এবিএম খায়রুল হক-অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি-সাক্ষাৎকার by গোলাম সারওয়ার

সমকালের সঙ্গে সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সাক্ষাৎকার সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ঝড়ের কাছে তার ঠিকানা রেখে বিচারক জীবন থেকে বিদায় নিলেন। রোডের সুবিশাল, সুসজ্জিত পটে আঁকা ছবির মতো বাড়ি_ যে বাড়িতে তিনি ৭ মাস বসবাস করেছেন, সাড়া জাগানো, দেশ কাঁপানো রায় লিখেছেন


সেই বাড়ি ছেড়ে ঢাকা কলেজের গা ঘেঁষে একটু পশ্চিমে গিয়ে কানা গলির প্রায় শেষ প্রান্তে ছয়তলা ভবনের নিচতলায় নিজের ফ্ল্যাটে উঠলেন গত বৃহস্পতিবার। ধূলিধূসর, ভয়ঙ্করভাবে অগোছালো শত শত পুস্তক ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় প্রতিটি কক্ষে। ড্রইং রুমে ঠাসাঠাসি করে রাখা অতি সাধারণ সোফায় বসে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা কথা বললেন এবিএম খায়রুল হক। পরনে প্রিয় সফেদ পাঞ্জাবি। দেখেই বুঝতে পারি, ক্লান্তি তাকে ক্ষমা করেনি। চোখে-মুখে, অবয়বে ক্লান্তি তার নাম লিখলেও সুদীর্ঘ সময় তিনি অক্লান্তে কথা বললেন সমকালের সঙ্গে।
বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিব্যাপ্ত এই আলাপচারিতার সময় উপস্থিত ছিলেন সমকালের আইন বিষয়ক প্রতিবেদক ওয়াকিল আহমেদ হিরন। আইনের গভীর জটিল এবং খানিকটা দুর্জ্ঞেয় বিষয়, রাজনীতি, জীবন সংগ্রামের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা, ভালোলাগা-মন্দলাগার নানা প্রসঙ্গের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত এমনকি টিভি চ্যানেলের মধ্যরাতের টকশোও আলোচ্য বিষয় থেকে বাদ যায়নি। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ২০ বিচারপতি'র অন্যতম বলে প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনি কারও কারও কাছে 'ইতিহাসের সবচেয়ে
বিতর্কিত' বিচারপতি
হিসেবে ধিক্কৃতও হয়েছেন।
সমকালের প্রশ্নের জবাবে এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে, আপন বিবেকের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত রেখে ন্যায়বিচার ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান সংশ্লিষ্ট একাধিক রায় প্রদান করেছি। কারও কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করিনি। আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি, সাহসিকতার পথ থেকে বিচ্যুত হইনি। এ প্রসঙ্গে তিনি ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের একাধিক ব্রিটিশ বিচারপতির সাহসিকতার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এই দলের অনুসারী আইনজীবীরা বিদায়ী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও বিতর্কিত রায় দিয়ে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির জোরালো অভিযোগ তুলছেন।
বিচারকের দায়বদ্ধতা
অনেক বিচারক মনে করেন তাদের দায়বদ্ধতা অন্য কারও কাছে নয়, শুধু বিবেকের কাছে। এ প্রসঙ্গে এবিএম খায়রুল হকের মন্তব্য : বিচারক প্রথমত নিজের বিবেকের কাছেই দায়বদ্ধ। কারণ এই বিবেকই তাকে সঠিক এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে উজ্জীবিত করে, উৎসাহিত করে। এই বিবেক তার ন্যায়বোধ। তবে বিচারকদের দায়বদ্ধতা শুধু বিবেকের কাছেই_ এ কথা তিনি মনে করেন না। তার মতে, বিচারকের প্রথম দায়বদ্ধতা সৃষ্টিকর্তার কাছে, দ্বিতীয়ত বিবেকের কাছে, তৃতীয়ত জনগণের কাছে। এ প্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা : রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। তিনটি স্তম্ভই জনগণকে সেবা করার জন্য। তাই বিচার বিভাগের দায়বদ্ধতা জনগণের কাছেও।
বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সমকালের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশ বিভাগের আগে এবং এর পরও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিষয়টি কখনও উপাদেয় বিতর্কের বিষয় হয়নি। প্রধান বিচারপতির বিবেচনার ওপর সবার আস্থা ছিল অখণ্ড, কেউ কখনও প্রশ্ন তুলতেন না। '৯০ সালের দিকে বিচারপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরীকে সম্ভবত ৫ থেকে ৭ বার সুপারসিড করা হয়েছে। বিচারপতি ভিসি ভট্টাচার্যকে অল্পদিনের মধ্যেই হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। তিনি সে সময়ে ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ, বিশাল আইনজ্ঞ। তার নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। এবিএম খায়রুল হক বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি ১০-১২ জন বিচারপতিকে স্থায়ী করার জন্য সুপারিশ করার আগে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সুপারিশ পাঠান। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তই সঠিক। খায়রুল হক বলেন, এসব ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিকে 'নো' বলতে হবে। প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের বাইরে ভারত ও পাকিস্তানে কোনো বিচারপতি নিয়োগ হয় না।
আপন অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে ৭ মাস দায়িত্ব পালনকালে অমুককে বিচারপতি বানান, তমুকের সার্ভিস রেকর্ড ভালো, আইনজীবী ভালো বলে কত না সুপারিশ পেয়েছি। তদবিরকারীদের তালিকায় নামকরা সম্পাদকও রয়েছেন, আমি কারও সুপারিশ শুনিনি।
বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট
বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট ক্ষমতা কার কাছে থাকা উচিত, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল, না সংসদ_ এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বললেন, একসময় আমাদের সংবিধানে ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। পরে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত হয়। এখন এই ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। ইতিমধ্যে আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আমি নাকি এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার পক্ষে। সংসদকে এই ক্ষমতা দেওয়া, না দেওয়া সম্পর্কে আমি কিছু বলিনি। আমি উচিত-অনুচিতের বিষয়টি সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাজা-রানীর রোষানল থেকে বিচারপতিদের রক্ষার জন্য ১৬৮৮ সালে ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা হাউস অব কমনসে নিয়ে যাওয়া হলো। এর আগে রাজা-রানীর ইচ্ছামতো বিচারকদের নিগৃহীত করা হতো, কারাদণ্ড দেওয়া হতো।
এবিএম খায়রুল হক বলেন, বিচারপতিদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকবে, না সংসদের কাছে প্রত্যর্পণ করা হবে তা গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরাসরি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেও এ ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সম্ভবত তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, ইমপিচমেন্টের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হবে। সব নির্বাচনে একটি দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সরকার ও বিরোধী দল কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না, সে ক্ষেত্রে ইমপিচমেন্ট কীভাবে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সাংসদদের স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দেওয়া না হলে সংসদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগ সহজ নাও হতে পারে। বিষয়টি সপ্রসঙ্গ গভীর সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
এবিএম খায়রুল হক মনে করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আক্ষরিকভাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। তার দৃষ্টিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানেই বিচারকের আপন মননশীলতার আলোকে মানসিক স্বাধীনতা। স্বাধীন বিচার বিভাগের এটিই হচ্ছে বড় রক্ষাকবচ। তিনি বলেন, দেশ বিভাগের আগেও বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না। দেশে ইনস্টিটিউশনগুলো ছিল পরাধীন। কিন্তু তখন কেউই বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করার সাহস পেত না। তখন এবং স্বাধীনতার পরও বিচারকরা ছিলেন অনেকটা নিভৃতচারী। তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখতেন_ সবার প্রভাববলয়ের বাইরে থাকতেন। এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠেই বললেন, আমাকে কেউ কোনোদিন প্রভাবিত করা তো দূরের কথা, আকারে-ইঙ্গিতেও কিছু বলার সাহস পায়নি।
সাংবিধানিক পদে নিয়োগ
বিচারপতিসহ সব সাংবিধানিক পদের নিয়োগ সংসদে অনুমোদনের সাম্প্রতিক দাবির প্রসঙ্গ তোলা হলে এই সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, তা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি আমেরিকার দৃষ্টান্তকে বাংলাদেশে প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করেন না। আমাদের দেশে সিনেট নেই। বিচারপতি পদে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য সাংসদদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে তা আপাতদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক মনে হতে পারে। আমাদের দেশে একজন চাপরাসি নিয়োগের সময় মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ আসে এন্তার। সে ক্ষেত্রে একজন জুডিসিয়াল জজ ও একজন প্র্যাকটিসিং অ্যাডভোকেটকে সংসদের সামনে ঠেলে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নাও হতে পারে। এই প্রস্তাব 'আইডিয়াল', 'প্রাকটিক্যাল' নয়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
সাবেক প্রধান বিচারপতি মনে করেন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এবং জনমানুষের প্রত্যাশা পরিপূরণ ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য গণমাধ্যমের শর্তহীন স্বাধীনতা আবশ্যক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিকাশ আন্তর্জাতিক মানের বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রশংসার পাশাপাশি তিনি মিডিয়ার সমালোচনাও করেন। তিনি বলেন, এখন সাংবাদিকরা যেন বিষয়ের গভীরে যেতে আগ্রহী নন। অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু ভাসা ভাসা, যেন উড়ন্ত পাখির চোখে দেখা। অনেক প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়, সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলার পরিশ্রম পরিহার করে একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সাধারণভাবে মনে হয়, অনেকে পড়াশোনা করতে চান না। বিচার বিভাগ, বিচারালয়, বিচারকদের নিয়ে লিখতে গিয়ে নূ্যনতম যেটুকু জানা দরকার, অনেক সাংবাদিক তা জানেন না। ফলে রিপোর্ট হয় একপেশে, সাদামাটা। এসব রিপোর্টে পাঠকের আগ্রহ কম। আপনি নদীর ওপর লিখবেন_ নদী সম্পর্কে জানুন। নদী সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে আমাকেও যৎকিঞ্চিৎ পড়াশোনা করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত চেম্বার জজ সংক্রান্ত রিপোর্টের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, যিনি এই রিপোর্ট লিখেছেন তিনি চেম্বার জজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। না জেনেই তিনি বিশাল এক রিপোর্ট ফেঁদে বসেছেন। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের জানা উচিত ছিল চেম্বার জজ কী অবস্থায় রায় দেন। জানতে হবে চেম্বার জজের কাছে কোনো কাগজপত্র থাকে না, তিনি দু'পক্ষের কথা শুনে অর্ডার দেন।
এবিএম খায়রুল হক মনে করেন, রায়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সমালোচনায় কোনো বাধা নেই। বিশ্বজুড়ে রায়ের সমালোচনা হচ্ছে। যারা সমালোচনা করেন তারা জুডিসিয়ারি সম্পর্কে বিজ্ঞ। বিচারকদের নিয়ে সমালোচনা হয় না।
পঞ্চম সংশোধনীর রায়
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হাইকোর্টের দেওয়া রায় প্রসঙ্গে খায়রুল হক বলেন, সে সময় বিএনপির সরকার ক্ষমতা ছিল। সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, এ মামলাটি হাইকোর্টে আমাদের বেঞ্চে নিয়ে আসেন সুপ্রিম কোর্টের বারের বর্তমান সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদোজ্জা বাদল। দু'একদিন শুনানির পরেই আমাদের বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়ে গেল। মামলাটি আর শুনানি হলো না। আবার আমাদের বেঞ্চে রিটের ক্ষমতা দেওয়া হলো। তখন আবার এ মামলাটি শুনানির জন্য আনা হয়। রাজনৈতিক অসুবিধার কারণে তিনি মামলাটি শুনানি করলেন না। এরপর এলেন আবদুল ওয়াদুদ ভঁূইয়া। তিনি বললেন, আমি চিরকাল সরকারের পক্ষে মামলা করে আসছি। আমার পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা অনৈতিক হবে। এরপর মামলাটি ২০০৪ সালের শেষ দিকে কয়েকদিন শুনানি হয়। ২০০৫ সালে ব্যারিস্টার রাজ্জাক একদিন সকাল থেকে মামলার শুনানি শুরু করলেন। কিন্তু লাঞ্চের পর তিনি এলেন না। খবর পেলাম, তার নাকি এ মামলাটি রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে। হঠাৎ একদিন মামলাটি আবার উপস্থাপন করলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। তিনি ভালোভাবে মামলাটি শুনানি শুরু করলেন। তখন মামলার নথি পড়ে বুঝতে পারলাম সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর (মার্শাল ল') বিষয়টি সেটাসাইড না করে মুন সিনেমা হলের মালিকের মূল মামলায় যাওয়া যাচ্ছে না। সে সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল। আমরা দিনের পর দিন মামলা শুনেছি। কয়েকজন অ্যামিকাস কিউরিও নিয়োগ করা হয়েছিল। তিন মাস ধরে এ মামলা গুরুত্বের সঙ্গে শুনেছি। শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট মামলার রায় দেওয়া হয়।
খায়রুল হক বলেন, রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের ওপর খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমি টেলিভিশনে দেখেছি। এরপর কে বা কারা আমাকে টেলিফোনে বহুবার হত্যার হুমকি দিয়েছিল। রায়ের পর সহকর্মীরা (বিচারপতি) পর্যন্ত আমাকে এড়িয়ে চলতেন। আমি কথা বলতে গেলে তারা মুখ সরিয়ে নিতেন। সে সময় তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি আমার সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। দেখা হলে বার বার একটাই প্রশ্ন_ কবে মামলায় সই করবেন। এত বড় মামলার রায় সই করা খুবই সমস্যা ছিল। খায়রুল হক বলেন, সে সময় প্রতি মুহূর্তে আমার প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। তবে প্রতি মুহূর্তে দোয়া চাইতাম, রায়টি লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ যেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন। তবে সরকার সরাসরি আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।
এবিএম খায়রুল হক বলেন, এর মধ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনী, ফতোয়া, সপ্তম সংশোধনী, পঞ্চম সংশোধনী রিভিউ ও সর্বশেষ ট্রুথ কমিশন নিয়ে রায় দেওয়ার ব্যাপারে একটি সামাজিক চাপ ছিল। বাস্তবতার নিরিখে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় প্রয়োজন ছিল বলে আমরা বিচারপতিরা মনে করেছি। বার থেকেও বার বার বলা হচ্ছিল। পঞ্চম সংশোধনী রায় হয়ে গেল, সপ্তম সংশোধনী রায়টা নিষ্পত্তি না করে জামিন আবেদনটা নিষ্পত্তি করতে না পারছিলাম না। তার মানে জামিন আবেদনটা ডিসাইড করতে গেলে আমাদের সপ্তম সংশোধনী লিগ্যালিটি সম্পর্কে ডিসাইড করতে হয়। আমাদের হাতে সময়ও ছিল না। তাছাড়া পার্ট হার্ড (আংশিক শুনানি) তিন মামলা ছিল। যেমন যমুনা গ্রুপের মামলা। আরও ২টি মামলা ছিল। আমরা এসব মামলা আংশিক শুনানি হিসেবে রেখেছিলাম। মাঝে অন্য মামলা চলে আসার ফলে এ তিনটা মামলা আমরা ধরতে পারিনি।
এবিএম খায়রুল হক বলেন, আমি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিচারকদের হাত-পা বাঁধার কথা বলেছিলাম। সেদিন আমরা সবাই এক হয়েছিলাম ৩০ তলা ও ৭ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর করার উদ্যোগ নিয়ে। এটার বিষয়ে আমার সিনিয়র বন্ধু ও বড় ভাই ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের অনেক অবদান রয়েছে। তার সরাসরি ভূমিকা ছাড়া দুটি প্রজেক্টের মধ্যে একটিও করা সম্ভব হতো না। যুগান্তর পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন দেখে হয়তো তার খারাপ লেগেছিল। সে কারণেই তিনি হয়তো আমার বিচারকদের সম্বন্ধে রূঢ় ভাষায় কথা বলেছিলেন। ৯০ ভাগ বিচারক সৎ, কর্মক্ষম ও পরিশ্রমী। তারা এ পরিশ্রমটা না করলে বিচার ব্যবস্থা এখনও যেভাবে রয়েছে এটা থাকতে পারত না। তবে মানুষের যে বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা আছে তা প্রমাণ করে ক্রমাগত মামলা ফাইলের মধ্য দিয়ে। না হলে মানুষ কেউ কোর্ট-কাচারিতে আসত না। এটাই প্রমাণ করে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে। এটাই আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম। আমাদের বিচারকদের যে অসুবিধা আছে সেটাও তাদের দেখতে হবে। যারা এটা নিয়ে সমালোচনা করেছেন তারাও ভালো করে জানেন, আমি এটাকে কী বুঝিয়েছি। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে ছিল সেটা পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। সেটা ফিরিয়ে দিলে সত্যি প্রশাসনের সুবিধা হবে। এই অনুচ্ছেদে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়গুলো রয়েছে। আইনমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন, তা আংশিক সত্য। তবে বিচারকরাই সব সময় কাজ করে থাকেন। এখন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন মাত্র কনসাল্টেশন করে থাকে। ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে দেওয়া হলে আমরা পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন হতে পারব। এই হাত-পা বাঁধার সঙ্গে বিচারিক কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।
আদালত অবমাননা
আদালত অবমাননা খুবই সংবেদনশীল প্রশ্ন বলে মনে করেন এবিএম খায়রুল হক। আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্তকে এজলাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করানোর ঘটনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এটা মোটেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, প্রায় আড়াই বছর তিনি আদালত অবমাননা সংক্রান্ত মামলার বিচার করতেন। প্রায়ই আদালতে সচিব, সাংবাদিক, জেলা প্রশাসকের মতো বিশিষ্টজনরা উপস্থিত হতেন। কোনো দিন কাউকে তিনি ৩০ সেকেন্ডের জন্যও দাঁড় করিয়ে রাখতেন না। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তাকে দারুণভাবে পীড়িত করেছে। এ পর্যায়ে সমকাল বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদকে অশালীন ভাষায় তিরস্কারের প্রসঙ্গ তুললে সাবেক প্রধান বিচারপতি ঘটনাটিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন।
আদালতে দুর্নীতি
বিচারপতি থাকাকালে তিনি আদালতে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের ডালপালা মেলায় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে দুর্নীতি প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। নিম্ন আদালতে দুর্নীতি তো ওপেন সিক্রেট। উচ্চ আদালত? উচ্চ আদালত কি ধোয়া তুলসী পাতা? এবিএম খায়রুল হক তা মনে করেন না। উচ্চ আদালতে দুর্নীতি লক্ষ্য করে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে তা কেউ দেখেনি। বিচারপ্রার্থীরা এখানেও অসহায়। অনেক ঘটনা তার জানা_ প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে তিনি নির্বিকার ছিলেন। কারও নাম উল্লেখ না করে এবিএম খায়রুল হক বললেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তবু অনেক সময় মনে হয়েছে এই অপ্রিয় তথ্যই হয়তো সত্য। রায় পক্ষে নেওয়ার জন্য দেশের বাইরে টাকা আদান-প্রদান করা হয়। বড় একটি শিল্প গ্রুপের করপোরেট অফিসে একজন বিচারককে দেখা গেছে বলে অভিযোগ শুনেছি। এক অর্ডারে ১১শ' লোককে জামিন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একজন বিচারকের সন্তান জামিন অযোগ্য ধারায় জেলে। তাকে বিধিভঙ্গ করে হাইকোর্ট থেকে বেল দেওয়ার জন্য কোনো কোনো বিচারকের সুপারিশ আমাকে অগ্রাহ্য করতে হয়েছে। টাকা দিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করার পেছনে শুধু বেঞ্চ অফিসারের ভূমিকা রয়েছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। পেপার বুক তাড়াতাড়ি তৈরিতেও টাকা লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। বিচারকদের বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয় নানা কারণে। এর মধ্যে দুর্নীতিও রয়েছে। আমি এসবের সংশোধন চেয়েছি। বিচারালয়ে নৈতিকতাবোধ পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যর্থতা অবশ্যই পীড়াদায়ক। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, পঞ্চম, সপ্তম, দ্বাদশ সংশোধনী, ফতোয়ার বৈধতা সংক্রান্ত অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মামলার রায় দিয়েছেন এবিএম খায়রুল হক। অন্য কোনো বিচারপতি এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়েছেন বলে জানা যায় না। তার রায় প্রশংসার পাশাপাশি তীক্ষষ্টভাবে সমালোচিত হয়েছে। সে সমালোচনার ভাষা ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে। এ কারণে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক পর্যন্ত আইনজীবীদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এসব রায় লেখার প্রস্তুতি পর্ব নিয়েও সাবেক প্রধান বিচারপতি সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তার ভাষায় : সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ রায় লিখেছি আমি রাতের বেলা। দরজা-জানালা খুলে দিয়েছি। হিমেল হাওয়ার মায়াবি পরশে সি্নগ্ধ হয়েছে আমার কক্ষ। নিচু লয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে চলেছে। সঙ্গীতের ইন্দ্রজালে আবিষ্ট হয়ে সবকিছু ভুলে একাগ্র মনে রায় লিখেছি। রবীন্দ্রসঙ্গীতই প্রিয় গান সাবেক প্রধান বিচারপতির। পুরনো দিনের গান হৃদয়কে আলোড়িত করে। পশ্চিমা সঙ্গীত বিশেষ করে নাইন সিম্ফনি তার প্রিয়। সময় পেলেই মধ্যরাতে টক শো দেখেন। ভালোমন্দে মিশেল সে অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝে আইনের অপব্যাখ্যা শুনে কষ্ট পান। শুনে অনেকটা অবাক হলাম একটি বাংলা চ্যানেলে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প অবলম্বনে 'সুবর্ণলতা' খুব কমই 'মিস' করেন। তার ভাষায়, উনিশ শতকের একান্নবর্তী বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের অবিকৃত দিনলিপি হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। অবসর জীবনে বিচিত্র বিচারক জীবন নিয়ে লেখালেখির কথাও ভাবছেন তিনি।
ছোট্ট পরিবার। মা, স্ত্রী, তিন সন্তান। মায়ের বয়স ৮৫-র কাছাকাছি। এখনও স্নেহ-শাসনে মায়ের প্রভাব তার ওপর অবিনাশী। স্ত্রী একেবারেই সাদাসিধা। এত বড় স্বামী তার_ এ নিয়ে অহঙ্কার নয়, বিনয় লক্ষ্য করেছি তার কথায়। সবকিছুতে স্বামীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। সংসার সামলাচ্ছেন। সংসারে কম সময় দেন বলে তার কোনো অনুযোগ নেই। এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়ে ডাক্তার। লন্ডনে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘর করছেন। এক ছেলে একটি বহুজাতিক কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তা। এক ছেলে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী হিসেবে কিছুদিন আগে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। সন্তানরা আদর্শ বাবা হিসেবে দশে দশ নম্বর দিলেন। তারা তিনজনই বললেন, বাবা আমাদের সৎপথে থাকতে শিখিয়েছেন। সাধারণ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাবার জন্য তারা গর্বিত। মা বললেন, খায়রুলের বাবা আইনজীবী ছিলেন। দারুণ কড়া ছিলেন তিনি। ছেলেকে নিজের আদর্শে বড় করে তুলেছেন। খায়রুল হক বললেন, তার মা কঠোর হাতে সংসারের হাল ধরতেন।
অবসর জীবন
এবিএম খায়রুল হক কিঞ্চিৎ আক্ষেপের কথা আমাদের শোনালেন। সন্তানদের প্রাপ্য পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছেন। পিতা হয়েও আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ এ জন্য যে, ওদের কোনো আক্ষেপ নেই। নজরুলের মতো করে তিনি বলতে চাইলেন, হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান। ১৯৮২ সাল খুব কষ্টে কেটেছে। অনেক দিন চাল কিনতে পারিনি। সন্তানদের জন্য দুধ কিনতে পারিনি। অনেক সহৃদয় বল্পুব্দ টাকা ধার দিতেন। বাড়ি বানাতে গিয়ে ব্যাংক ও বল্পুব্দদের কাছ থেকে অনেক টাকা ঋণ করেছি। প্রতিমাসে ৬৫ হাজার টাকা করে ঋণ শোধ করতে হয়। কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের টেলিফোন এলো। খায়রুল হক প্রথমেই জানতে চাইলেন, পেনশনের টাকা কি সপ্তাহখানেকের মধ্যে পাওয়া যাবে! এই টাকা পেলে তিনি ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা হালকা করবেন। তার প্রিয় মানুষ লেখক হিসেবে রবীন্দ্র, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ইংরেজি সাহিত্যিক সমারসেট মম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাও তার খুব প্রিয়। চোখে চোখ রেখে খায়রুল হক বললেন, ভাবছেন প্রিয় মানুষের মধ্যে বঙ্গবল্পুব্দ নেই কেন? বঙ্গবল্পুব্দর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। সবার ওপরে তার স্থান। অনেক নামের ভিড়ে তার নামটি উচ্চারণ করতে চাইনি। আপাতত দু'সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে চান সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি। তারপর অসমাপ্ত রায়গুলো লিখতে শুরু করবেন তিনি।
 

No comments

Powered by Blogger.