চরাচর-চেতনায় অনুভূতিতে '৭১ by অরবিন্দ দাশ
চেতনায় '৭১। '৭১-এর অনুভূতি। দিকে দিকে বিভীষিকার স্মৃতি। শত শত স্বজনহারার সীমাহীন আর্তি। এরই আলোকে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার চিত্র। পাকিস্তানি বাহিনী আর মুুক্তিবাহিনী উভয়পক্ষ মারমুখী। পাকিস্তানিরা যাকে পায়, তাকে মারে। ভয়ে, আতঙ্কে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যায়। অনেকে থেকে যায়।
'৭১-এর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৮ ঘটিকা। স্থান মাস্টার কোয়ার্টার্স, হবিগঞ্জ। সান্ধ্য-প্রার্থনা শেষে চা পানরত। সঙ্গে আমার এক ছাত্র। নাম সিরাজ। সে আমার খোঁজ নিতে এসেছিল। তা ছাড়া আমাকে দেখাশোনার জন্য একটি ছেলে ছিল। নাম বিধু। মোট আমরা তিনজন।
হঠাৎ দরজায় নক্। দরজা খুলে দেখি, চারজন পাকিস্তানি সেনা। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ভীতিজনক চেহারা। আমি হতভম্ব। নির্বাক। এসেই ওরা আমাকে বলে, 'তোমরা পাস্ আর্মস্ হ্যায়, অ্যামুনেশন হ্যায়, স্টোন হ্যায়, মসি হ্যায়, আভি নেকালো। তোমরা জানো নেকাল কো ওয়াস্ত মেরা আতা হ্যায়।' উত্তরে বলি, 'হাম তো গরিব স্কুল মাস্টার হ্যায়, মেরা পাস্ কোস্ নেহি হ্যায়।' ওরা কি তা বোঝে? ওদের কথা ওরা বলতেই থাকে। আর আমার বিছানা-বালিশ ছিঁড়ে তছনছ করে দিল। একপর্যায়ে আমাকে ঘুষি মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। দাঁত নড়ে গেল। যা পরে ফেলে দিতে হয়েছে। আমার পাশে বসা ছাত্রটিকে বেদম মারধর করে বলতে লাগল, তুম কিয়াসে হিয়াপর আতা হ্যায়? তুম মুক্তিবাহিনী হ্যায়। মালাউনকা পাস কিয়াসে মোলাকাত করতা হ্যায়? ইত্যাদি। সে মিনতি ভরে বলল, নেহি নেহি, হাম্ মুক্তিবাহিনী নেহি। উনকো মেরা ওস্তাদ হ্যায়, উনকো দেখনেকা ওয়াস্ত আতা হ্যায়। ওরা তার কথায় কানই দেয় না। ওরা ওদের কথা বলে আর মারে। এরই মধ্যে ওরা আমার ঘর ওপর-নিচ তন্ন তন্ন করে দেখে নিল। আর্মস অ্যামুনেশন কিছুই পেল না।
আমি নির্বাক। হঠাৎ আমাকে বলল, তুম কাপড়া পর। আমার যে ছেলেটা ছিল, তাকেও কাপড় পরতে বলল। আমি একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম, ছেলেটাকেও একটা জামা পরতে দিলাম। বুঝতে পারছিলাম_তাদের বললাম, মেরা জান ভিখ্ দিজিয়ে হুজুর।
ওরা তখন আমাকে বলল, তুম্ মুসলমান বনেগা? আমি বললাম, 'আপ যো বলেগা। আমাকে বলল, কলেমা পড়। আমি বললাম, জানতা নেহি। ওরা বলে, আভি জানতা হ্যায়। আমি বলি, জানতা নেহি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিদায় হজ পাঠের কথা। সেখানে পড়িয়েছিলাম, আউজুবিল্লাহি মিনাশশাইত্বানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। ও কথা বলতেই ওরা বলে, ঠিক হ্যায় তুম জানতা নেহি, ঝুট বাত বলতা হ্যায়। আমি বললাম, হাম জানতা নেহি, ইস্সে কলমা হ্যায়। এসব কথা বলাবলির পর ওরা আমাকে বলল, তুমকো স্কুলকা মৌলভি সাহেব কো পাস সব সমজ লিও। মেরা ফের আতা হ্যায়।
আমার হাতের ঘড়ি, আংটি, রেডিও ও নগদ হাজারপাঁচেক টাকা যা ছিল সব নিয়ে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তখন রাত ১০টা।
'জীবন নিতে এসেছিল যারা,/জীবন দিয়ে চলে গেল তারা,/অসুর সুররূপে ধরিল যখন,/কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হল মোর মন,/যাঁর আশীষে বাঁচিল এ জীবন,/বার বার প্রণমি তাঁর চরণ।'
৪০ বছর আগের কথা। দুঃখের কথা। সে কথা ব্যথা হয়ে আজও জাগে মনে। শুধু ভাবি আর ভাবি, কেমন করে বেঁচে গেলাম সে কালরাত্রি।
অরবিন্দ দাশ
হঠাৎ দরজায় নক্। দরজা খুলে দেখি, চারজন পাকিস্তানি সেনা। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ভীতিজনক চেহারা। আমি হতভম্ব। নির্বাক। এসেই ওরা আমাকে বলে, 'তোমরা পাস্ আর্মস্ হ্যায়, অ্যামুনেশন হ্যায়, স্টোন হ্যায়, মসি হ্যায়, আভি নেকালো। তোমরা জানো নেকাল কো ওয়াস্ত মেরা আতা হ্যায়।' উত্তরে বলি, 'হাম তো গরিব স্কুল মাস্টার হ্যায়, মেরা পাস্ কোস্ নেহি হ্যায়।' ওরা কি তা বোঝে? ওদের কথা ওরা বলতেই থাকে। আর আমার বিছানা-বালিশ ছিঁড়ে তছনছ করে দিল। একপর্যায়ে আমাকে ঘুষি মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। দাঁত নড়ে গেল। যা পরে ফেলে দিতে হয়েছে। আমার পাশে বসা ছাত্রটিকে বেদম মারধর করে বলতে লাগল, তুম কিয়াসে হিয়াপর আতা হ্যায়? তুম মুক্তিবাহিনী হ্যায়। মালাউনকা পাস কিয়াসে মোলাকাত করতা হ্যায়? ইত্যাদি। সে মিনতি ভরে বলল, নেহি নেহি, হাম্ মুক্তিবাহিনী নেহি। উনকো মেরা ওস্তাদ হ্যায়, উনকো দেখনেকা ওয়াস্ত আতা হ্যায়। ওরা তার কথায় কানই দেয় না। ওরা ওদের কথা বলে আর মারে। এরই মধ্যে ওরা আমার ঘর ওপর-নিচ তন্ন তন্ন করে দেখে নিল। আর্মস অ্যামুনেশন কিছুই পেল না।
আমি নির্বাক। হঠাৎ আমাকে বলল, তুম কাপড়া পর। আমার যে ছেলেটা ছিল, তাকেও কাপড় পরতে বলল। আমি একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম, ছেলেটাকেও একটা জামা পরতে দিলাম। বুঝতে পারছিলাম_তাদের বললাম, মেরা জান ভিখ্ দিজিয়ে হুজুর।
ওরা তখন আমাকে বলল, তুম্ মুসলমান বনেগা? আমি বললাম, 'আপ যো বলেগা। আমাকে বলল, কলেমা পড়। আমি বললাম, জানতা নেহি। ওরা বলে, আভি জানতা হ্যায়। আমি বলি, জানতা নেহি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিদায় হজ পাঠের কথা। সেখানে পড়িয়েছিলাম, আউজুবিল্লাহি মিনাশশাইত্বানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। ও কথা বলতেই ওরা বলে, ঠিক হ্যায় তুম জানতা নেহি, ঝুট বাত বলতা হ্যায়। আমি বললাম, হাম জানতা নেহি, ইস্সে কলমা হ্যায়। এসব কথা বলাবলির পর ওরা আমাকে বলল, তুমকো স্কুলকা মৌলভি সাহেব কো পাস সব সমজ লিও। মেরা ফের আতা হ্যায়।
আমার হাতের ঘড়ি, আংটি, রেডিও ও নগদ হাজারপাঁচেক টাকা যা ছিল সব নিয়ে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তখন রাত ১০টা।
'জীবন নিতে এসেছিল যারা,/জীবন দিয়ে চলে গেল তারা,/অসুর সুররূপে ধরিল যখন,/কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হল মোর মন,/যাঁর আশীষে বাঁচিল এ জীবন,/বার বার প্রণমি তাঁর চরণ।'
৪০ বছর আগের কথা। দুঃখের কথা। সে কথা ব্যথা হয়ে আজও জাগে মনে। শুধু ভাবি আর ভাবি, কেমন করে বেঁচে গেলাম সে কালরাত্রি।
অরবিন্দ দাশ
No comments