়া যে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে কথা বলারও প্রয়োজন বোধ করেননি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। যেসব ব্যবসায়ীর সাথে সরকারের লোকদের নিত্যদিন ওঠাবসা আছে বা যারা আদর্শগত দিক থেকে সরকারের নিজের বা কাছের লোক তাদেরও ঘূণাক্ষরে কিছু জানানো হয়নি।
কেন আর কিসের এই তাড়া? বিচার বিভাগের ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে সরকার কেন নিজেই সবকিছুর নিয়ামক হয়ে উঠতে চাইল হঠাৎ? ব্যবসায়ীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব কেন করতে গেল? শেষ সময়ে এসে সরকার তার সব কাজে অস্থিরতা-অসহিষ্ণুতার ছাপ রেখে চলেছে। এই সংশোধিত কোম্পানি আইনটি সরকারের চলার পথে আরো একটি চোখা পেরেক হিসেবেই গাঁথা থাকবে। এটা একদিন সবার পায়েই বিদ্ধ হয়ে রক্ত ঝরাবে। ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের সম্পর্কের মাঝখানে এই জংধরা পুরনো পেরেক বিভেদের প্রতীক হয়েই থাকবে। এরকম পেরেকের সংখ্যা যত কম হবে, জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক যতো খোলামেলা হবে, ততোই মঙ্গল। আর সেটা হলে তো সরকারেরই লাভ। নইলে আজকের তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য আগামী দিনে উল্টো ফলই বয়ে আনবে। নিজের হঠকারি সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত। সুচিন্তিত ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এখনো ঢের সময় সরকারের হাতে আছে। তবে ‘‘সময় গেলে সাধন হবে না।’’
এদেশে সরকার ও রাজনীতিকদের কথা ও কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একতারে বাজে না। তাদের কথা যদি উত্তর মেরু ঘেঁষে চলে, তবে কাজ চলে দক্ষিণ মেরু পানে শনৈ: শনৈ:। আর রাজনীতিতে যেহেতু `‘শেষ কথা বলে কিছু নাই`` সেহেতু আজ সরকার যা বলছে কাল যে তা থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা বা কে দেবে?
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে প্রয়াত সাবেক সোভিয়েত নেতা নিকোলাই ক্রুশ্চেভকে সবাই রাগী বলেই জানতেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে এক পর্যায়ে রেগেমেগে বাঁ পায়ের জুতো খুলে তিনি লেকচার ডেস্কে পেটাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ জাদুঘরে বাঁ-পায়ের সেই একপাটি জুতো নাকি এখনো সযতনে রাখা আছে। যাক সেকথা, ক্রুশ্চেভ কিন্তু বেশ রসিকও ছিলেন। তার অসংখ্য সরস উক্তি আজো ঝানু কূটনীতিকদের মুখে মুখে ফেরে। রাজনীতিকদের লম্বা বুলি কতো লম্বা যে হতে পারে, সেটা তার করা একটি চিরায়ত উক্তি থেকে টের পাওয়া যায়। ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতিকেরা এমন লোক যে, যেখানে কোনো নদী নাই সেখানেও তারা দিব্যি সেতু বানিয়ে ফেলতে পারেন (``politicians are those who can make bridge where there is no river``---kruschev)। আমাদের ভয়টা তো এখানেই। কিন্তু ‘‘ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে’’---এই ভরসাটুকু সরকার ব্যবসায়ীদের দেবে তো, দিতে পারবে তো?
No comments