'মরা যে মরল তার জন্য কান্দি না...' by মোফাজ্জল করিম

আমার অনুজপ্রতিম কনিষ্ঠ সহকর্মী অচ্যুতপদ গোস্বামী কাউকে বড় রকমের উল্টাসিধা কিছু করতে দেখলে প্রায়ই তার হবিগঞ্জি বাচনভঙ্গিতে বলত, 'স্যার, মরা যে মরল তার জন্য কান্দি না, কান্দি, যমে যে বাড়ি চিনল!' তাৎক্ষণিকভাবে হা-হুতাশ করার চেয়ে তার বেশি দুশ্চিন্তা, যে কুদৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো সেটা অনুসরণ করে ভবিষ্যতে আরো না জানি কত অঘটন ঘটে যায়!


গ্রাম্য এই প্রবচনটির উৎপত্তি সেই প্রাচীনকালে, যখন বাংলাদেশে ওলাউঠা (পোশাকি নাম কলেরা) ও বসন্তরোগে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ওই সময় এক গ্রামে কলেরায় যখন সব বাড়িতেই মানুষ মরছে, তখন ওই গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ একটি বাড়ি দৈবক্রমে বেঁচে যায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল, ওই বাড়ির এক জোয়ান ছেলেও ওলাইবিবির (হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ওলাউঠার অধিষ্ঠাত্রী অপশক্তি ছিল এই দানবীই) কোপদৃষ্টিতে পড়ে ঘণ্টা-দুয়েকের ভেদবমির পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সেই শোকবিহ্বল পরিস্থিতিতে বাড়ির এক ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধা নাকি ওই মর্মান্তিক উক্তিটি করেছিলেন। চারদিকে যা ঘটছে, তা দেখতে দেখতে ওই বুড়িমার মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে, 'মরা যে মরল তার জন্য কান্দি না...।'
আমার কেন যেন মনে হয়, আমরা ধরে নিয়েছি, আমরাই রোজ কিয়ামতের আগে বাংলাদেশের শেষ প্রজন্ম, আমাদের পর এ দেশে বাস করার আর কেউ থাকবে না। আফটার মি দ্য ডেলিউ্যজ। অথবা আমরা ১৫ কোটি মানুষ গাদাগাদি করে বসে আছি কারাগারের ভেতর ফাঁসির সেলে, অপেক্ষায় আছি রাত ১২টার পর সবাইকে এক দড়িতে একসঙ্গে লটকানো হবে ফাঁসিকাষ্ঠে। তারপর সব ফক্কা। শূন্যতায় ডুবে যাবে চরাচর। এক অন্তহীন নৈঃশব্দ গ্রাস করবে সৃষ্টিহীন সৃষ্টিকে।
তা না হলে আমরা আমাদের নাসিকার এক ইঞ্চি দূরে দেখতে পাচ্ছি না কেন? নাকি ইচ্ছা করেই দেখছি না! আমরা কি নিশ্চিত যে আমরা অনন্তকাল এই দেশে থাকব, এই দেশের আলো-বায়ু-জল, চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আশ মিটিয়ে, নুলো ডুবিয়ে ভোগ করতে থাকব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যত দিন টিকে থাকবে তত দিন?
তা-ই যদি হয়, তবে আমরা 'ভবিষ্যৎ প্রজন্ম'-'ভবিষ্যৎ প্রজন্ম' বলে এত মরাকান্না কাঁদি কেন? আমরা নাকি সঞ্চয় করি, জমি কিনি, বাড়ি বানাই, ব্যাংকব্যালেন্স গড়ে তুলি, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা রাখি, ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দিই- সবই আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করে। আমার প্রশ্ন হলো, আমরা যে নির্মমতার সঙ্গে গাছ কেটে সাফ করছি, খালবিল-নদীনালা ভরাট করে 'ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষকীট'-এর জন্য স্বপ্নপুরী নির্মাণের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছি এবং সেই একইভাবে 'মূল্যবোধিবৃক্ষও' নিধন করে চলেছি সমানে, তাতে আমাদের বড় আহ্লাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন থাকবে তো? আর যদি থাকেও তবে প্রজন্মের বেশির ভাগই যে পরস্পরের টুঁটি কাটাকুটিতে অকালে বাজে খরচ হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা দেবে কে?
দেশ থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে শীতলাদেবী (হিন্দুমতে বসন্তরোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী)-ওলাইবিবিরা বিদায় হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু প্রকৃতি নাকি শূন্যতা পছন্দ করে না। তাহলে এদের শূন্যতা পূরণ করল কাদের দিয়ে? 'কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি...।' 'স্যার, টেনশন নিয়েন না, আমরা আছি, আমাগো টেরাই করে দেখতে পারেন।' দেখা গেল, অনেক হাত উঠেছে, সারা বাংলাদেশ থেকে। 'কে তোমরা?' 'স্যার, আমি সড়ক দুর্ঘটনা', 'আমি লঞ্চডুবি', 'আমি গুম-খুন', 'আমি নারী নির্যাতন', 'আমি টেন্ডারবাজি', 'আমি দখলবাজি', 'আমি দলীয়করণ', 'আমি ফরমালিন', 'আমি ...।' 'থামো, থামো। তোমরা কি সবাই মাটির প্রদীপ?' 'কী যে কন স্যার! মাটির প্রদীপ হইবার যামু ক্যান? মাটির চেরাগ হইয়া কি আর আপনাগো এত বড় ঠিকা লইবার পারি? একবার টেরাই কইরা দেহেন, পাবলিকেরে দেওয়া আপনাগো সব ওয়াদা কেমুন পূরণ কইরা দেই।'
যমের হাতেগোনা কয়টি কালো হাত- ওলাউঠা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর এখন সহস্র হাত হয়ে বাংলাদেশ নামক একদা কোন কালের এক ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে চারদিক থেকে চেপে ধরেছে। এদের এই শ্বাসরোধকারী মরণচাপ থেকে এই অসহায় দেশটিকে যাঁদের বাঁচানোর কথা, তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শশব্যস্ত রোদটুকু থাকতে থাকতে খড়টুকু শুকাতে। বলা তো যায় না, হঠাৎ কখন আবার রোদ চলে গিয়ে বজ্রবৃষ্টি নামে! তাঁরা বিশ্বাস করেন, 'যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ'-নীতিতে। এঁরা প্রেয়োবাদী (হেডোনিস্ট) চার্বাকমুনির জানকবুল শিষ্য, ঋণংকৃত্তা (কবজি ডুবিয়ে) ঘৃতং পিবেৎ- তাঁদের জীবনের মূলমন্ত্র। তাঁরা জি কে টি কে (গাছেরটাও খাই, তলারটাও কুড়াই) দলের লোক।
এই যে 'উল্টেপাল্টে দে মা চেটেপুটে খাই' তাণ্ডবনীতি, এর শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকে। পাকিস্তানি আমলে পশ্চিমাদের কনুইয়ের গুঁতোয় বাঙালি চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো কিছুতেই সুবিধা করতে পারত না। মুষ্টিমেয় কিছু লোক পাঞ্জাবিদের মোসাহেবি করে, উচ্ছিষ্ট খেয়ে মোটামুটি ভালোই ছিল। স্বাধীনতার পর এক শ্রেণীর বাঙালি কোমর বেঁধে শুরু করল দখলবাজি, পারমিটবাজি, চোরাকারবারি, মজুতদারি- এসব। স্বাধীন দেশে তারা রাতারাতি রাস্তার লোক থেকে হয়ে গেল এসিওলা কামরায় গদিমোড়া চেয়ারে বসা 'বস'। তাদের রিকশা হয়ে গেল টয়োটা, পরে দ্রুত প্রমোশন পেয়ে পাজেরো-প্রাডো-মার্সিডিস। পুরান ঢাকার কানাগলি টু সোজা নন-স্টপ বনানী-গুলশান-বারিধারা।
হোক। তাদের কপালে যা লেখা আছে তা-ই তো হবে। হোক। কিন্তু একদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ করব অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, ছেলেদের যুদ্ধে পাঠাব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে, অন্যদিকে সুযোগ পাওয়া মাত্র রিকশা থেকে নেমে ছেঁড়া স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে হাজার ডলারের স্যুট ও ৩০০ ডলারের জুতা পরে লাফ দিয়ে চড়ে বসব মার্সিডিসে এবং জানালা দিয়ে মুখ বের করে কাজের লোককে বলব, দুই নম্বর গাড়িটা যেন খোকাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে, আর বেগম সাহেবের গাড়ি যেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ... ইত্যাদি-ইত্যাদি। কত দ্রুত বদলে গেল দৃশ্যপট। ঢাকা শহরের আকাশ যেমন স্বাধীনতার পর দ্রুত ঢাকা পড়ে গেল হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে, দেশটা তেমনি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভরে গেল হাইফাই মানুষে। এরা কার আগে কে বিত্তশালী হবে, সদরঘাটের ছক্কু মিয়ার হোটেল ছেড়ে এক লাফে গিয়ে রমনা এলাকার পাঁচতারা হোটেলে খানা খাবে, সকালে ঘুম থেকে উঠে অতিরিক্ত একটি হাঁচি ও দুটি কাশি দিলে কত তাড়াতাড়ি সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যাবে চেক-আপ করাতে, সমাজে জাতে ওঠার সেই ইঁদুর-দৌড়ে জান সঁপে দিল। পাকিস্তানি আমলে বাঙালিদের ভীষণ ক্ষোভ ছিল পশ্চিমা '২২ পরিবারের' বিরুদ্ধে। কথায় কথায় আমরা তাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে আমাদের সব দুঃখ-দুর্দশার জন্য সংগত কারণেই দায়ী করতাম, গালাগাল দিতাম তাদের। আমরা দেশের (তখনকার) সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বোঝালাম, তাদের খপ্পর থেকে বের হয়ে সাম্য, ন্যায়নীতি, সততা-সাধুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করব শোষণমুক্ত এক নতুন সমাজব্যবস্থা। বাকি ইতিহাস? বাকি ইতিহাস ২২ পরিবারের জায়গায় ২২০০ পরিবারের ইতিহাস, ওটা 'রুপালি পর্দায় দেখুন'!
আমি ও আমার মতো অনেকেই পাকিস্তানি আমলেও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছি। তখন প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ, প্রশাসনে দলীয়করণ, মন্ত্রী বা এমএনএ-এমপিএ (সে আমলের জনপ্রতিনিধি) সাহেবের টেলিফোন পেয়ে জামিন দেওয়া বা থানায় মামলা নেওয়া-না নেওয়া ইত্যাদি কখনো শোনা যেত না। এমনকি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা আদালতে 'রিমান্ড'-এর জন্য আবেদনও করতেন খুব কম। আর এখন তো এটা ডাল-ভাত- ডালের যা দাম, বলা উচিত পান্তাভাত- হয়ে গেছে।
এখন সরকারি চাকরি পেতে হলে, চাকরিতে ভালো জায়গায় পোস্টিং পেতে চাইলে, প্রমোশন পেতে হলে, শুধু যোগ্যতা-দক্ষতা থাকলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির 'ডিএনএ টেস্ট' লাগবে। ছাত্রজীবনে সে লী-করত, না দ-করত, না শি-, এখন কোন 'মজহাবে' বিশ্বাসী, এ-, না বি-, নাকি জা-, আগে এসব খোঁজ নাও, তারপর না চাকরি-বদলি-প্রমোশন! এই পরীক্ষায় যদি সে পাস করে, অর্থাৎ আমরা যে সৈয়দ বংশের লোক চাই সেই খানদানের হলে যোগ্যতার মাপকাঠিতে সে অখাদ্য হলেও কিছু যায় আসে না- যোগ্যতা ধুয়ে কি পানি খাব নাকি- তাকে বসিয়ে দাও অমুক জায়গায়। তার যোগ্যতা নেই, মেরুদণ্ডও তো নেই, ফলে আলহামদুলিল্লাহ, তাকেই 'খুঁজছে বাংলাদেশ'।
পাকিস্তানি আমলে যে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা সবাই ড্রাই ওয়াশ করা তুলসিপাতা ছিলেন, সব আমলা-কামলা ছিলেন ফেরেশতা, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দুর্নীতি সব আমলেই ছিল, অদক্ষতা, অযোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি- সবই ছিল, তবে এখনকার মতো এত মহামারি আকারে ছিল না। খানা-খন্দক-ডোবা, বড়জোর পুকুরচুরি ছিল। তাই বলে বিল চুরি, নদী চুরি, ব্রিজ চুরি, তেল-গ্যাস চুরি- এসব শোনা যায়নি। তেমনি কোনো চোর ধরা পড়লে তাকে বাঁচানোর জন্য জান বাজি রেখে কর্তাব্যক্তিদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথাও শোনা যায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটা কথা চাউর হয়েছিল- ব্রিটিশরা জানত শাসন, পাকিস্তানিরা শোষণ, আর মাশআল্লাহ চাপাবাজ বাঙালিরা জানে ভাষণ।
কিন্তু এই করে করে তো আমরা চার দশক পার করলাম, আর কত? নজরুলের সেই বিখ্যাত গান, 'ঘুমাইয়া কাযা করেছি ফযর/তখনও জাগিনি যখন জোহর/হেলায়-খেলায় কেটেছে আসর/মগরিবের আজ শুনি আযান'- এসব গান শুধু গাইলাম আর মাথা দোলালাম, আমল করলাম না। দক্ষিণবঙ্গের এক নেতা, যাঁর নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, একবার নাকি বরিশাল অঞ্চলে এক জনসভায় বলেছিলেন, চীন জাগল, জাপান জাগল, ইরান-তুরান হগলতে জাগল, ঘরের কাছে ঝালকাঠি হেইডাও জাগল, হেই মিয়ারা, তোমরা জাগবা কবে? ...গায় বাঁশ গেলে?
নাকি আমরা ঠিক করেছি আমরা জাগবই না, জেগে কী হবে? জাগা মানেই তো অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থানের জন্য ছোটাছুটি করা। তার চেয়ে ঘুমিয়ে থাকি, টানা এক ঘুম দিয়ে রোজ কিয়ামতের দিন উঠে রিলিফের থালা হাতে নিয়ে লাইনে গিয়ে দাঁড়াব (অবশ্যই চেষ্টা থাকবে টাল্টিবাল্টি করে লাইনের সামনের দিকে দাঁড়াতে)।
তা না হয় দাঁড়ালাম! কিন্তু আমরা কী করে শিওর হয়ে গেলাম যে এর আগেই কেউ আমাদের গজাল লাগানো ডাণ্ডা দিয়ে গুঁতিয়ে শুধু জাগিয়েই তুলবে না, পেটাতে পেটাতে খোঁয়াড়ে নিয়ে ঢোকাবে না? নিউটনের তৃতীয় সূত্রটি এত শিগগির ভুলে গেলে চলবে কেন- 'এভ্রি অ্যাকশন হ্যাজ ইটস্ ইকুয়্যাল অ্যান্ড অপজিট রিঅ্যাকশন।' প্রতিযোগিতার রাজনীতিকে এখন প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আমরাই পরিণত করেছি। অতএব এর যে পরিণাম, তার জন্য তৈরি তো থাকতেই হবে।
এ জন্যই শুরুতে অচ্যুতপদকে স্মরণ করে বলেছিলাম, যমে যে বাড়ি চিনে ফেলল সেটা ভেবেই আমরা দুশ্চিন্তিত। আপনারা ৪০ জনকে গরু-ছাগলের মতো তিতি-তিতি হেঁট-হেঁট বলে নাজিমউদ্দিন রোডের খোঁয়াড়ে নিয়ে ঢুকিয়েছেন, ভবিষ্যতে যে এই সংখ্যাটির ডান দিকে একটা শূন্য বসবে না তার নিশ্চয়তা কী? একজন উচ্চশিক্ষিত পত্রিকা সম্পাদককে জেল দিয়ে, রিমান্ডে পাঠিয়ে, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করলেন, অন্যরা যে তার ১০ গুণ বেশি করবে না, তা মনে করার কি কোনো কারণ আছে? আপনারা দলীয়করণ করে সরকারি চাকরিতে একজন গরিব বিধবার অন্ধের যষ্টি ছেলের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছেন, এরপর যে নানা কৌশলে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেদলীয়, বিজাতীয় লোকদের, এমনকি ঈশপের গল্পের জলপানরত সেই মেষশাবকের জন্যও আউট অব বাউন্ডস্ হয়ে যাবে না, তার গ্যারান্টি কী? আপনারা রাজনীতি করুন, যত ইচ্ছা রাজদুর্নীতি করুন, কিন্তু আপনাদের কারণে একটি গরিব, অসহায়, নিরীহ ছেলে বা মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে, এটা কেমন কথা!
আর যেসব চান্স মহাম্মদ সব আমলে চান্স নেওয়ার অপেক্ষায় থাকে, সেই দুর্নীতিবাজরা তো তাদের ফিস দ্বিগুণ-তিন গুণ বাড়িয়ে দেবে। তাদের ভাষা হবে তখন এ রকম- ওই আমলে আমার এই চেয়ারে যিনি বসতেন, তাঁর রেট ছিল ১০ হাজার। এখন ওটা ভুলে যান। টুয়েন্টি থাউজেন্ডের এক পয়সা কমে হবে না। আর এপিএস সাহেবরা বলবেন, মাত্র ৭০ লাখ টাকার জন্য এত বড় রিস্ক নেওয়া যাবে না। আরো দুই বস্তা মাল তুলুন গাড়িতে, তারপর দেখা যাবে। আর কর্তাব্যক্তিদের গৎবাঁধা বুলি তো আছেই- ওরা তো দেশটাকে শুষতে শুষতে শুঁটকি মাছ করে রেখে গেছে, এখন আমাদের ছেলেরা যদি একটু টেন্ডার, একটু চান্দা, একটু দখল-টখল নিয়ে খেলা করে তো দোষের কী আছে। আপনারা শুধু আমাদেরটাই দেখেন, ওরা যে...।
ঠিকই বলেছেন, দোষের কিছু নেই। ওই একটু-আধটু পেঁয়াজের দোষে কী যায়-আসে! তবে কি না আপনাদের এবং ওনাদের এই 'ব্লেইম গেইমের' ফলে নিরীহ দর্শকদের যে জীবন তেজপাতা হয়, সেটা কি একটিবারও ভেবে দেখেছেন? আপনাদের পাটা-পুতাইলে ঘষাঘষিতে বেচারা মরিচের যে জান যায়, তার কী হবে?
আপনারা কি একটিবার ভেবে দেখেছেন, আপনি বা আমি, অর্থাৎ এখন যারা আমরা নাট্যমঞ্চ দাবড়ে বেড়াচ্ছি, 'কত পুরাতন পাতার মতন আমিও তো একদিন/এই ধরণীর ধুলায় ঝরিয়া একদা হব বিলীন'? আপনার-আমার স্থান দখল করবে কিছু নতুন কুঁড়ি, নতুন পাতা, তাদের জন্য আমরা কি একটি বিষাক্ত শ্বাপদসঙ্কুল বৃক্ষশাখা রেখে যাচ্ছি? তারা কি আমাদেরই সন্তান না? কী উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছি আমরা? আপনি-আমি যদি দুর্নীতি-দুঃশাসন, কালো টাকা, সন্ত্রাস, গুম-খুনকে প্রশ্রয় দিই, আমাদের সন্তানরাও নিশ্চিতরূপে সেই পথে এগিয়ে যাবে। তখন আর সে পথ থেকে তাদের ফিরে আসতে বলার নৈতিক বলটুকুও আমাদের থাকবে না। হয়তো সেদিন আপনি-আমি থাকব না- এক অভিশপ্ত পিতা, এক দুঃখিনী মাতা হয়ে হয়তো ঘুমিয়ে থাকব কবরে। শান্তিতে? যদিও কামনা করি না, তবু মনে হয়, বোধ হয় না।
এখনো সময় আছে, আমার-আপনার জন্য নয়, আমাদের কোমলমতি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে, আসুন, ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করি। যে স্তম্ভগুলোর ওপর দেশ নামক অট্টালিকাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেই স্তম্ভগুলোতে স্পষ্ট ফাটল দেখা যাচ্ছে। এখনো সময় আছে, আসুন, সেই ফাটলগুলোকে মেরামত করে দালানটিকে বাঁচাই। মনে রাখবেন, এ দালানটি আপনার-আমার কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয়, কারো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বসতবাটি নয়, কেউ দানপত্র লিখে বা হেবা করে এটা দিয়ে যায়নি, এটা লাখ লাখ শহীদের রক্তে লেখা আমানত- আমরা শুধু এর সংরক্ষণকারী, কাস্টডিয়ান। এটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনো অধিকার আমাদের নেই।
আমার আজীবনের বন্ধু মরহুম শহীদুল্লাহ (সাবেক প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রপ্তানি) একবার বড় সুন্দর একটা কথা শুনিয়েছিল আমাকে : ইউ উইল হ্যাভ টু রেইজ ইওর অউন রোজ গার্ডেন, নোবডি উইল ডু ইট ফর ইউ। কথাটি আমি আপনাদের শোনালাম, হে প্রবল প্রতাপান্বিত মাননীয় রাজনীতিবিদ, এবং সেই সঙ্গে একটু যোগ করি : ... নোবডি উইল ডু ইট ফর ইউ- নাইদার ইন্ডিয়া, নর পাকিস্তান, নর ইউএসএ-ইউকে : অ্যান্ড অলসো নট এনিবডি এলস্।
৩০.৬.১২

No comments

Powered by Blogger.