প্রশাসক নিয়োগের চেষ্টা নিয়ন্ত্রণমূলক অপ্রয়োজনীয়-ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর সংবাদ সম্মেলন

আইন সংশোধনের মাধ্যমে যেকোনো কম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের জন্য সরকারের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টাকে 'অগণতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক' বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাই ১৯৯৪ সালের কম্পানি আইনে এ-সংক্রান্ত ধারা যুক্ত করার সরকারি প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা তা বাতিলের দাবি জানান।


ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ কয়েকটি সংগঠন গতকাল মঙ্গলবার যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এতে নেতারা বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনে এ ধরনের কোনো ধারা বা উপধারা যোগ করার প্রয়োজন নেই। বর্তমান আইনেই আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কখনোই সরকারের প্রশাসনিক কাজের অংশ হতে পারে না।
সংবাদ সম্মেলনের পর কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'আমলা দিয়ে ব্যবসা চালাতে পারলে সরকারি ব্যাংকগুলোর করুণ দশা কেন? সরকার একতরফাভাবে এ আইন করলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছেড়ে পালাতে হবে।'
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাবেক ও বর্তমান নেতারা একসুরে বলেছেন, সরকার যেকোনো বেসরকারি কম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা নিতে গিয়ে যেভাবে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, তা 'একপক্ষীয় সংশোধনী'। ব্যবসায়ীরা এ ধরনের পদক্ষেপ সমর্থন করেন না। কোনো কম্পানির প্রতারণামূলক বা জনস্বার্থহানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য যদি প্রশাসক নিয়োগ করা প্রয়োজন হয়, তা হওয়া উচিত বর্তমান 'কম্পানি আইন-১৯৯৪'-এর আলোকে আদালত কর্তৃক প্রদত্ত আইনানুগ আদেশের মাধ্যমে। কম্পানি আইনে প্রস্তাবিত সংশোধন আনা হলে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হারানোর আশঙ্কাও করেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক ও সমালোচনার মুখে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন গতকাল আলাদাভাবে বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেই আইনটি করা হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। গতকাল বিকেলে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যসচিব বলেন, সরকার যাতে রাজনৈতিকভাবে প্রশাসক নিয়োগের বিধান ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য আইনে একটি 'নিরাপত্তা ধারা' যুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে প্রশাসককে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগও বাতিল করা হবে। সচিব জানান, আগামী ৩০ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আইনের খসড়াটি নিয়ে সভা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার কম্পানি আইনের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে খসড়াটি নিয়ে পরামর্শ করবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আর প্রচলিত আইনেই ডেসটিনি গ্রুপে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়টিও দেখা হচ্ছে এবং তা সম্ভব হলে কম্পানি আইন সংশোধন করা হবে না বলে জানান সচিব।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'এভাবে সংশোধন হলে স্বার্থান্বেষী মহল এর অপব্যবহার করতে পারে। মূল আইনে কোনো কম্পানি রিটার্ন দাখিল না করলে কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনটি গত ৪০ বছরে প্রয়োগ হয়নি। যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো, তখনই এর প্রয়োগ শুরু হলো। ব্যবসায়ীদের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।'
ব্যবসায়ীদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম, সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গির আলামিন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেনসহ আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা উপস্থিত ছিলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সবার পক্ষে মূল বক্তব্য পাঠ করেন এ কে আজাদ। বক্তব্যে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী মহল মনে করে, কোনো কম্পানির প্রতারণামূলক বা জনস্বার্থহানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করা প্রয়োজন হলে তা করা উচিত বর্তমান 'কোম্পানি আইন-১৯৯৪'-এর আলোকে। অর্থাৎ আদালতের আদেশের মাধ্যমে, সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে নয়। প্রশাসক নিয়োগ-সংক্রান্ত নতুন করে কোনো ধারা/উপধারা সংযোজনের প্রয়োজন নেই বলে ব্যবসায়ীরা মনে করে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করলে তারা সরকারকে প্রশাসক নিয়োগের বিকল্প নিয়ে পরামর্শ দিতে পারবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
তবে অবৈধ লেনদেন, আর্থিক অনিয়ম ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ধরনের বেসরকারি কম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ বিধিসংবলিত পৃথক যে আইন রয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীদের সমর্থন থাকবে বলে উল্লেখ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
এ কে আজাদ বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রশাসকের জন্য যে চূড়ান্ত ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে, পরিকল্পিত ব্যত্যয় বা অবহেলাজনিত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঠিক হবে না। তাই প্রশাসকের দায়মুক্তির বিধান কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা এতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকে না এবং দুর্নীতির চরম সুযোগ থেকে যায়।
প্রস্তাবিত সংশোধনীকে 'অগণতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক' আখ্যা দিয়ে এ কে আজাদ বলেন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আশঙ্কা, এ রকম একপক্ষীয় সংশোধনী গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশে যে বাজারভিত্তিক এবং প্রতিযোগিতামূলক ধারার সূচনা হয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেসরকারি উদ্যোক্তারা নিজস্ব সম্পদে দিনের পর দিন কঠিন পরিশ্রম করে কম্পানি প্রতিষ্ঠা ও দাঁড় করায়। সেখানে হঠাৎ করে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকার নিয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না, সেখানে এভাবে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ইতিমধ্যে যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের পক্ষেও ব্যবসা করা সম্ভব হবে না।'
এ ধরনের উদ্যোগের চিন্তা সরকারকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'সরকারের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের হাতেই তো সরকারি ব্যাংকে কেলেঙ্কারি ঘটছে। তাহলে প্রশাসক নিয়োগ দিলে যে কেলেঙ্কারি ঘটবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর আমলা দিয়ে ব্যবসা চালানোও সম্ভব নয়। ব্যবসা পরিচালনা করা এত সহজ হলে আমলারা চাকরি না করে ব্যবসা করত।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি জাহাঙ্গির আলামিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধারার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে 'ভিকটিমাইজ' করার সুযোগ থাকবে। শত্রুতাবশত অভিযোগ করে কম্পানিতে প্রশাসক বসানোর চেষ্টা হতে পারে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'সম্পদ পাচার ঠেকাতে দেশে অনেক আইন আছে। ডেসটিনির ব্যাংকে কোনো টাকা থাকলে অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা যেতে পারে। ব্যাংকের বাইরে টাকা থাকলে ওই টাকা প্রশাসক নিয়োগ করে পাচার হওয়া ঠেকানো যাবে না।' এ ধারা যুক্ত করার মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকার হরণ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নষ্ট হবে।
'ভয় পাওয়ার কিছু নেই': কম্পানি আইনের খসড়া নিয়ে গতকাল সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক কর্মশালায় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে আদালতে গিয়ে লিকুইডেটর নিয়োগ দিতে হলে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা বিদেশে পাচার করে দেওয়া হবে। এই ধারাটি যুক্ত করা হবে যাদের উদ্দেশ্য ধোঁকা দেওয়া, তাদের জন্য।
তিনি বলেন, আইন ইচ্ছা করলেই করা যায় না। মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর এটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং করার জন্য পাঠানো হবে। সেখানে তারা দেখবে আইনটি অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না। এরপর আবার মন্ত্রিসভায় যাবে। সেখানে অনুমোদন হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সেটি সংসদে তুলবেন। এর পর সেটি যাবে সংসদীয় কমিটিতে। সেখানে মতামত নেওয়া হবে। পরে আবার সংসদে এলে এর প্রতিটি ধারা নিয়ে আলোচনা হওয়ার পরে পাস হবে। তাই মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন হলেই সব কিছু চূড়ান্ত হয়ে যায়নি।
শফিক আহমেদ আরো বলেন, এই ধারাটি যুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো কম্পানির আওতায় যারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রশাসক নিয়োগের আগে পরিচালকদের ১৫ দিন সময় নিয়ে কারণ দর্শানো হবে। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলেই কেবল প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে।
'নিরাপত্তা ধারা যুক্ত হচ্ছে, দায়মুক্তি থাকছে না' : গতকাল সন্ধ্যায় জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনও বলেন, কম্পানি আইন ১৯৯৪ সংশোধন করে প্রশাসক নিয়োগের বিধান হলে এর রাজনৈতিক ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক কারণে যাতে কম্পানি আইনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান কেউ ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য এতে 'নিরাপত্তা ধারা' যুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আইনের খসড়ায় প্রশাসককে দেওয়া 'দায়মুক্তি' সংক্রান্ত ধারাটিও প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
গোলাম হোসেন বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইনের খসড়ায় ইনডেমনিটি দেওয়ার কথা থাকলেও সোমবার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়া। ওই খসড়ায় দায়মুক্তির বিষয়টি নেই।
এদিকে কম্পানি আইনে প্রশাসক নিয়োগের ব্যাপারে বেসরকারি সুবিধাভোগীদের (স্টেক হোল্ডার) মতামত নেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান সচিব। তিনি বলেন, ৩০ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার দুজন আইনজীবীর মতামত নেওয়া হবে।
প্রচলিত আইনে প্রশাসক নিয়োগ করা গেলে আইন সংশোধন করা হবে না বলে জানান বিদায়ী বাণিজ্যসচিব। তিনি বলেন, 'কম্পানি আইন সংশোধন নিয়ে আয়োজিত সকালের সেমিনারে কয়েকজন আইনজীবী প্রচলিত আইনে আদালতের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগ করা যায় বলে মত দিয়েছেন; আমরা সেটি খতিয়ে দেখব।'
চিঠি প্রেরণ : এদিকে কম্পানি আইনের খসড়ার ওপর আগামী ৩০ অক্টোবর আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য গতকালই বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন বিভাগের পরিচালক ও উপসচিব নাজমুল আহসান মজুমদার স্বাক্ষরিত চিঠিতে এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি), ইনস্টিটিউট অব কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাংলাদেশসহ (আইসিএমএবি) সংশ্লিষ্টদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.