সরল গরল- আজমকে দুদকের তলব প্রশ্নবিদ্ধ by মিজানুর রহমান খান
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম খানের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা অগ্রহণযোগ্য বললে কম বলা হবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন।
গাড়িচালক আজমকে খাটো করে বক্তব্য রেখে গোলাম রহমান বিপাকে পড়েছেন। এটি নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিটও শুনানির অপেক্ষায়। ওই বক্তব্য মুখ ফসকে বেরুতে পারে। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে আজম খানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার কথা মুখ ফুটে বলে দুদক গুরুতর অসদাচরণ করেছে কি না, সেটা বিচার্য।
আজম খান গত রোববার দুদকে না এসে ভুল করেছেন বলে তো মনে হয় না। কারণ, আরটিভি-কাণ্ডের পর থেকে দুদকের অবস্থান অধিকতর পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এখন দুদক আজম খানের বক্তব্য তাঁর সুবিধাজনক স্থানে নিতে চায়। তাঁকে নিরাপত্তাও দিতে চায়। দুদকের এই অবস্থান আগের চেয়ে উত্তম। কিন্তু আইনগত দিক থেকে গলদপূর্ণ, এমনকি তাদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় তা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, সেই প্রশ্নটাও তুলতে পারি।
২০০৪ সালের দুদক আইনের ১৯ নম্বর ধারায় রয়েছে, ‘সাক্ষীর সমন জারি ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শপথের মাধ্যমে সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। কমিশন যেকোনো ব্যক্তিকে তথ্য দিতে নির্দেশ দিতে পারবে। ব্যক্তি তা দিতে বাধ্য থাকবে। দুদককে এ কাজে বাধাদান বা তার নির্দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করা চলবে না। করলে তাকে অনধিক তিন বছরের জেলের ভাত খেতে হবে।’
তবে আজম খান আর ওই ১৯ ধারার অধীনে একজন সাক্ষী নন। ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের আগে তা তিনি ছিলেন বটে। তাঁকে সাক্ষী করতে আমরা গোড়াতেই দাবি তুলেছিলাম। এর আগে তাঁকে নামকাওয়াস্তে একটি নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি যখন স্বেচ্ছায় আরটিভিতে বক্তব্য দিলেন, তখন দুদকের হঠাৎ ঘুম ভাঙল।
আজম খানের ক্ষেত্রে এখন ২০১১ সালের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনটি (হুইসেল ব্লোয়ার অ্যাক্ট) প্রযোজ্য। তাঁর বর্তমান পরিচয় তিনি একজন ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারী’। এর অর্থ এই নয় যে টাকাবোঝাই গাড়ি, যাবে রেলমন্ত্রীর বাড়ি—তাঁর এহেন ছড়াকাটাকে আমরা সত্য হিসেবে ধরে নিচ্ছি।
তবে ২০১১ সালের কাগজি আইনটির একটি আলোচিত প্রয়োগ ঘটালেন আজম খান। বাংলাদেশের প্রথম সাহসী তথ্য প্রকাশকারী কে—এই প্রশ্ন তুললে সম্ভবত আজম খানকে স্মরণ করতে হবে।
ওই আইনের ৪ ধারার শর্ত পূরণ করেছেন গাড়িচালক আজম। এতে বলা আছে, কেউ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করেছেন বলে গণ্য হবে যদি যুক্তিসংগত কারণে তিনি বিশ্বাস করেন যে তথ্যটি সত্য।
টাকাবাহী গাড়ি সে রাতে যাচ্ছিল মন্ত্রীর বাড়ি, এটা আজম খান যদি না-ও বলতেন, তাহলেও যুক্তিসংগত কারণ ছিল তা বিশ্বাস করার। এমনকি আইন বলছে ‘তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ না থাকলেও তিনি এরূপ বিশ্বাস করেন যে তথ্যটি সত্য হতে পারে।’ আজম ভুলও বলতে পারেন। আইন দুদককে বলছে, ‘তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে তার সত্যতা যাচাই করা সমীচীন।’ অথচ দুদক ইচ্ছাকৃতভাবে এই আইনের শর্ত লঙ্ঘন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আজমকে দুদকে তলব করা, মোবাইলে কথা বলা বা তথাকথিত কোনো সুবিধাজনক স্থানে বক্তব্য দিতে বাধ্য করার কোনো সুযোগ এই আইনে নেই। বরং তা নিষিদ্ধ করা আছে।
হুইসেল ব্লোয়ার আইনের ৪ নম্বর ধারার ৩ উপধারা বলছে ‘কোনো তথ্য দুদকের কাছে লিখিতভাবে সরাসরি, হাতেহাতে, ডাকযোগে বা যেকোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা যাবে।’ সুতরাং আজম খানকে গত রোববার দুদকে না পেয়ে যেভাবে বলা হচ্ছে তাঁকে তিন বছরের জেল খাটানো হবে, সেটা প্রকারান্তরে তথ্য প্রকাশকারী নাগরিকের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে তুল্য।
আজম খানের ওপর দুদকের জবরদস্তি বেআইনি ও অসাংবিধানিক। আইন বলছে ‘কোনো তথ্য প্রকাশকারীকে কোনো তদন্তে সহায়তা করতে বাধ্য করা যাবে না। যার ফলে তার জীবন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বা তিনি ভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।’ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের পক্ষে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কালিমা লেপনের চেয়ে পদ্মা সেতুকেই পদ্মায় ফেলা অসম্ভব নয়। তাই একজন অচ্ছুত ‘চাপরাশি’ মার্কা আজম খানকে ‘ভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা’ তো কোনো ব্যাপারই নয়।
সুতরাং আজম খানকে ঘিরে দুদকের হম্বিতম্বি বন্ধ হোক। প্রতিবেশী ভারতের ভোপালে সেহলা মাসুদ নামের এক নারী স্থানীয় রাজনীতিকের টেন্ডারবাজির তথ্য প্রকাশ করে গুলিতে নিহত হয়েছেন। বিজনেস উইক (২০ অক্টোবর ২০১১) বলেছে, মিস সেহলা ১২তম ব্যক্তি, যিনি তথ্য প্রকাশ করে নিহত হলেন।
আমরা জানি না, দুদক আজম খানকে মহারাষ্ট্রের প্রধান প্রকৌশলী বিজয় পান্ডের ভাগ্য বরণ করায় কি না। ওই রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার হলেন ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেসের নেতা। সেচ খাতে দলীয় গুন্ডাপান্ডাদের টেন্ডার বিলিয়ে সরকারের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লোকসান করানোর কলঙ্ক নিয়ে গত মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। এটা সম্ভব হয়েছিল উক্ত বিজয় পান্ডে সরকারের কাছে ১৫ পৃষ্ঠার একটি চিঠিতে সেচ কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেছিলেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ দ্য হিন্দু লিখেছে, কংগ্রেস এখন দাবি করেছে, তথ্য প্রকাশকারী ওই পান্ডে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ ছিলেন।
দুদককে একটি ফাউ আইনি পরামর্শ দিই। আজম খান মিথ্যা তথ্য দিলে তিন বছর কেন, তাঁকে পাঁচ বছর জেলের ভাত খাওয়ানোর মওকা তারা ছাড়বে কোন দুঃখে? দুদক আইনমতে ওই তিন বছর আবার বিনাশ্রমের। পাঁচ বছর হলে হবে সশ্রম। সে জন্য যেটা করতে হবে তা হলো, রেলগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে আদালতে একটি আনুষ্ঠানিক মামলা ঠুকতে হবে। রমনা থানায় এ পর্যন্ত একটা এজাহার হয়েছে মাত্র। আদালতে শুনানিতে যাচাই হবে আজমের দাবি সত্য না বানোয়াট।
হুইসেল ব্লোয়ার আইন সাফ বলেছে, ‘কোনো মামলা শুনানিকালে আদালতের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে তথ্য প্রকাশকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করেছেন তাহলে তার অন্যূন দুই বছর বা অনধিক পাঁচ বছর সশ্রম কারাবাস হবে।’
সুতরাং দুদকের উচিত হবে বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করা। আজম খানকে পাঁচ বছরের সশ্রম জেল খাটানোর বন্দোবস্ত করতে দ্রুত রেলগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে আদালতে মামলা ঠোকা। তবে পুরস্কার না দিতে পারেন, দেখবেন শুনানির আগে তাঁকে পাগল সাজাবেন না যেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mৎkhanbd@gmail.com
No comments