জাবির আকাশে এক চিলতে মেঘ by এ কে এম শাহনাওয়াজ
১৯৭৩-এর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হওয়ার কলঙ্ক বহন করছে অনেক দিন থেকেই। ছাত্ররাজনীতিও চলছে অভিন্ন ধারায়। এর অশুভ প্রতিক্রিয়ায় নানা নৈরাজ্য লেগেই আছে।
জ্ঞানচর্চার প্রকৃত ছন্দ তাই প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না উচ্চশিক্ষার এই পীঠস্থানগুলোতে। এর প্রধান দায় বহন করতে হবে জাতীয় রাজনীতির নায়ক-মহানায়কদের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির নষ্ট প্রভাব পড়তে থাকে ১৯৭৫-এর পর থেকে এবং তা প্রবল হয় নব্বইয়ের দশকে এসে। এই কালপর্বে যে দল যখনই সরকারে এসেছে, নিজেদের শক্তিকেন্দ্র বানাতে চেয়েছে ক্যাম্পাসকে। এমন ছক থেকেই নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধায় তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ কখনো লঙ্ঘন করা হয়েছে, আবার কখনো কৌশলে অধ্যাদেশের কোনো কোনো ধারার অপব্যবহার করে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার হীন-পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এ কথা মানতেই হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিকাশে একজন উপাচার্যের নেতৃত্বই প্রধান। তাই উপাচার্য মহোদয়ের বৈদগ্ধ ও মুক্তচিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত বিকাশ ঘটায়। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালেও প্রায় এক দশক এই আদর্শ বহন করত রাষ্ট্র। দলীয় রাজনীতির বন্দিত্বমুক্ত খ্যাতিমান শিক্ষাবিদরা উপাচার্য পদ অলঙ্কৃত করতেন। এই পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণার তীর্থভূমিই ছিল। এরপর একসময় জাতীয় রাজনীতির অপচ্ছায়া পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ধারা ভেঙে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য ষণ্ডাতন্ত্র কায়েম করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র সংগঠনগুলো তামাদি করে দিয়ে দলীয় ছাত্র সংগঠনের রামরাজত্ব কায়েম করা হয়। দলীয় রাজনীতির ছত্রতলে শিক্ষকদেরও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। এভাবে পাণ্ডিত্য আর নিরপেক্ষতার বদলে অনেক ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যে নতজানু শিক্ষকদের উপাচার্য বানিয়ে কঠিন দলতন্ত্রের আবর্তে ছুড়ে ফেলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এমন অবস্থায় নানা অন্যায় প্রশ্রয় পায়। আর এর কুপ্রভাবে নৈরাজ্য ঘিরে ধরে। মুক্তচিন্তার চারণভূমি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন তাই মাঝেমধ্যেই ফুঁসে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকদের ভেতর থেকে প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রশাসনবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন ছিল এই বাস্তবতারই বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে আন্দোলন ছিল কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লক্ষ্যে; পরে চলমান ঘটনার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে তা ভিসি পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পর্যবসিত হয়। একসময় সরকার বাধ্য হয় দাবি মেনে নিতে। পদত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্বাচিত ভিসি। সরকার উপাচার্য হিসেবে মনোনয়ন দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে। আন্দোলনস্নাত ক্যাম্পাসে তাঁকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশার জন্ম হয়। অবশেষে দায়িত্ব গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যেই তিনি উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেশবাসীকে চমকে দেন, চমৎকৃতও করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলমত নির্বিশেষে সব শিক্ষক এই ঘোষণাকে প্রাথমিকভাবে স্বাগত জানান। তবে এই ঘোষণার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্নের নিষ্পত্তি না থাকায় উপাচার্য মহোদয়ের সাধু-ইচ্ছাটি বিতর্কিত হতে পারে বা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটতে পারে আশঙ্কায় শিক্ষকদের একটি অংশ (বিশেষ করে যারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে সক্রিয় ছিল) উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিমত প্রকাশ করে। এই সরল বিষয়টি কোনো কোনো পত্রিকায় ভিন্ন ব্যাখ্যায় প্রকাশ পেয়েছে। ফলে জাতির বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ৪ জুলাই একটি প্রভাবশালী দৈনিকে উপাচার্যের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে লেখা সম্পাদকীয়টিতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, 'এক পক্ষ নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও অন্য পক্ষ বিরোধিতা করছে।' এ কারণেই বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি মনে করছি।
শিক্ষকদের যে অংশটি উপাচার্য মহোদয়ের কাছে গিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, সেই অংশটিই বিগত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন আন্দোলনরত শিক্ষকদের অন্যতম দাবি ছিল। সুতরাং উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণাকে তাঁরা তাঁদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে মনে করছেন। তাই তাঁদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ঘোষণার বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁরা উপাচার্য মহোদয়ের কাছে গিয়েছিলেন প্যানেল নির্বাচনের আগে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য আরো কয়েকটি নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা বলতে। কারণ তাঁরা মনে করেন, এই নির্বাচনগুলোর সঙ্গে প্যানেল নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। এই যৌক্তিক ও করণীয় দায়িত্ব পালন না করে তড়িঘড়ি প্যানেল নির্বাচনে গেলে অনেকের কাছে তা পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হতে পারে। এতে গণতান্ত্রিক পথচলা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই নতুন কোনো সংকট যাতে সৃষ্টি না হয় ও নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পড়ে, সে কারণেই শিক্ষকরা তাঁদের আবেদন জানিয়ে এসেছেন।
আসলে বিগত আন্দোলনের সময় থেকেই আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা ছিল। কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে। বলা হয়েছিল, ভিসির পক্ষের শিক্ষকরা সহি আওয়ামী লীগপন্থী আর আন্দোলনকারীরা জামায়াত-বিএনপিপন্থী। পরে প্রচারণাটি ধোপে টেকেনি। ভিসিকে সমর্থন দিয়েছিল আওয়ামীপন্থী একটি শিক্ষক গ্রুপ। আর নানা দলমতের শিক্ষকরা ছিলেন আন্দোলনের পক্ষে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী ও বাম ঘরানার শিক্ষকরা। বিএনপিপন্থী ও দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের একটি বড় অংশও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতপন্থী শিক্ষকের সংখ্যা হাতেগোনা। তাঁদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বরং স্বয়ং ভিসির তৈরি কয়েকটি কমিটিতে কাজ করেছেন। জামায়াতপন্থী দু-একজন শিক্ষক আন্দোলনকারীদের মানববন্ধনেও দাঁড়িয়েছিলেন। এমন বাস্তবতায় দৃষ্টি অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য ভিসিবিরোধী আন্দোলনকে জামায়াত-বিএনপির আন্দোলন বলার চেষ্টা করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ভিসিবিরোধী আন্দোলনরত সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছাত্র- যাঁরা ক্যাম্পাসে সব সময় গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকেন, তাঁদের বিস্ময়করভাবে শিবির বলে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের দ্বারা এদের ওপর আক্রমণও করা হয়েছে।
ছাত্র-শিক্ষকসহ সবারই চাওয়া তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সেটি আধাআধি লোক দেখানো নয়- সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়গুলোর সমাধান সবার কাম্য ছিল। নতুন উপাচার্য মহোদয় শিক্ষকদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ২০ বছর ধরে যে জাকসু নির্বাচন হয় না, তিনি সেই জাকসু নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জাকসু থেকে আসা পাঁচজন সিনেট সদস্য ভোটার থাকেন। এই সদস্যপদ এখন শূন্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের ভেতর থেকে ২৫ জন সিনেটর নির্বাচিত হন। তাঁরা ভিসি প্যানেলে ভোট দেন। ১৪ বছর ধরে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট থেকে সিনেট সদস্য নির্বাচন বন্ধ আছে। এ ছাড়া আরো ১৫টি সিনেটর ভোট রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন নির্বাচিত হন কলেজের প্রিন্সিপালদের মধ্য থেকে। আগে নির্বাচিত এই পাঁচজন সিনেটরের মেয়াদ এক বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। রিসার্চ বডি থেকে পাঁচজন নির্বাচিত হন। এই পাঁচজন সদস্যের মেয়াদও অনেক আগে পূর্ণ হয়ে গেছে। এর বাইরে রয়েছেন চ্যান্সেলর মনোনীত পাঁচজন। তাই অঙ্কের হিসাবে দাঁড়ায়, যাঁরা ভিসি প্যানেলে ভোট দেবেন এমন ৪৫ জন ভোটারের সদস্যপদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছে অনেক আগেই। প্যানেল নির্বাচনে এটি একটি বড় সংখ্যা। এখানে অবশ্য একটি আইনের ফাঁক আছে। নতুন সদস্য নির্বাচন করা না গেলে পুরনো সদস্যদের ভোটেই প্যানেল নির্বাচন করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আইনে সংকট না থাকলেও নৈতিক দিক থেকে তো সংকট রয়েছে। তা ছাড়া ভিসি প্যানেল নির্বাচনের আগে এই সদস্য পদগুলোর মধ্যে একমাত্র জাকসুর পাঁচজন সদস্য বাদে সদিচ্ছা থাকলে বাকি ৪০ জনের নির্বাচন দুই সপ্তাহের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। সে হিসেবে উপাচার্য মহোদয় তাঁর ভিসি নির্বাচনের মহতী উদ্যোগকে স্বচ্ছ ও যৌক্তিক করার স্বার্থে সময়টাকে সামান্য পিছিয়ে নিলেই পারেন। সে ক্ষেত্রে ঈদের ছুটির আগে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সিনেট সদস্য নির্বাচন শেষ করে ঈদের পরপর ভিসি প্যানেল নির্বাচন করে পুরো বিষয়টি বিতর্কের বাইরে রাখা সম্ভব। এতে কোনো পক্ষেরই আপত্তি থাকবে বলে আমি মনে করি না।
গণতন্ত্রপ্রত্যাশী ক্যাম্পাসবাসী দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় এখন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। এত সব জরুরি যৌক্তিক প্রশ্ন থাকার পরও ভিসি মহোদয় হঠাৎ প্যানেল নির্বাচনে এতটা তাড়াহুড়ো করলেন কেন? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। কারো কারো বিশ্বাস, নতুন ভিসি মহোদয়কে দিয়ে পদত্যাগী ভিসি তাঁর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। না হলে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পুরনো ভিসির অনুসারীরা যৌক্তিক প্রশ্নগুলো আড়ালে রেখে ঘোষণাকে দ্রুত স্বাগত জানালেন কেন?
আমি অবশ্য এসব সন্দেহের বাইরে থাকতে চাই। উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আমি যতটুকু জানি, তাতে এই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাবিদের সততা ও দৃঢ়চিত্ততার ব্যাপারে আমার আস্থা রয়েছে। ভয় শুধু সরল সিদ্ধান্তের কারণে কোনো অশনিসংকেত না আবার দেখা দেয়। যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য এত দিন মাঠে আন্দোলন করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একটি বৃহৎ অংশ নীরবে সমর্থন জানিয়েছে, আজ একটি অপূর্ণ গণতন্ত্রের এমন পথহাঁটা শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নেবে কি না। এ কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে এক চিলতে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। আমরা আশা করব, ভিসি মহোদয় তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবন করবেন এবং তাতে মেঘ কেটে সূর্য হাসবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ কথা মানতেই হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিকাশে একজন উপাচার্যের নেতৃত্বই প্রধান। তাই উপাচার্য মহোদয়ের বৈদগ্ধ ও মুক্তচিন্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত বিকাশ ঘটায়। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালেও প্রায় এক দশক এই আদর্শ বহন করত রাষ্ট্র। দলীয় রাজনীতির বন্দিত্বমুক্ত খ্যাতিমান শিক্ষাবিদরা উপাচার্য পদ অলঙ্কৃত করতেন। এই পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণার তীর্থভূমিই ছিল। এরপর একসময় জাতীয় রাজনীতির অপচ্ছায়া পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ধারা ভেঙে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য ষণ্ডাতন্ত্র কায়েম করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র সংগঠনগুলো তামাদি করে দিয়ে দলীয় ছাত্র সংগঠনের রামরাজত্ব কায়েম করা হয়। দলীয় রাজনীতির ছত্রতলে শিক্ষকদেরও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। এভাবে পাণ্ডিত্য আর নিরপেক্ষতার বদলে অনেক ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যে নতজানু শিক্ষকদের উপাচার্য বানিয়ে কঠিন দলতন্ত্রের আবর্তে ছুড়ে ফেলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এমন অবস্থায় নানা অন্যায় প্রশ্রয় পায়। আর এর কুপ্রভাবে নৈরাজ্য ঘিরে ধরে। মুক্তচিন্তার চারণভূমি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন তাই মাঝেমধ্যেই ফুঁসে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকদের ভেতর থেকে প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রশাসনবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন ছিল এই বাস্তবতারই বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে আন্দোলন ছিল কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লক্ষ্যে; পরে চলমান ঘটনার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে তা ভিসি পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পর্যবসিত হয়। একসময় সরকার বাধ্য হয় দাবি মেনে নিতে। পদত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্বাচিত ভিসি। সরকার উপাচার্য হিসেবে মনোনয়ন দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে। আন্দোলনস্নাত ক্যাম্পাসে তাঁকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশার জন্ম হয়। অবশেষে দায়িত্ব গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যেই তিনি উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেশবাসীকে চমকে দেন, চমৎকৃতও করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলমত নির্বিশেষে সব শিক্ষক এই ঘোষণাকে প্রাথমিকভাবে স্বাগত জানান। তবে এই ঘোষণার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্নের নিষ্পত্তি না থাকায় উপাচার্য মহোদয়ের সাধু-ইচ্ছাটি বিতর্কিত হতে পারে বা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটতে পারে আশঙ্কায় শিক্ষকদের একটি অংশ (বিশেষ করে যারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে সক্রিয় ছিল) উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিমত প্রকাশ করে। এই সরল বিষয়টি কোনো কোনো পত্রিকায় ভিন্ন ব্যাখ্যায় প্রকাশ পেয়েছে। ফলে জাতির বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ৪ জুলাই একটি প্রভাবশালী দৈনিকে উপাচার্যের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে লেখা সম্পাদকীয়টিতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, 'এক পক্ষ নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও অন্য পক্ষ বিরোধিতা করছে।' এ কারণেই বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি মনে করছি।
শিক্ষকদের যে অংশটি উপাচার্য মহোদয়ের কাছে গিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, সেই অংশটিই বিগত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন আন্দোলনরত শিক্ষকদের অন্যতম দাবি ছিল। সুতরাং উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণাকে তাঁরা তাঁদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে মনে করছেন। তাই তাঁদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ঘোষণার বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁরা উপাচার্য মহোদয়ের কাছে গিয়েছিলেন প্যানেল নির্বাচনের আগে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য আরো কয়েকটি নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা বলতে। কারণ তাঁরা মনে করেন, এই নির্বাচনগুলোর সঙ্গে প্যানেল নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। এই যৌক্তিক ও করণীয় দায়িত্ব পালন না করে তড়িঘড়ি প্যানেল নির্বাচনে গেলে অনেকের কাছে তা পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হতে পারে। এতে গণতান্ত্রিক পথচলা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই নতুন কোনো সংকট যাতে সৃষ্টি না হয় ও নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পড়ে, সে কারণেই শিক্ষকরা তাঁদের আবেদন জানিয়ে এসেছেন।
আসলে বিগত আন্দোলনের সময় থেকেই আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা ছিল। কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে। বলা হয়েছিল, ভিসির পক্ষের শিক্ষকরা সহি আওয়ামী লীগপন্থী আর আন্দোলনকারীরা জামায়াত-বিএনপিপন্থী। পরে প্রচারণাটি ধোপে টেকেনি। ভিসিকে সমর্থন দিয়েছিল আওয়ামীপন্থী একটি শিক্ষক গ্রুপ। আর নানা দলমতের শিক্ষকরা ছিলেন আন্দোলনের পক্ষে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী ও বাম ঘরানার শিক্ষকরা। বিএনপিপন্থী ও দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের একটি বড় অংশও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতপন্থী শিক্ষকের সংখ্যা হাতেগোনা। তাঁদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বরং স্বয়ং ভিসির তৈরি কয়েকটি কমিটিতে কাজ করেছেন। জামায়াতপন্থী দু-একজন শিক্ষক আন্দোলনকারীদের মানববন্ধনেও দাঁড়িয়েছিলেন। এমন বাস্তবতায় দৃষ্টি অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য ভিসিবিরোধী আন্দোলনকে জামায়াত-বিএনপির আন্দোলন বলার চেষ্টা করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ভিসিবিরোধী আন্দোলনরত সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছাত্র- যাঁরা ক্যাম্পাসে সব সময় গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকেন, তাঁদের বিস্ময়করভাবে শিবির বলে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের দ্বারা এদের ওপর আক্রমণও করা হয়েছে।
ছাত্র-শিক্ষকসহ সবারই চাওয়া তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সেটি আধাআধি লোক দেখানো নয়- সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়গুলোর সমাধান সবার কাম্য ছিল। নতুন উপাচার্য মহোদয় শিক্ষকদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ২০ বছর ধরে যে জাকসু নির্বাচন হয় না, তিনি সেই জাকসু নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জাকসু থেকে আসা পাঁচজন সিনেট সদস্য ভোটার থাকেন। এই সদস্যপদ এখন শূন্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের ভেতর থেকে ২৫ জন সিনেটর নির্বাচিত হন। তাঁরা ভিসি প্যানেলে ভোট দেন। ১৪ বছর ধরে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট থেকে সিনেট সদস্য নির্বাচন বন্ধ আছে। এ ছাড়া আরো ১৫টি সিনেটর ভোট রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন নির্বাচিত হন কলেজের প্রিন্সিপালদের মধ্য থেকে। আগে নির্বাচিত এই পাঁচজন সিনেটরের মেয়াদ এক বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। রিসার্চ বডি থেকে পাঁচজন নির্বাচিত হন। এই পাঁচজন সদস্যের মেয়াদও অনেক আগে পূর্ণ হয়ে গেছে। এর বাইরে রয়েছেন চ্যান্সেলর মনোনীত পাঁচজন। তাই অঙ্কের হিসাবে দাঁড়ায়, যাঁরা ভিসি প্যানেলে ভোট দেবেন এমন ৪৫ জন ভোটারের সদস্যপদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছে অনেক আগেই। প্যানেল নির্বাচনে এটি একটি বড় সংখ্যা। এখানে অবশ্য একটি আইনের ফাঁক আছে। নতুন সদস্য নির্বাচন করা না গেলে পুরনো সদস্যদের ভোটেই প্যানেল নির্বাচন করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আইনে সংকট না থাকলেও নৈতিক দিক থেকে তো সংকট রয়েছে। তা ছাড়া ভিসি প্যানেল নির্বাচনের আগে এই সদস্য পদগুলোর মধ্যে একমাত্র জাকসুর পাঁচজন সদস্য বাদে সদিচ্ছা থাকলে বাকি ৪০ জনের নির্বাচন দুই সপ্তাহের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। সে হিসেবে উপাচার্য মহোদয় তাঁর ভিসি নির্বাচনের মহতী উদ্যোগকে স্বচ্ছ ও যৌক্তিক করার স্বার্থে সময়টাকে সামান্য পিছিয়ে নিলেই পারেন। সে ক্ষেত্রে ঈদের ছুটির আগে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সিনেট সদস্য নির্বাচন শেষ করে ঈদের পরপর ভিসি প্যানেল নির্বাচন করে পুরো বিষয়টি বিতর্কের বাইরে রাখা সম্ভব। এতে কোনো পক্ষেরই আপত্তি থাকবে বলে আমি মনে করি না।
গণতন্ত্রপ্রত্যাশী ক্যাম্পাসবাসী দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় এখন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। এত সব জরুরি যৌক্তিক প্রশ্ন থাকার পরও ভিসি মহোদয় হঠাৎ প্যানেল নির্বাচনে এতটা তাড়াহুড়ো করলেন কেন? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। কারো কারো বিশ্বাস, নতুন ভিসি মহোদয়কে দিয়ে পদত্যাগী ভিসি তাঁর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। না হলে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পুরনো ভিসির অনুসারীরা যৌক্তিক প্রশ্নগুলো আড়ালে রেখে ঘোষণাকে দ্রুত স্বাগত জানালেন কেন?
আমি অবশ্য এসব সন্দেহের বাইরে থাকতে চাই। উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আমি যতটুকু জানি, তাতে এই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাবিদের সততা ও দৃঢ়চিত্ততার ব্যাপারে আমার আস্থা রয়েছে। ভয় শুধু সরল সিদ্ধান্তের কারণে কোনো অশনিসংকেত না আবার দেখা দেয়। যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য এত দিন মাঠে আন্দোলন করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একটি বৃহৎ অংশ নীরবে সমর্থন জানিয়েছে, আজ একটি অপূর্ণ গণতন্ত্রের এমন পথহাঁটা শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নেবে কি না। এ কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে এক চিলতে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। আমরা আশা করব, ভিসি মহোদয় তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবন করবেন এবং তাতে মেঘ কেটে সূর্য হাসবে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments