বাজার পরিস্থিতি ও টিসিবির ভূমিকা by ডা. এম এ বারী

বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল ক্ষেত্রের অপর নাম বাজার। বাজার পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। একটি অশুভ চক্র বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা তাদের খেয়ালখুশিমতো মুনাফা লুটে নিজেদের পকেট ভারী করে চলেছে। সিংহভাগ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দেশে এটা অবশ্যই একটি অসহনীয় পরিস্থিতি।


আশা করি, এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ খুবই কম। প্রবাসে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পত্রপত্রিকায় প্রায়ই দেখি, এ সংবাদটি বড় অংশজুড়ে থাকছে। বিশ্বজুড়েই খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী; এবং জলবায়ুর পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে বৈরী ভূমিকা পালন করছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সামনের দিনগুলো আরো কঠিন হয়ে উঠবে। একদিকে উৎপাদন হ্রাস এবং চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ঘাটতি, অন্যদিকে অতি মুনাফালোভী চক্রের কারসাজি বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থাপনার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। মহাজোট সরকার এরই মধ্যে তাদের শাসনকালের দুই বছর অতিক্রম করেছে। এ দুই বছরে সরকারের অর্জন কম নয়। এক দল নবীনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে তাঁর এবারকার শাসনযাত্রা শুরু করেছিলেন। এসব নবীনের মধ্যে ব্যর্থতার চাদর গায়ে মুড়িয়েছেন_সে সংখ্যাও কম নয়। তাঁদের অনভিজ্ঞতা-অদূরদর্শিতা-অদক্ষতার আশঙ্কা শুরুতেই করা হয়েছিল। বিরোধীদের রাজনৈতিক কূটকৌশল মোকাবিলা করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে অনেকেই ব্যর্থ হবেন_এ আশঙ্কাও শুরুতেই করা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের অনেক বড় বড় অর্জন নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি। যেমন_বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিদ্যুৎ খাতের অবনতি এবং কারো কারো নিজ স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা সরকারের সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।
আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে অবগত হচ্ছি, প্রায় সব ব্যাপারেই প্রধানমন্ত্রীকে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় তা কাম্য নয়। যদি প্রধানমন্ত্রীকেই সব দিকে লক্ষ রাখতে হয়, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা কী করেন? এরই মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী নেতিবাচকভাবে আলোচনায় আছেন। তাঁদের কথাবার্তা, কর্মকৌশল_কোনোটাই সুখকর ঠেকছে না। নতুন করে যোগ হয়েছে শেয়ারবাজারের অস্থিরতা।
ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে। বাজার একটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর জন্য। সরকারের তরফ থেকেও বারবার বলা হচ্ছে, সিন্ডিকেট কারসাজি করে বাজার অস্থিতিশীল করে রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সিন্ডিকেটের কাউকে কি এ যাবৎ শনাক্ত করে তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা গেছে? কেন যায়নি, এ প্রশ্নের জবাব দায়িত্বশীলদেরই দিতে হবে। ভোজ্য তেল ও চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি একেবারেই অযৌক্তিক। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তেরও একাংশ তাঁদের খাদ্যতালিকায় বাধ্য হয়ে পরিবর্তন এনেছেন, এমন সংবাদও চোখে পড়েছে। টিসিবি নামে বাংলাদেশে পুরনো একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানটির অতীত ঔজ্জ্বল্য স্মরণযোগ্য। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই টিসিবিকে সক্রিয় করার তাগিদ বারবার আসছে বটে, কিন্তু 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার' মার্কা প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর কিংবা গতিশীল করা হয়নি। তহবিল, জনবল, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সক্ষমতা_সবকিছুতেই এ প্রতিষ্ঠানটি ধারণ করে আছে বিবর্ণ চিত্র। দুর্মুখরা বলেন, সরকারের একটি অসাধু মহল টিসিবিকে কার্যকর কিংবা গতিশীল করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। অভিযোগটি কতটা সত্য জানি না, তবে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। টিসিবিকে সক্রিয়, কার্যকর ও গতিশীল করা গেলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যেত। অতীতে টিসিবি অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। টিসিবির যে দৈন্যচিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল, তা-ও দুঃখজনক। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে যত দ্রুত ভাববেন, ততই মঙ্গল। বাজারে মূল্যতালিকা টাঙিয়ে দিয়ে, শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের লোকদেখানো বাজার পরিদর্শন করে কিংবা বাণিজ্যমন্ত্রীর দৃশ্যত হুমকি-ধমকিতে বাজার স্থিতিশীল হবে না। অস্থিতিশীলতার উৎস সন্ধানটাই জরুরি। সারা দেশে রেশনিং পদ্ধতি চালুর কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। ওএমএস কার্যক্রম এখন যেভাবে চলছে এবং একেকটি ওএমএস কেন্দ্রে মানুষের যে ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে (টেলিভিশনে তা দেখেছি), তাতে এটাই প্রতীয়মান হয়, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এসব মানুষ রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। তারা মোটা ভাত, মোটা কাপড়েই সন্তুষ্ট। তারা চায় রাতে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে। কিন্তু তারা যখন এটুকু থেকে বঞ্চিত হয়, তখন নীরবে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। কারণ চারদলীয় জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন তারা মেনে নেয়নি মন থেকে। তা ছাড়া মানুষ চেয়েছিল, প্রগতিশীল এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশের শাসনভার পাক। তাদের এসব প্রত্যাশা হোঁচট খেতে শুরু করেছে। সময় এখনো বাকি আছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের কথার চেয়ে কাজের প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। আমার বাড়ি বাংলাদেশের একটি গ্রামে। প্রায় প্রতিবছর বাড়িতে যাই এবং গ্রামে কাটাই। গত অক্টোবরে গিয়ে আমার একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। দেখলাম, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন_তাদের অচেতন করে রাখার সব ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। খুব নীরবে লক্ষ করেছি_বাজার, আইনশৃঙ্খলা এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে তারা ক্রমেই ক্ষুব্ধ হচ্ছে।
তারা চায়, সরকার ন্যায্য মূল্যে তাদের খাদ্যপণ্য পেঁৗছে দিক, জীবনের নিরাপত্তা দিক। কাজেই মানুষকে যেনতেনভাবে বোঝানোর চেষ্টা করাটা হবে মারাত্মক ভুল।
ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারকে খাদ্যপণ্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। আড়তদার, মজুদদার ও অতি মুনাফালোভী চক্রকে উৎখাত করতে হবে সবকিছুর ঊধর্ে্ব উঠে। এমনটি করতে গিয়ে যদি সরকার সমর্থক কারো কারো গায়ে হাত পড়ে, তাহলে সে ক্ষেত্রেও থাকতে হবে আপসহীন। টিসিবিকে কার্যকর ও গতিশীল করতেই হবে। তাদের জনবল বৃদ্ধিসহ তহবিল দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত রাখতে অধিকতর সতর্ক থাকা চাই। দুর্নীতি বাংলাদেশের বড় একটি ব্যাধি। যত বেশি সরকারি প্রকল্প, তত বেশি লুটপাটের মহড়া চলে। এই যে রেশনিং পদ্ধতি চালুর কথা বলা হচ্ছে, তা যদি হয়, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা এমন করতে হবে, যাতে লুটেরা গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠতে না পারে। ওএমএস কার্যক্রম স্বচ্ছভাবে চলছে না_এ অভিযোগ উঠেছে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারের দেওয়া সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সরকারের আর্থিক লোকসান হচ্ছে। কিন্তু ফায়দা লুটছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী। এ বিষয়গুলো সরকারকে আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে দরকার হয়ে পড়েছে মন্ত্রিসভার রদবদল। যাঁরা রাজনীতিতে প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী এবং সৎ, তাঁদের সামনে আনতে হবে সরকারের স্বার্থেই। নবীনরা থাকুন তাঁদের পেছনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিরোধী পক্ষ ইস্যু পেয়ে যাচ্ছে সরকারের কারণেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এখন অতি জরুরি বিষয়। বাজারের ভল্লুকদের খুঁজে বের করুন, যারা সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এটা অসত্য নয় কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে সে তুলনায় আরো বেশি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের মুখের গ্রাস নিয়ে চক্রান্ত চালানো যাবে না। তিনি আরো বলেছেন, প্রয়োজনে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রেখে খাদ্য আমদানি করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য অত্যন্ত সাধুবাদযোগ্য।

লেখক : সুইডেনপ্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

No comments

Powered by Blogger.