মিসরে গণ-অভ্যুত্থান : কোন পথে আরব বিশ্ব by ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে মিসরের রাজপথের অভ্যুত্থানে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন আরব বিশ্বের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। কোন পথে এখন আরব বিশ্ব? সেখানে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, না কি ইসলামিক কট্টরপন্থীরা ক্ষমতা গ্রহণ করবে_এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে আলোচনার শেষ নেই।
তিউনিসিয়ায় দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলীর ক্ষমতার পতন ঘটল, সেই 'বিপ্লব' ছড়িয়ে গেল মিসরে। দীর্ঘ ৩০ বছরে যা মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি মিসরে, সেটাই ঘটল। সাধারণ মানুষ 'ঘুমন্ত' অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই জেগে উঠল, দখল করে নিল কায়রোর তাহরির স্কয়ার, অনেকটা চীনের বেইজিংয়ের তিয়ানমেন স্কয়ারের ঘটনাবলির মতো। ১৯৮৯ আর ২০১১ পার্থক্যটা অনেক, চীন থেকে মিসরের দূরত্বও কম নয়। মিল আছে এক জায়গাতেই, গণতন্ত্রের দাবিতেই আন্দোলন হচ্ছে। চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চীনা সমাজতান্ত্রিক সমাজে সেটা বোধ হয় চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু মিসর তো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। রাজপথের এই অভ্যুত্থান মিসরে কি আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? কিংবা গণতন্ত্রের এই ঢেউ কি তিউনিসিয়া থেকে আম্মান পর্যন্ত পেঁৗছতে পারবে? এ প্রশ্ন এখন অনেকের।
আরব বিশ্বে আদৌ কোনো গণতন্ত্র নেই। সৌদি আরবসহ জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ সনাতন আরব বিশ্বে রয়েছে পারিবারিক শাসন, রাজতন্ত্র। এই রাজতন্ত্রে সংসদীয় শাসন বলে কিছু নেই। কুয়েত কিংবা বাহরাইনের মতো দেশে সংসদ রয়েছে বটে, কিন্তু সেই সংসদ 'জনগণের সংসদ', এটা বলা যাবে না। সেখানে রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্বও নেই। এর বাইরে সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া কিংবা আলজেরিয়াতে রয়েছে এক ধরনের সমাজব্যবস্থা, যেখানে সেনাবাহিনীই হলো মূল চালিকাশক্তি। ইরাক ও সিরিয়ায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছিল বাথ পার্টির সহযোগিতায়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জমানায় বাথ পার্টি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত। এখন সাদ্দাম-পরবর্তী যুগে বাথ পার্টির অস্তিত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু মূল শক্তি নয়। শিয়ারা এখন সেখানে মূল শক্তি। অন্যদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনী বাথ পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত হাফিজ আল আসাদ ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। ক্ষমতায় তাঁর উত্থান ঘটেছিল সেনাবাহিনী থেকেই। এ ক্ষেত্রে বাথ পার্টি হচ্ছে তাঁর মাধ্যম। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বাসার আল আসাদ এখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। এখানে বলে রাখা ভালো, সিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করেছিল (ফ্রান্সের কাছ থেকে) ১৯৪৬ সালে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মিসরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করেছিল ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক। ১৯৬১ সালে সিরিয়া আবার আলাদা হয়ে যায়। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে বাথ পার্টি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
আরব বিশ্বের রাজনীতি বুঝতে হলে এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হবে। সেনাবাহিনী আরব বিশ্বের রাজনীতিতে একটি শক্তি। তিউনিসিয়ায় সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পতন ঘটে জাইন এল আবিদিন বেন আলীর, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। আজ সেনাবাহিনী হোসনি মুবারকের পাশে না দাঁড়ানোর ফলে তাঁকেও সরে যেতে হলো। হোসনি মুবারক এখন ক্ষমতায় নেই। কিন্তু সেনাবাহিনীর বর্তমান ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। মিসরে সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা নিশ্চিত করেছিলেন কর্নেল গামাল আবদুল নাসের। নাসের সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার্স ক্লাব গঠন করেছিলেন ১৯৪৯ সালে। এই ফ্রি অফিসার্স ক্লাবের উদ্যোগেই ১৯৫৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেলরা রাজনৈতিক সংগঠনেরও জন্ম দিয়েছেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সালে গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। ১৯৭১ সালে সাদাত গঠন করেছিলেন 'আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন'। ১৯৭৯ সালে সাদাত এটাকে ভেঙে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর মুবারক গঠন করেছিলেন 'ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। মিসরে একমাত্র ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি। নাসের থেকে শুরু করে হোসনি মুবারক, যিনি একসময় বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তাঁরা নিজ স্বার্থে দল গঠন করেছেন। এখানে সঠিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দল গঠিত হয়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্যই তাঁরা দল করেছেন। সেখানে সুবিধাবাদীদের ভিড় হয়েছে। সেই 'রানি মৌমাছি' তত্ত্বের মতো। একটি রানি মৌমাছিকে কেন্দ্র করে যেমন একটি মৌচাকের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি একজন জেনারেলকে কেন্দ্র করেই সুবিধাভোগীরা 'ক্ষমতার চাক'-এর জন্ম দিয়েছিল। নাসের এ থেকে আরব জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটি দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মুবারকের কোনো দর্শন ছিল না। তিউনিসিয়ায় একই ঘটনা আমার প্রত্যক্ষ করেছি। সেনাবাহিনীর এই একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীকে কেন্দ্র করে বেন আলী দীর্ঘদিন তাঁর ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। আলেজেরিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাকে ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে কর্নেল বুমেদিয়েন উৎখাত করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এককভাবেই দেশটি শাসন করে গেছেন এবং ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য একটি দলও গঠন করেছিলেন। বলা ভালো, দেশটি একদলীয় শাসনে পরিচালিত হয়েছে দীর্ঘদিন এবং ১৯৮৯ সালে গণভোট সংবিধানে পরিবর্তন এনে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকার ক্ষমতার উৎস ওই সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় এবং সংবিধান পরিবর্তন করে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে, পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য তাঁর ভাইকে তিনি প্রস্তুত করছেন। আর লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফি আছেন ১৯৬৯ সাল থেকে। এখানে এক 'অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা' তিনি প্রবর্তন করছেন, যেখানে রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই। সেনাবাহিনী হচ্ছে তাঁর ক্ষমতার মূল উৎস।
তাই দেখা যাচ্ছে, আরব বিশ্বে সেনাবাহিনীই হচ্ছে মূল শক্তি। গত ছয় দশকের রাজনীতি নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে আমরা মূলত তিনটি ধারা দেখতে পাব। প্রথমত, ১৯৫২ সালে মিসরে বিপ্লব তথা রাজতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে প্রথম ধারার সূচনা, যেখানে আরব জাতীয়তাবাদের রাজনীতি আরব বিশ্বের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে আরব বিশ্বের দেশগুলোর পরাজয়। এরপর থেকে সারা আরব বিশ্বে ইসরায়েলবিরোধী একটি জনমতের জন্ম হয়। তৃতীয়ত, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব। ইরান আরব বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইরানি বিপ্লব এক ধরনের প্রভাব ফেলে আরব বিশ্বে। ইসলামিক শক্তিগুলো এই বিপ্লবের কারণে আরো বেশি করে উৎসাহিত হয়। তিউনিসিয়ার বিপ্লব সম্ভবত চতুর্থ একটি ধারা সূচনা করল। কেমন হবে এই চতুর্থ ধারা?
এই চতুর্থ ধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'পিপলস পাওয়ার', অর্থাৎ গণবিপ্লব। দীর্ঘদিনের অসন্তোষ যেন হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয়েছে। আর এ বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি তরুণ সমাজ, রাষ্ট্র যাদের জন্য নূ্যনতম চাকরির জোগাড় করে দিতে পারেনি। তিউনিসিয়া ও মিসরে যে গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়েছে, তার সূচনা করেছে এই তরুণ সমাজ। ফ্রান্সে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল কৃষকরা। রুশ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে কৃষক ও শ্রমিকদের যৌথ উদ্যোগে। একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল নতুন এক ধরনের বিপ্লব, যার নেতৃত্বে রয়েছে তরুণ সমাজ, যারা ফেইস বুক আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিপ্লবকে সংঘটিত করছে। মিসরের বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক মোহাম্মদ হাইকেল তিন বছর আগে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এভাবে, The effect of mobiles, computers, satellites - there is a generation coming that is outside the traditional controls. Normally generations recreate themselves. But something else is happening'. (WSJ, 1.2.11)| GB 'something' আজ কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস সম্ভবত নতুন করে এখন লিখতে হবে জর্ডান আর সিরিয়াকে নিয়ে, সেখানেও তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সনাতন ধারায় আরব বিশ্বের যে 'রাজনীতি', তাতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। আর এ পরিবর্তনটা অনিবার্য। অধ্যাপক জোসেফ নাই বলেছেন পরিবর্তনের কথা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা অধ্যাপক নাইয়ের ঐধৎফ চড়বিৎ এবং Soft Power-এর কথা জানেন। তিনি এখন বলছেন, Smart Power-এর কথা। নাই (Nye) লিখেছেন, 'In today's information age, upholding the freedom to access information will be an important component of smart power'। তথ্য যে একটি শক্তি এবং তা যে Smart Power-এর বৈশিষ্ট্য, তা প্রমাণ করেছে আল-জাজিরা। তাদের প্রচারিত প্রতিবেদনে মিসরবাসী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ট্যাংকের সামনে দাঁড়াতে তাদের এতটুকু বুক কাঁপেনি। ভীত হোসনি মুবারক আল-জাজিরাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন মিসরে।
মিসরে পরিবর্তন হয়েছে, যেতে হবে অনেক দূর। তিউনিসিয়ার মতো পরিবর্তনটা দ্রুত আসেনি। বিপ্লব কখনো সংবিধান মানে না। পূর্ব ইউরোপে 'ভেলভেট রেভ্ল্যুশন' সংবিধান মেনে হয়নি। 'কালার রেভ্ল্যুশন'ও সংবিধান অনুসরণ করেনি। আর সর্বশেষ 'জেসমিন রেভ্ল্যুশন'-এর সময় সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। এখন মিসরে উঠছে। সংবিধানে কিভাবে পরিবর্তন এনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, তা নিয়ে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে। তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের ব্যাপারে ওবামার নীরব সমর্থন ছিল। এই নীরব সমর্থনও প্রশ্নবিদ্ধ। এখন সেই সমর্থন ফিকে হয়ে এসেছে। ইসরায়েল প্রথম থেকেই এই বিপ্লবের বিরোধিতা করে আসছে। ওবামা প্রশাসন ইসরায়েলি লবির কাছে প্রথমদিকে নতিস্বীকার করেছিলেন। একটি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন। ওবামা প্রশাসন যদি তাহরির স্কয়ারের সাধারণ মিসরবাসীর 'পাল্স' বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই শুধু আঘাত করবে না, বরং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনাকেই শক্তিশালী করবে মিসরে। আরবিতে 'Ikwanophobia' বলে একটা কথা আছে। 'Ikwan' এর অর্থ হচ্ছে 'Muslim Brothers', মুসলমান ভাই। অর্থাৎ মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের শিক্ষক অধ্যাপক রবার্ট স্প্রিংবর্গ (Robert Springborg) তাই মন্তব্য করেছেন এভাবে, মিসরে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে এই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলামপন্থীদের সেখানে ক্ষমতায় বসাবে। এই 'সম্ভাবনা' একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। যদিও ইসলামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পুরো আরব বিশ্বই এখন পরিবর্তনের মুখোমুখি। পঞ্চাশের দশকে আরব জাতীয়তাবাদ একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এর ঠিক ৬০ বছর পর মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা নতুন এক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরই জন্ম দিতে যাচ্ছে সেখানে। মিসর দিয়ে এর শুরু হলো কি না, সেটাই দেখার বিষয়। মুবারকের বিদায়ে একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। এখন গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যদি একত্রিত হয়, তাহলে ইসলামপন্থীদের রোধ করা সম্ভব। মিসরের জন্য সম্ভাবনা একটি, তা হচ্ছে তুরস্ক মডেল। এখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় অথচ সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে ইসলামী ব্রাদারহুড পার্টির আগামীতে উত্থান ঘটলেও, সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে এক ধরনের 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স' হিসেবে কাজ করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
আরব বিশ্বে আদৌ কোনো গণতন্ত্র নেই। সৌদি আরবসহ জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ সনাতন আরব বিশ্বে রয়েছে পারিবারিক শাসন, রাজতন্ত্র। এই রাজতন্ত্রে সংসদীয় শাসন বলে কিছু নেই। কুয়েত কিংবা বাহরাইনের মতো দেশে সংসদ রয়েছে বটে, কিন্তু সেই সংসদ 'জনগণের সংসদ', এটা বলা যাবে না। সেখানে রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্বও নেই। এর বাইরে সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া কিংবা আলজেরিয়াতে রয়েছে এক ধরনের সমাজব্যবস্থা, যেখানে সেনাবাহিনীই হলো মূল চালিকাশক্তি। ইরাক ও সিরিয়ায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছিল বাথ পার্টির সহযোগিতায়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জমানায় বাথ পার্টি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত। এখন সাদ্দাম-পরবর্তী যুগে বাথ পার্টির অস্তিত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু মূল শক্তি নয়। শিয়ারা এখন সেখানে মূল শক্তি। অন্যদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনী বাথ পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত হাফিজ আল আসাদ ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। ক্ষমতায় তাঁর উত্থান ঘটেছিল সেনাবাহিনী থেকেই। এ ক্ষেত্রে বাথ পার্টি হচ্ছে তাঁর মাধ্যম। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বাসার আল আসাদ এখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। এখানে বলে রাখা ভালো, সিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করেছিল (ফ্রান্সের কাছ থেকে) ১৯৪৬ সালে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মিসরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করেছিল ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক। ১৯৬১ সালে সিরিয়া আবার আলাদা হয়ে যায়। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে বাথ পার্টি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
আরব বিশ্বের রাজনীতি বুঝতে হলে এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হবে। সেনাবাহিনী আরব বিশ্বের রাজনীতিতে একটি শক্তি। তিউনিসিয়ায় সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পতন ঘটে জাইন এল আবিদিন বেন আলীর, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। আজ সেনাবাহিনী হোসনি মুবারকের পাশে না দাঁড়ানোর ফলে তাঁকেও সরে যেতে হলো। হোসনি মুবারক এখন ক্ষমতায় নেই। কিন্তু সেনাবাহিনীর বর্তমান ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। মিসরে সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা নিশ্চিত করেছিলেন কর্নেল গামাল আবদুল নাসের। নাসের সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার্স ক্লাব গঠন করেছিলেন ১৯৪৯ সালে। এই ফ্রি অফিসার্স ক্লাবের উদ্যোগেই ১৯৫৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেলরা রাজনৈতিক সংগঠনেরও জন্ম দিয়েছেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সালে গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। ১৯৭১ সালে সাদাত গঠন করেছিলেন 'আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন'। ১৯৭৯ সালে সাদাত এটাকে ভেঙে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর মুবারক গঠন করেছিলেন 'ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। মিসরে একমাত্র ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি। নাসের থেকে শুরু করে হোসনি মুবারক, যিনি একসময় বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তাঁরা নিজ স্বার্থে দল গঠন করেছেন। এখানে সঠিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দল গঠিত হয়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্যই তাঁরা দল করেছেন। সেখানে সুবিধাবাদীদের ভিড় হয়েছে। সেই 'রানি মৌমাছি' তত্ত্বের মতো। একটি রানি মৌমাছিকে কেন্দ্র করে যেমন একটি মৌচাকের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি একজন জেনারেলকে কেন্দ্র করেই সুবিধাভোগীরা 'ক্ষমতার চাক'-এর জন্ম দিয়েছিল। নাসের এ থেকে আরব জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটি দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মুবারকের কোনো দর্শন ছিল না। তিউনিসিয়ায় একই ঘটনা আমার প্রত্যক্ষ করেছি। সেনাবাহিনীর এই একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীকে কেন্দ্র করে বেন আলী দীর্ঘদিন তাঁর ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। আলেজেরিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাকে ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে কর্নেল বুমেদিয়েন উৎখাত করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এককভাবেই দেশটি শাসন করে গেছেন এবং ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য একটি দলও গঠন করেছিলেন। বলা ভালো, দেশটি একদলীয় শাসনে পরিচালিত হয়েছে দীর্ঘদিন এবং ১৯৮৯ সালে গণভোট সংবিধানে পরিবর্তন এনে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকার ক্ষমতার উৎস ওই সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় এবং সংবিধান পরিবর্তন করে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে, পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য তাঁর ভাইকে তিনি প্রস্তুত করছেন। আর লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফি আছেন ১৯৬৯ সাল থেকে। এখানে এক 'অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা' তিনি প্রবর্তন করছেন, যেখানে রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই। সেনাবাহিনী হচ্ছে তাঁর ক্ষমতার মূল উৎস।
তাই দেখা যাচ্ছে, আরব বিশ্বে সেনাবাহিনীই হচ্ছে মূল শক্তি। গত ছয় দশকের রাজনীতি নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে আমরা মূলত তিনটি ধারা দেখতে পাব। প্রথমত, ১৯৫২ সালে মিসরে বিপ্লব তথা রাজতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে প্রথম ধারার সূচনা, যেখানে আরব জাতীয়তাবাদের রাজনীতি আরব বিশ্বের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে আরব বিশ্বের দেশগুলোর পরাজয়। এরপর থেকে সারা আরব বিশ্বে ইসরায়েলবিরোধী একটি জনমতের জন্ম হয়। তৃতীয়ত, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব। ইরান আরব বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইরানি বিপ্লব এক ধরনের প্রভাব ফেলে আরব বিশ্বে। ইসলামিক শক্তিগুলো এই বিপ্লবের কারণে আরো বেশি করে উৎসাহিত হয়। তিউনিসিয়ার বিপ্লব সম্ভবত চতুর্থ একটি ধারা সূচনা করল। কেমন হবে এই চতুর্থ ধারা?
এই চতুর্থ ধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'পিপলস পাওয়ার', অর্থাৎ গণবিপ্লব। দীর্ঘদিনের অসন্তোষ যেন হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয়েছে। আর এ বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি তরুণ সমাজ, রাষ্ট্র যাদের জন্য নূ্যনতম চাকরির জোগাড় করে দিতে পারেনি। তিউনিসিয়া ও মিসরে যে গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়েছে, তার সূচনা করেছে এই তরুণ সমাজ। ফ্রান্সে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল কৃষকরা। রুশ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে কৃষক ও শ্রমিকদের যৌথ উদ্যোগে। একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল নতুন এক ধরনের বিপ্লব, যার নেতৃত্বে রয়েছে তরুণ সমাজ, যারা ফেইস বুক আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিপ্লবকে সংঘটিত করছে। মিসরের বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক মোহাম্মদ হাইকেল তিন বছর আগে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এভাবে, The effect of mobiles, computers, satellites - there is a generation coming that is outside the traditional controls. Normally generations recreate themselves. But something else is happening'. (WSJ, 1.2.11)| GB 'something' আজ কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস সম্ভবত নতুন করে এখন লিখতে হবে জর্ডান আর সিরিয়াকে নিয়ে, সেখানেও তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সনাতন ধারায় আরব বিশ্বের যে 'রাজনীতি', তাতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। আর এ পরিবর্তনটা অনিবার্য। অধ্যাপক জোসেফ নাই বলেছেন পরিবর্তনের কথা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা অধ্যাপক নাইয়ের ঐধৎফ চড়বিৎ এবং Soft Power-এর কথা জানেন। তিনি এখন বলছেন, Smart Power-এর কথা। নাই (Nye) লিখেছেন, 'In today's information age, upholding the freedom to access information will be an important component of smart power'। তথ্য যে একটি শক্তি এবং তা যে Smart Power-এর বৈশিষ্ট্য, তা প্রমাণ করেছে আল-জাজিরা। তাদের প্রচারিত প্রতিবেদনে মিসরবাসী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ট্যাংকের সামনে দাঁড়াতে তাদের এতটুকু বুক কাঁপেনি। ভীত হোসনি মুবারক আল-জাজিরাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন মিসরে।
মিসরে পরিবর্তন হয়েছে, যেতে হবে অনেক দূর। তিউনিসিয়ার মতো পরিবর্তনটা দ্রুত আসেনি। বিপ্লব কখনো সংবিধান মানে না। পূর্ব ইউরোপে 'ভেলভেট রেভ্ল্যুশন' সংবিধান মেনে হয়নি। 'কালার রেভ্ল্যুশন'ও সংবিধান অনুসরণ করেনি। আর সর্বশেষ 'জেসমিন রেভ্ল্যুশন'-এর সময় সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। এখন মিসরে উঠছে। সংবিধানে কিভাবে পরিবর্তন এনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, তা নিয়ে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে। তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের ব্যাপারে ওবামার নীরব সমর্থন ছিল। এই নীরব সমর্থনও প্রশ্নবিদ্ধ। এখন সেই সমর্থন ফিকে হয়ে এসেছে। ইসরায়েল প্রথম থেকেই এই বিপ্লবের বিরোধিতা করে আসছে। ওবামা প্রশাসন ইসরায়েলি লবির কাছে প্রথমদিকে নতিস্বীকার করেছিলেন। একটি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন। ওবামা প্রশাসন যদি তাহরির স্কয়ারের সাধারণ মিসরবাসীর 'পাল্স' বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই শুধু আঘাত করবে না, বরং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনাকেই শক্তিশালী করবে মিসরে। আরবিতে 'Ikwanophobia' বলে একটা কথা আছে। 'Ikwan' এর অর্থ হচ্ছে 'Muslim Brothers', মুসলমান ভাই। অর্থাৎ মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের শিক্ষক অধ্যাপক রবার্ট স্প্রিংবর্গ (Robert Springborg) তাই মন্তব্য করেছেন এভাবে, মিসরে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে এই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলামপন্থীদের সেখানে ক্ষমতায় বসাবে। এই 'সম্ভাবনা' একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। যদিও ইসলামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পুরো আরব বিশ্বই এখন পরিবর্তনের মুখোমুখি। পঞ্চাশের দশকে আরব জাতীয়তাবাদ একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এর ঠিক ৬০ বছর পর মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা নতুন এক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরই জন্ম দিতে যাচ্ছে সেখানে। মিসর দিয়ে এর শুরু হলো কি না, সেটাই দেখার বিষয়। মুবারকের বিদায়ে একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। এখন গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যদি একত্রিত হয়, তাহলে ইসলামপন্থীদের রোধ করা সম্ভব। মিসরের জন্য সম্ভাবনা একটি, তা হচ্ছে তুরস্ক মডেল। এখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় অথচ সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে ইসলামী ব্রাদারহুড পার্টির আগামীতে উত্থান ঘটলেও, সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে এক ধরনের 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স' হিসেবে কাজ করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments