যাওয়া তো নয় যাওয়া by ইমদাদুল হক মিলন

তেইশ দিন আগে সুনীলদার সঙ্গে দেখা হলো কলকাতায়। সুরমা চৌধুরী স্মৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পুরস্কারটি পেয়েছেন আরো পাঁচজন লেখক- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রফুল্ল রায়, সেলিনা হোসেন, সমরেশ মজুমদার এবং আমি আমার 'নূরজাহান' উপন্যাসের জন্য।


হলভর্তি লোকজন। সুনীলদা সামনের সারিতে বসে আছেন, পাশে স্বাতীদি। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীলদার স্ত্রী। সুনীলদার শরীর একটু ভেঙেছে। সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছেন। আমাকে দেখে সেই আগের মতোই স্নেহভরা গলায় বললেন, কেমন আছ, মিলন?
সুনীলদার মুখের দিকে তাকিয়ে একবারও মনে হয়নি, ও-ই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। ও-ই তাঁর সঙ্গে শেষ কথা।
আমাদের এ বছরটা এত কষ্টের কেন? হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন। এভাবে একই বছরে বাংলা সাহিত্যের দুই কিংবদন্তির বিদায়, এই বেদনা আমরা কোথায় রাখি! এত বড় বড় ধাক্কা হৃদয় সামাল দেয় কী করে!
সুনীলদার চলে যাওয়ার খবর পেয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। তারপর পায়চারি করতে লাগলাম। তীব্র অস্থিরতা বুকে। কাকে ফোন করি, কার সঙ্গে কথা বলি! কষ্টটা আমি নিতে পারছি না। কারো না কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারো না কারো সঙ্গে ভাগ করতে হবে বেদনা।
কলকাতায় সমরেশ মজুমদারকে ফোন করলাম। অতি কষ্টে কান্না চেপে কিছুক্ষণ কথা বললাম দুজনে। সমরেশদা বললেন, ফোন করে ভালো করেছ। আমিও ঘরের ভেতর পায়চারি করছি। তোমার সঙ্গে কথা বলে হালকা লাগছে।
তার পরও আমার অস্থিরতা কমে না। একবার বিছানায় শুই, পায়চারি করি। আর ফাঁকে ফাঁকে কত কথা যে মনে পড়ে! সুনীলদার সঙ্গে কত দিনকার কত স্মৃতি! চোখের অনেক ভেতর থেকে দেখতে পাই সেই সব দিন, সেই সব উত্তাল রাত।
সুনীলদাকে প্রথম দেখেছিলাম চুয়াত্তর সালে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার লেখকরা এসেছিলেন ঢাকায়। বাংলা একাডেমীর মঞ্চে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালবেলায় কবিতাপাঠের আসর। সভাপতিত্ব করছেন বেগম সুফিয়া কামাল। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চমট্টাপাধ্যায়- আরো কেউ কেউ।
তখনো বইমেলা তেমন জমজমাট হয়নি। অল্প কয়েকটা স্টল হয়। প্রকাশক আজকের মতো এত হয়নি দেশে। মেলাটা বোধ হয় এক দিনের জন্যই হতো। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির দিন। কিন্তু কবিতার আসরটি খুবই জমজমাট হতো। কবিদের স্বকণ্ঠে কবিতা শোনার জন্য হাজার হাজার লোক।
আমরা কয়েক বন্ধু গেণ্ডারিয়া থেকে গেছি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়লেন, 'অবনী বাড়ি আছো' কবিতাটি। সঙ্গে আরো দু-একটি কবিতা। সুনীলদা প্রথমে কী একটা কবিতা পড়লেন। তাঁর পরনে প্রিন্টের হাফহাতা শার্ট। একটু ভারীর দিকে শরীর। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। গোলগাল মুখে আলো ঝলমল করছে। কবিতাপাঠ শেষ করে বসে পড়বেন, বেগম সুফিয়া কামাল অনুরোধ করলেন 'কেউ কথা রাখেনি' কবিতাটি পড়ার জন্য। সুনীলদা আবার দাঁড়ালেন, তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে পাঠ করলেন 'তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি'। কবিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল করতালি।
আমি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখলাম। সেদিন কল্পনাও করিনি, এই মহান লেখকের সঙ্গে আমার একদিন পরিচয় হবে। তিনি আমাকে বই উৎসর্গ করবেন। তাঁর সঙ্গে এক রুমে থাকা হবে, নিউ ইয়র্কের লস অ্যাঞ্জেলেসে দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটাব। আমার মতো এক নগণ্য লেখক জায়গা করে নেবে তাঁর বহু লেখায়। আমাকে তিনি ভালোবাসবেন, বন্ধু ভাববেন!
কোনো কোনো বাস্তবতা স্বপ্ন ছাড়িয়ে যায়।
সুনীলদার সঙ্গে পরিচয় হলো আটাত্তর সালে। গাজী শাহাবুদ্দিন, আমাদের মনু ভাই, 'সচিত্র সন্ধানী' নামে পত্রিকা করতেন। 'সন্ধানী' প্রকাশনী থেকে অসাধারণ সব বই প্রকাশিত হতো। মনু ভাইয়ের সঙ্গে সুনীলদার গভীর বন্ধুত্ব। আর 'সচিত্র সন্ধানী'র সম্পাদক বেলাল চৌধুরী। বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে সুনীলদার বন্ধুত্ব সর্বজনবিদিত। বেলাল ভাই বহু বহু বছর সুনীলদাদের সঙ্গে কলকাতায় কাটিয়েছেন। 'কৃত্তিবাস' প্রকাশ করতেন। তাঁদের সেই উত্তাল জীবনস্মৃতির কথা টুকরো-টাকরাভাবে পড়ে আমরা উদ্বেলিত হয়েছি। সুনীলদা তত দিনে বাংলাভাষী পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছেন। কবিতা গল্প উপন্যাস কিশোর সাহিত্য ভ্রমণকাহিনী নাটক প্রবন্ধ দুহাতে লিখছেন। 'জীবন যে রকম', 'একা এবং কয়েকজন', তারও আগে প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ', দ্বিতীয় উপন্যাস 'অরণ্যের দিনরাত্রি' আমরা পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। আমাদের পুরো প্রজন্ম আচ্ছন্ন করে ফেললেন সুনীলদা। আমাদের পরের প্রজন্মেরও একই অবস্থা। 'সন্তু ও কাকাবাবু' বাঙালি কিশোর পাঠককে মায়াজালে আবদ্ধ করল। 'নীললোহিত' মুগ্ধ করল কলেজ-ইউনিভার্সিটিপড়া ছেলেমেয়েদের। 'সেই সময়', 'পূর্ব পশ্চিম', 'প্রথম আলো' মুগ্ধ করল মনস্ক পাঠককে। একই হাতে কত রকমের লেখা একজন লেখক লিখতে পারেন তার বড় উদাহরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কলকাতায় সুনীলদাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। মৈত্রী ট্রেন উদ্বোধন উপলক্ষে 'আনন্দবাজার' পত্রিকার অতিথি হয়ে কলকাতায় গেছি। সেই অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানাল আমার বন্ধু কবি সুবোধ সরকার। আমি সুনীলদার সম্পর্কে প্রথমেই বললাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন লেখক লেখেন, এ কথা আমার বিশ্বাসই হয় না। আমার মনে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে বেশ কয়েকজন লেখক লেখেন। কারণ একজন লেখক যে হাতে 'সন্তু ও কাকাবাবু' লেখেন, সেই লেখক কেমন করে লেখেন 'অর্জুন'! যে লেখক 'আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি' লেখেন, তিনি কী করে লেখেন 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'! আর তাঁর সেই সব কালজয়ী উপন্যাস 'সেই সময়', 'পূর্ব পশ্চিম' আর 'প্রথম আলো'।
আটাত্তর সালের কথা বলতে বলতে কত দূর চলে গিয়েছিলাম।
'সচিত্র সন্ধানী' নতুন করে বেরোবে। সুনীলদা আসছেন ঢাকায়। ইত্তেফাক ভবন থেকে 'রোববার' নামে একটি সাপ্তাহিক বেরোবে। আমি সেই কাগজে জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি। জীবনের প্রথম চাকরি। রফিক আজাদ নির্বাহী সম্পাদক। সুনীলদার সঙ্গে সেবার 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষও ঢাকায় এসেছেন। 'রোববার' থেকে পার্টি দেওয়া হলো ঢাকা ক্লাবে। সেখানেই সুনীলদার সঙ্গে পরিচয়।
তারপর দিনে দিনে কোথায় গিয়ে পৌঁছাল সেই পরিচয়। কলকাতায় গেলে তাঁর বাড়িতে যাই। 'দেশ' পত্রিকার অফিসে গিয়ে দেখা করি। আর নানা রকম আড্ডার জায়গা তো আছেই। কী প্রাণবন্ত সেই সব জায়গা! সুনীলদা সারা দিন লেখেন, সন্ধ্যার পর থেকে বসেন আড্ডায়। দরাজ গলায় গান করেন। 'তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা, হিথায় তোরে মানাইছে না গো, ইক্কেবারে মানাইছে না গো'।
ঢাকায় এলেও একই অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে আড্ডা হতো। হুমায়ূন ভাইকে খুবই ভালোবাসতেন তিনি। সে-ই কবে, 'দেশ' পত্রিকায় 'সনাতন পাঠক' নামে হুমায়ূন ভাইয়ের 'নন্দিত নরকে' নিয়ে লিখেছিলেন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলা সাহিত্যের দুই কিংবদন্তি চলে গেলেন। প্রথমে হুমায়ূন আহমেদ, তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমরা অসহায় হয়ে গেলাম।
ছিয়ানব্বইয়ের ইলেকশনে বিদেশি অবজারভাররা এলেন বাংলাদেশের ইলেকশন দেখতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এলেন। তাঁর সঙ্গে আমাকে যুক্ত করা হলো বাংলাদেশ থেকে। একজন সরকারি কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন বরিশাল অঞ্চলে। দু-একটি ভোটকেন্দ্র দেখার পর সুনীলদা আমাকে বললেন, অনেক হয়েছে। এবার চলো জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদীটা দেখে আসি।
আশ্চর্য ব্যাপার, ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধান কেউ দিতেই পারে না।
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল নদীটি। খালের মতো সরু, দুপাশে গাছপালাঘেরা ছবির মতো নদী। আমরা নৌকা নিয়ে দু-তিন ঘণ্টা ধানসিঁড়িতে ঘুরলাম। সুনীলদাকে দেখি কী রকম উদাস হয়ে আছেন। পরে কলকাতায় ফিরে গিয়ে 'দেশ' পত্রিকায় তিনি লিখলেন, 'ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে'।
কী অপূর্ব লেখা!
সুনীলদা, আপনি চলে গেলেন, ও রকম লেখা এখন আর কে লিখবে!
'যদি নির্বাসন দাও' কবিতায় আপনি লিখেছিলেন, '...বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ.../এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি/যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো/আমি বিষপান করে মরে যাবো'।
কোন জগতে নির্বাসনে গেলেন, সুনীলদা! আপনার যাওয়া কি সত্যি যাওয়া! আপনার মতো লেখক কি সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারে!
না, পারে না। ওই তো আপনি রয়ে গেছেন বাঙালি পাঠকের বুকশেলফজুড়ে। ওই তো আপনি রয়ে গেছেন সত্যজিৎ আর গৌতম ঘোষের সিনেমায়। ওই তো আপনি রয়ে গেছেন বাঙালির মুখে মুখে আর তাদের হৃদয়ে। বাঙালি জাতি যত দিন আছে, ঠিক তত দিনই আপনি আছেন তাদের সঙ্গে। আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আপনার লেখার সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হবে। আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি!

No comments

Powered by Blogger.