মোহাম্মদ শাহজাহান স্মরণে by আবু সাঈদ খান
নায়কোচিত চেহারা, জলদগম্ভীর কণ্ঠ, পরিপাটি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মোহাম্মদ শাহজাহানকে প্রথম দর্শনে শ্রমিক নেতা ভাবা যেত না। কিন্তু তার ছিল মেহনতি মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রমদরদি মন; এ গুণই তাকে দিয়েছিল দেশের জনপ্রিয় শ্রমিক নেতার সম্মান।
ছাত্রাবস্থায় তিনি চুয়াডাঙ্গায় গড়ে তুলেছিলেন রিকশা শ্রমিক ও হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন। তার আকর্ষণ ছিল নাটকে। পঞ্চাশের দশকে চুয়াডাঙ্গায় ডিএল রায়ের শাজাহানসহ বেশ কয়েকটি নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তখন চুয়াডাঙ্গার শ্রীমন্ত টাউন হলে সব সংস্কৃতিকর্মীর প্রবেশাধিকার ছিল না। এটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়া কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাস করেন। যোগ দেন শিক্ষকতায়। এ সময়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার আবুল হোসেন মেমোরিয়াল লাইব্রেরি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং লাইব্রেরির অনারারি লাইব্রেরিয়ানও হন। বই-প্রেম তাকে নতুন পথ দেখায়। ষাটের দশকে লাইব্রেরি সায়েন্স পড়তে তিনি ঢাকায় এলেন। শুরু হয় রাজধানীতে টিকে থাকার সংগ্রাম।
ঢাকা তখন উত্তাল। শ্রমিক আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন এক রেখায় মিলেছে, সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করার কারিগর সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৭০ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ। মোহাম্মদ শাহজাহান জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বাংলা ও ইংরেজিতে চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন তিনি। লন্ডনের হাইড পার্কে তার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতা প্রবাসীসহ বিভিন্ন দেশের নরনারীদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশ কোন নীতিতে চলবে_ স্বাধীনতার সংগঠকের মধ্যকার এ বিতর্ক ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন গণসংগঠনকে প্রভাবিত করে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে শুরু হয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তখন মোহাম্মদ শাহজাহান শ্রমিক লীগের সভাপতি। তার এবং যুগ্ম সম্পাদক রুহুল আমিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে জাতীয় শ্রমিক লীগের বড় অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। শ্রমিক রাজনীতিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। শ্রমিক রাজনীতির অঙ্গনে সক্রিয় থেকেও সারাদেশে জাসদকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। দীর্ঘ সময় জেল খেটেছেন। ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায়ও অভিযুক্ত হন তিনি। ১৯৭৭ সালের ২১ জুলাই তাহেরের প্রথম প্রয়াণ দিবসে কারাগারে বসে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেটির দুটি লাইন মনে পড়ছে_ 'যে তাহের জনতার, সে তাহের মরে নাই।' আমি ময়মনসিংহ জেলে বসে কবিতাটি পড়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। তার গদ্য-পদ্য দুই-ই লেখার হাত ছিল। কিন্তু লিখেছেন সামান্যই।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অভিমুখী ছাত্রলীগের কর্মী। ফরিদপুর আমার কর্মক্ষেত্র। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসি। তখন থেকেই তার স্নেহ ও সমর্থন পেয়েছি।
১৯৮৪ সালে জাসদ যখন বিভক্ত হয়, তখন তিনি অনেকটা হতাশ, ত্যক্ত-বিরক্ত। আমার মনে পড়ে, একদিন আমাকে ডেকে বললেন_ সাঈদ, বলো আমরা কোথায় যাচ্ছি? নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। তারপর বিভক্তির কারণে শাহজাহান ভাই একদিকে, আমি অন্যদিকে। তিনি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গে গেলেন। ওই অংশের সভাপতি হলেন। এ সময় তার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে। মতের ও পথের দূরত্ব সত্ত্বেও তার অপার স্নেহধারা থেকে আমাকে বঞ্চিত করেননি। দেখা হলেই আমাকে কাছে টেনে কুশলাদি জেনেছেন।
মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন কর্মপাগল মানুষ। কাজ করে গেছেন, শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিও অবিচার করেছেন। ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সংগঠক। এটি অকালমৃত্যু হলেও, দু'যুগ পরে তা নিয়ে দুঃখ করব না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তিনি সহযোদ্ধাদের স্মৃতি থেকেও যেন হারিয়ে গেছেন!
আমাদের কাছে মোহাম্মদ শাহজাহানের পাওয়ার কিছু নেই। অকালমৃত্যুর পর তার পত্নী মাফরুজ আরা বেগম তাদের সন্তান তওফিক জাহান ও শাহীনা জাহানকে বড় করেছেন। যোগ্য করে তুলেছেন। ছেলে ও মেয়েটি কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। তাদেরও চাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু করার নেই কি? তার পরিবারের উদ্যোগের বাইরে কি তার স্মরণসভা হতে পারে না? হতে পারে না কি রাজধানী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গায় তার নামে কোনো সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ?
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়া কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাস করেন। যোগ দেন শিক্ষকতায়। এ সময়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার আবুল হোসেন মেমোরিয়াল লাইব্রেরি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং লাইব্রেরির অনারারি লাইব্রেরিয়ানও হন। বই-প্রেম তাকে নতুন পথ দেখায়। ষাটের দশকে লাইব্রেরি সায়েন্স পড়তে তিনি ঢাকায় এলেন। শুরু হয় রাজধানীতে টিকে থাকার সংগ্রাম।
ঢাকা তখন উত্তাল। শ্রমিক আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন এক রেখায় মিলেছে, সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করার কারিগর সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯৭০ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ। মোহাম্মদ শাহজাহান জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বাংলা ও ইংরেজিতে চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন তিনি। লন্ডনের হাইড পার্কে তার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতা প্রবাসীসহ বিভিন্ন দেশের নরনারীদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশ কোন নীতিতে চলবে_ স্বাধীনতার সংগঠকের মধ্যকার এ বিতর্ক ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন গণসংগঠনকে প্রভাবিত করে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে শুরু হয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তখন মোহাম্মদ শাহজাহান শ্রমিক লীগের সভাপতি। তার এবং যুগ্ম সম্পাদক রুহুল আমিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে জাতীয় শ্রমিক লীগের বড় অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। শ্রমিক রাজনীতিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। শ্রমিক রাজনীতির অঙ্গনে সক্রিয় থেকেও সারাদেশে জাসদকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। দীর্ঘ সময় জেল খেটেছেন। ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায়ও অভিযুক্ত হন তিনি। ১৯৭৭ সালের ২১ জুলাই তাহেরের প্রথম প্রয়াণ দিবসে কারাগারে বসে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেটির দুটি লাইন মনে পড়ছে_ 'যে তাহের জনতার, সে তাহের মরে নাই।' আমি ময়মনসিংহ জেলে বসে কবিতাটি পড়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। তার গদ্য-পদ্য দুই-ই লেখার হাত ছিল। কিন্তু লিখেছেন সামান্যই।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অভিমুখী ছাত্রলীগের কর্মী। ফরিদপুর আমার কর্মক্ষেত্র। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসি। তখন থেকেই তার স্নেহ ও সমর্থন পেয়েছি।
১৯৮৪ সালে জাসদ যখন বিভক্ত হয়, তখন তিনি অনেকটা হতাশ, ত্যক্ত-বিরক্ত। আমার মনে পড়ে, একদিন আমাকে ডেকে বললেন_ সাঈদ, বলো আমরা কোথায় যাচ্ছি? নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। তারপর বিভক্তির কারণে শাহজাহান ভাই একদিকে, আমি অন্যদিকে। তিনি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গে গেলেন। ওই অংশের সভাপতি হলেন। এ সময় তার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে। মতের ও পথের দূরত্ব সত্ত্বেও তার অপার স্নেহধারা থেকে আমাকে বঞ্চিত করেননি। দেখা হলেই আমাকে কাছে টেনে কুশলাদি জেনেছেন।
মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন কর্মপাগল মানুষ। কাজ করে গেছেন, শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিও অবিচার করেছেন। ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সংগঠক। এটি অকালমৃত্যু হলেও, দু'যুগ পরে তা নিয়ে দুঃখ করব না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তিনি সহযোদ্ধাদের স্মৃতি থেকেও যেন হারিয়ে গেছেন!
আমাদের কাছে মোহাম্মদ শাহজাহানের পাওয়ার কিছু নেই। অকালমৃত্যুর পর তার পত্নী মাফরুজ আরা বেগম তাদের সন্তান তওফিক জাহান ও শাহীনা জাহানকে বড় করেছেন। যোগ্য করে তুলেছেন। ছেলে ও মেয়েটি কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। তাদেরও চাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু করার নেই কি? তার পরিবারের উদ্যোগের বাইরে কি তার স্মরণসভা হতে পারে না? হতে পারে না কি রাজধানী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গায় তার নামে কোনো সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ?
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
No comments