শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-ভালোবাসায় গড়া পাঠাগার by আনোয়ার হোসেন

প্রতীতি সাধারণ পাঠাগার। চাঁপাই-নবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামের এই পাঠাগার একটু অন্য রকম। এর গড়ে ওঠার গল্প ও পরিচালনা দেশের আর দশটি পাঠাগার থেকে আলাদা। আর এটা সম্ভব হয়েছে গ্রামবাসীর ভালোবাসার কারণে। তাঁদের ভালোবাসায় যে গড়ে উঠেছে এই পাঠাগার!


শুরুর কথা: ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে আলীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে বসে গল্প করছিলেন ‘বইয়ের পোকা’ কয়েকজন বন্ধু—বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র আবদুস সাত্তার, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র আশরাফুল হক, মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল ইসলাম, লিয়াকত আলী ও আমিরুল ইসলাম। নানা গল্পের সূত্র ধরে একপর্যায়ে প্রস্তাবটি আসে সাত্তারের কাছ থেকেই। ‘আমাদের গ্রামের ছাত্র-যুবক-তরুণদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করা দরকার। উন্নত মানসিকতা গড়তে বই পড়ার বিকল্প নেই। গ্রামের তরুণ-যুবক উন্নত মানসিকতার হলেই তারা এগিয়ে যেতে পারবে, গ্রামের সুনাম হবে। এ জন্য গ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে হবে পাঠাগার।’ বলেন তিনি। তাঁর কথায় সায় দেন সবাই। শুরু হয় পাঠাগার গড়ার সংগ্রাম।
পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয় গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী, মনিমুল হক বিশ্বাস, ইয়াহিয়া মিয়াসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা সবাই উৎসাহ দিলেন। এতে সাত্তারদের কাজে গতি এল কয়েক গুণ। এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রামের আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে যাত্রা শুরু হলো পাঠাগারের। সেখানে রাখা হলো সাত্তারের সংগ্রহে থাকা ৭০ থেকে ৮০টি বই। বেশির ভাগই মাসুদ রানা সিরিজের। পরে অন্যদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করা শতাধিক বইয়ের স্থান হলো এই পাঠাগারে। পাঠাগার পরিচালনার জন্য গঠিত হলো ১৫ সদস্যের নির্বাহী কমিটি। নাম দেওয়া হলো ‘প্রতীতি সাধারণ পাঠাগার’।
পথচলা: দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তো পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হলো। এখন পাঠাগারের জন্য বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি ও পাঠাগার পরিচালনার জন্য গ্রন্থাগারিক নিয়োগ —এসব নিয়ে গ্রামের মুরব্বিদের সভা ডাকলেন উদ্যোক্তারা। সভায় সবাই চাঁদা তোলার পক্ষে সায় দিলেন। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই কৃষিজীবী। নগদ টাকা চাঁদা দিতে সমস্যা অনেকেরই। তাই সিদ্ধান্ত হলো, ধানের দুই মৌসুমে চাঁদা হিসেবে তোলা হবে ধান। জাকাত-ফেতরার একটি অংশ যাবে পাঠাগারে। ৩৪ বছর আগে পাঠাগার পরিচালনায় গ্রামের মুরব্বিদের সেই সিদ্ধান্ত আজও মেনে চলছেন গ্রামবাসী। পাঠাগার পরিচালনার জন্য গ্রামের সবাই সাধ্যমতো বোরো ও আমন মৌসুমে ধান দেন। পাঠাগারের জন্য পাঁচ কেজি, কেউ ১০ কেজি, আধা মণ বা এক মণ করে ধান দেওয়া গ্রামের সবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
গ্রামবাসীর কাছে পাঠাগারটি গ্রামের ঐতিহ্য, গর্ব। তাঁদের চাওয়া, এটি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকুক।
নিজস্ব ঠিকানায়: ১৯৮৮ সালে নিজস্ব ঠিকানা পায় পাঠাগারটি। সেই গল্প শোনালেন প্রতীতি সাধারণ পাঠাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রহনপুর মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ আসলাম হোসেন। তিনি জানালেন, আলীনগর স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ পাঠাগারের জন্য ১৬ শতক জমি দান করে। ১৯৮৮ সালে গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক বিশ্বাস পরিষদের তহবিল থেকে ওই জমিতে দুটি কক্ষ নির্মাণ করে দেন। গ্রামের মানুষের অনুদান থেকে নির্মাণ করা হয় বড় একটি পাঠকক্ষ।
জানা গেল, পাঠাগারে প্রতিদিন সাতটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ড দলিল, মুক্তিযুদ্ধের নানা বইসহ প্রায় চার হাজার বই। পাঠাগারের সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে ২০০ জন আজীবন সদস্য। সদস্যদের মাসিক চাঁদা মাত্র দুই টাকা। আশপাশের গ্রামের অনেকেই এই পাঠাগারের সদস্য। ১৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয় পাঠাগারটি। কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে দুজন নারী সদস্য বাধ্যতামূলক। আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে এই পাঠাগারের সভাপতি।
প্রতীতিতে কিছুক্ষণ: গোমস্তাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে আলীনগর। সম্প্রতি এক বিকেলে পাঠাগারে গিয়ে দেখা যায়, পাঠকক্ষে কিশোর থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী পাঠক সংবাদপত্র পড়ছেন। পাঠাগারে পাওয়া গেল প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সম্পাদক বেলাল উদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ আজাহার হোসেন, আলীনগর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রবিউল আউয়াল, স্থানীয় মো. বদরুদ্দোজা, মোক্তার হোসেন, মহসিন আলী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল হক, মনিরুল ইসলাম, গ্রন্থাগারিক আবদুল মতিনসহ আরও কয়েকজনকে। পাঠাগারের কথা জানতে এসেছি—শুনেই তাঁরা আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে তাঁদের প্রিয় পাঠাগারের গল্প শোনানো শুরু করলেন।
রবিউল আউয়াল জানালেন, এই পাঠাগারের সদস্য ছিলেন—গ্রামের এমন অনেকেই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কয়েকজনের নামও জানালেন তিনি। তাঁরা হলেন: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কৃষিবিদ আবদুস সাত্তার, দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত চিকিৎসক আশরাফুল হক, মেজর আবদুল বারী, কর্নেল আবদুস সামাদ প্রমুখ। পাঠাগারে উপস্থিত কয়েকজন তাঁদের গ্রামের ঐতিহ্য এই পাঠাগারের শুরুর কথা আর এত পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প শোনালেন।
পাঠাগারের পাঠকক্ষের এক কোনায় ২০ থেকে ২৫ মণ ধান চোখে পড়ল। জানা গেল, বোরো মৌসুমে পাঠাগারের জন্য এই ধান দিয়েছেন গ্রামবাসী। তবে অনেক ধান এখনো তোলা বাকি। বছরের দুই মৌসুমে গড়ে ধান ওঠে প্রায় ১০০ মণ।
তাঁদের কথা: একসময় প্রতীতি পাঠাগারের সদস্য ছিলেন আজকের কৃষি কর্মকর্তা আবদুল ওদুদ। তিনি বলেন, ‘প্রতীতির অর্থ হলো জ্ঞান, বোধ, বিশ্বাস। প্রতীতি পাঠাগারের বই পড়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছি।’ এই গ্রামেরই ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এনায়েত করিম জানালেন, প্রতীতি সাধারণ পাঠাগার থেকে তিনি শার্লক হোমস, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ পড়েছেন। গ্রামে এই পাঠাগার না থাকলে তাঁর বই পড়ার অভ্যাসই তৈরি হতো না।
পাঠাগারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নওগাঁর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. হাসানুজ্জামানের নানা স্মৃতি। ‘আমার বাবা আবদুল মালেক ছিলেন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাকালীন গ্রন্থাগারিক। ছেলেবেলায় বাবা মারা যান। বাবার কারণে ওই পাঠাগারের প্রতি অসাধারণ এক আকর্ষণ ছিল। এই পাঠাগারের অনেক বই আমি পড়েছি।’ বলেন হাসানুজ্জামান।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম আশরাফুল হক বলেন, ‘শুরু থেকে পাঠাগারটির সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ব হয়। আমার প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম পাঠাগারকে আমাদের মতোই ভালোবাসবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (গোমস্তাপুর-নাচোল-ভোলাহাট) আসনের সাংসদ জিয়াউর রহমান প্রতীতি সাধারণ পাঠাগার সম্পর্কে বলেন, ‘পাঠাগারটি দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষের জ্ঞানচর্চায় ভূমিকা পালন করছে। এটা ওই গ্রামের মানুষের গর্ব।’

No comments

Powered by Blogger.