দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন সংশোধনের ভালো-মন্দ by এ এম এম শওকত আলী
দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের কয়েকটি ধারার সংশোধন মন্ত্রিসভা সম্প্রতি অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ অচিরেই সংশোধনীগুলো বিল আকারে সংসদের বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য উত্থাপিত হবে। তবে এর পূর্ববর্তী পদক্ষেপ হবে সংশোধনী বিলটি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংসদে এ-সংক্রান্ত সুপারিশ পেশ করবে।
সাধারণত সংসদে বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিল উত্থাপিত হলে সংসদ চিরাচরিত প্রথায় তা সংশ্লিষ্ট সংশোধনী কমিটিতে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে কমিটির সুপারিশ আলোচনার পর সংসদ কণ্ঠভোটের মাধ্যমে সংশোধনীসহ বা সংশোধনী ব্যতিরেকে তা অনুমোদন করে। এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করা যায় যে বিলটি কোনো বড় ধরনের সংশোধনী ছাড়াই সংসদ অনুমোদন করবে। ২০০০-পরবর্তী সময় থেকে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনীর সংখ্যা হবে তিনটি। প্রথমটি হয় ২০০৪ সালে অথবা ২০০৬ সালে। দ্বিতীয়টি হয় ২০০৭ সালে; অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে। তৃতীয়টি হবে ২০১১ সালে। অতীতের মতো বর্তমানের সংশোধনী প্রস্তাব বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
সংশোধনীর বিষয়বস্তু মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ার অধিকাংশ সূত্রই প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্বল হয়ে যাবে_এমনই একটি ধারণার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে এ বিষয়টির পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এক. কমিশনের তদন্ত ১২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়টি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই, যার কারণ (ক) ইতিপূর্বে সময়সীমা সম্পর্কিত বিষয়ে সর্বমোট ৬০ দিন ধার্য ছিল, যা এখন ১২০ দিন; (খ) বাধ্যতামূলক সময়সীমা ৬০ থেকে দ্বিগুণ করার ফলে দুর্নীতি দমন কমিশনের অসুবিধার চেয়ে সুবিধা হওয়ারই কথা এবং (গ) এ ধরনের সময়সীমা ফৌজদারি বিচার-সংক্রান্ত অন্যান্য আইনেও রয়েছে, বিশেষ করে পুলিশ-বিধিতে।
দুই. মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, এর ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এ ধরনের বিধানের ভিত্তি বোধগম্য নয়। ২০০৭ সালে 'ক্যাঙ্গারু আদালতের বিচার' মর্মে আখ্যায়িত যেসব মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদান করা হয়, তার জন্য জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে বিচারব্যবস্থা নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে জনগণের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। এ কথা কমবেশি সবাই মনে করে, ২০০৭ সালে দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে তৃতীয় শক্তির প্রভাব প্রচ্ছন্ন বা প্রত্যক্ষ ছিল। এ ছাড়া ছিল একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত সমন্বয় কমিটি, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধনীতে মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে শাস্তির মাত্রা হবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতে পারেন। এখন পর্যন্ত কোনো মিথ্যা ফৌজদারি মামলায় এ ধরনের মামলা হওয়ার কোনো নজির জানা নেই। মন্ত্রিসভায় এ বিষয়ে আরো চিন্তাভাবনা করার অবকাশ ছিল।
এ ছাড়া রয়েছে অন্য একটি প্রশ্ন। দুর্নীতির মামলা রুজু করার ক্ষেত্রে কমিশন একটি নির্ধারিত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। যেমন এক. প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ বা তথ্য অনুসন্ধান করা হয়। দুই. অনুসন্ধানে প্রমাণযোগ্য তথ্য পাওয়া গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে তদন্ত শুরু করেন। অর্থাৎ এই ধাপে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমোদন প্রদান করে। তিন. তদন্তের মাধ্যমে যথেষ্ট তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র প্রণয়ন করেন। চার. এই ধাপে কমিশন অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার আগে নিজস্ব আইনজীবীর মতামতও গ্রহণ করে। কমিশনের প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের আইনি মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত আক্রোশ বা শত্রুতার কারণে মিথ্যা মামলা রুজু হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। প্রায় নেই বললেই চলে। যদি থাকেও, তাহলে দণ্ডবিধির ধারা অনুযায়ী এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা নেই।
চার. সংশোধনীর অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়টি সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জন্য মামলা রুজু করার পূর্বানুমতি জড়িত। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে সংশোধনীতে কী বলা হয়েছে, তা এখনো অনেকের অজানা। এটা কি শুধু সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, না সব ধরনের গণ-কর্মচারীর (Public servant) জন্য তা স্পষ্ট নয়। শেষোক্ত ক্ষেত্রের আওতায় এমপি, মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচিত কর্মকর্তার প্রতিও পূর্বানুমতির শর্ত প্রযোজ্য কি না তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এটা বলা যায় যে এ ধরনের কর্মকর্তাদের জন্যও অনুরূপ শর্ত পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছিল, যা মন্ত্রিসভা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের শর্ত সম্পর্কে যা এ মুহূর্তে বলা যায় তা হলো, এ ধরনের সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি রয়েছে। এ ধরনের শর্তের পক্ষে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলে থাকেন যে এ শর্ত বিলুপ্ত হলে দুর্নীতি দমন বেগবান হবে। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন, অতীতে এ ধরনের কাঠামো অর্থাৎ পূর্বানুমতির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল। এ কমিটিই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। আশির দশকের সামরিক শাসনামলে এ কমিটি বিলুপ্ত করে পূর্বানুমতির ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরে এ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত হয়।
নাগরিক সমাজ থেকে অভিযোগ করা হয়, বছরের পর বছর সিদ্ধান্ত দেওয়া হতো না। যাঁরা এ যুক্তি প্রদর্শন করেন, তাঁরা ওই সময়ের বিদ্যমান আইন এবং এখনো যা রয়েছে, সে বিষয়ে অবহিত নন। বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধিতে আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত জনসেবকের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। তবে এর মধ্যেও শর্ত রয়েছে। শর্তটি হলো, অনূর্ধ্ব ৬০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ যদি সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে অভিযুক্তের বিচার করার জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পূর্বানুমতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম টিআইবির একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তি দিয়েছে যে সংস্থার জরিপে প্রায় ৯৬ শতাংশ ব্যক্তিই পূর্বানুমতি প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। জরিপের বিষয়বস্তু না হলেও গুণগত মান নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। বিচার বিভাগের দুর্নীতির যে প্রতিবেদন সাম্প্রতিককালে টিআইবি প্রকাশ করেছে, তা হয়েছে বিতর্কিত। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এ প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছে যে প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই দুর্নীতি করার অধিকতর সুযোগ পান। এ কারণে দুর্নীতির যেকোনো আলোচনায় তাঁরাই হন সন্দেহভাজন গোষ্ঠী। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত দুর্নীতি দমন কৌশলের মধ্যে অন্যতম কৌশল হলো, দুর্নীতি যে প্রতিষ্ঠানে হয় সে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় সংস্কার সাধন করা। সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণে সব সরকারই উদাসীন অথবা ব্যর্থ। এ জন্য দুর্নীতির বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়।
দুর্নীতি দমনে সফলতার জন্য নাগরিক সমাজের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ভারতীয় প্রথার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, যা বলা হয়েছে তা অর্ধসত্য। কারণ একাধিক। এক. ভারতীয় প্রথায়ও সরকারি কর্মকর্তা বা মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সত্ত্বেও বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা সম্পর্কে লোকসভায় সরকার তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ভারতেও সাম্প্রতিককালে কর্নাটক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতিবিষয়ক মামলা করার জন্য ওই রাজ্যের গভর্নর অনুমোদন প্রদান করেছেন। অতএব সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অনুমতির বাধ্যবাধকতার জন্যই দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যাবে_এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্পূর্ণ বিষয়টি নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও সততার ওপর। যে দেশে ক্রমাগত সংসদ বর্জনের মানসিকতা নেই, সে দেশের উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য সঠিক নয়।
দুই. ভারতের ২-জি-সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। মামলা তদন্তাধীন। সিএজির প্রতিবেদন যে নির্ভুল নয়, সে বিষয়ে নব্য টেলিকমমন্ত্রী যে একাই উক্তি করেছেন, তা নয়। সম্প্রতি বিশ্ব টেলিকম ফোরামে একই মতামত বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরাও ব্যক্ত করেছেন। ভারতে সরকারি দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে ভিজিল্যান্স কমিশন, যার প্রধান কর্মকর্তা হলেন চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনার (সিভিসি)। বর্তমানে কর্মরত সিভিসির অতীত দুর্নীতি নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। এটা সম্ভব হয়েছে ভারতীয় প্রথার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শক্তির জন্য। এ শক্তির প্রধান উৎস একাধিক। যেমন_(ক) সিভিসির নিয়োগের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া ছিল দ্বিপক্ষীয় (নরঢ়ধৎঃরংধহ) প্যানেলভুক্তদের মধ্যে বিরোধী দলের সদস্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন; (খ) সংসদ সব সময়ই সচল; (গ) যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়ে সাবধানতা এবং (ঘ) উচ্চ আদালতের তীক্ষ্ন নজরদারি। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য আইনের বিধানের প্রয়োজন হলেও তা যথেষ্ট নয়।
তিন. শুধু দুর্নীতি দমনই নয়, সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিষয়টির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, রাষ্ট্রীয় অঙ্গ তিনটির সচলতা ও নৈর্ব্যক্তিক কার্যপরিচালনা। এ বিষয়টিরই অভাব বাংলাদেশে। এদের বিষয়ে উদাসীন হলে একমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশনের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব নয়।
বৈশ্বিক পর্যায়ে দুর্নীতি দমনের কৌশলে জাতীয় সততা পদ্ধতির (National Integrity System) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় বলা হয়েছে যে কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই এ পদ্ধতির আওতাভুক্ত করতে হবে তা নয়; বরং রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানসহ জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে কৌশলটা সংকীর্ণভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সংশোধনীর বিষয়বস্তু মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ার অধিকাংশ সূত্রই প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্বল হয়ে যাবে_এমনই একটি ধারণার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে এ বিষয়টির পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এক. কমিশনের তদন্ত ১২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়টি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই, যার কারণ (ক) ইতিপূর্বে সময়সীমা সম্পর্কিত বিষয়ে সর্বমোট ৬০ দিন ধার্য ছিল, যা এখন ১২০ দিন; (খ) বাধ্যতামূলক সময়সীমা ৬০ থেকে দ্বিগুণ করার ফলে দুর্নীতি দমন কমিশনের অসুবিধার চেয়ে সুবিধা হওয়ারই কথা এবং (গ) এ ধরনের সময়সীমা ফৌজদারি বিচার-সংক্রান্ত অন্যান্য আইনেও রয়েছে, বিশেষ করে পুলিশ-বিধিতে।
দুই. মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, এর ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এ ধরনের বিধানের ভিত্তি বোধগম্য নয়। ২০০৭ সালে 'ক্যাঙ্গারু আদালতের বিচার' মর্মে আখ্যায়িত যেসব মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদান করা হয়, তার জন্য জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে বিচারব্যবস্থা নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে জনগণের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। এ কথা কমবেশি সবাই মনে করে, ২০০৭ সালে দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে তৃতীয় শক্তির প্রভাব প্রচ্ছন্ন বা প্রত্যক্ষ ছিল। এ ছাড়া ছিল একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত সমন্বয় কমিটি, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধনীতে মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে শাস্তির মাত্রা হবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে মিথ্যা মামলা রুজু করার বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতে পারেন। এখন পর্যন্ত কোনো মিথ্যা ফৌজদারি মামলায় এ ধরনের মামলা হওয়ার কোনো নজির জানা নেই। মন্ত্রিসভায় এ বিষয়ে আরো চিন্তাভাবনা করার অবকাশ ছিল।
এ ছাড়া রয়েছে অন্য একটি প্রশ্ন। দুর্নীতির মামলা রুজু করার ক্ষেত্রে কমিশন একটি নির্ধারিত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। যেমন এক. প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ বা তথ্য অনুসন্ধান করা হয়। দুই. অনুসন্ধানে প্রমাণযোগ্য তথ্য পাওয়া গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে তদন্ত শুরু করেন। অর্থাৎ এই ধাপে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমোদন প্রদান করে। তিন. তদন্তের মাধ্যমে যথেষ্ট তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র প্রণয়ন করেন। চার. এই ধাপে কমিশন অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার আগে নিজস্ব আইনজীবীর মতামতও গ্রহণ করে। কমিশনের প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের আইনি মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত আক্রোশ বা শত্রুতার কারণে মিথ্যা মামলা রুজু হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। প্রায় নেই বললেই চলে। যদি থাকেও, তাহলে দণ্ডবিধির ধারা অনুযায়ী এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা নেই।
চার. সংশোধনীর অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়টি সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জন্য মামলা রুজু করার পূর্বানুমতি জড়িত। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে সংশোধনীতে কী বলা হয়েছে, তা এখনো অনেকের অজানা। এটা কি শুধু সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, না সব ধরনের গণ-কর্মচারীর (Public servant) জন্য তা স্পষ্ট নয়। শেষোক্ত ক্ষেত্রের আওতায় এমপি, মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচিত কর্মকর্তার প্রতিও পূর্বানুমতির শর্ত প্রযোজ্য কি না তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এটা বলা যায় যে এ ধরনের কর্মকর্তাদের জন্যও অনুরূপ শর্ত পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছিল, যা মন্ত্রিসভা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের শর্ত সম্পর্কে যা এ মুহূর্তে বলা যায় তা হলো, এ ধরনের সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি রয়েছে। এ ধরনের শর্তের পক্ষে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলে থাকেন যে এ শর্ত বিলুপ্ত হলে দুর্নীতি দমন বেগবান হবে। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন, অতীতে এ ধরনের কাঠামো অর্থাৎ পূর্বানুমতির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল। এ কমিটিই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। আশির দশকের সামরিক শাসনামলে এ কমিটি বিলুপ্ত করে পূর্বানুমতির ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরে এ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত হয়।
নাগরিক সমাজ থেকে অভিযোগ করা হয়, বছরের পর বছর সিদ্ধান্ত দেওয়া হতো না। যাঁরা এ যুক্তি প্রদর্শন করেন, তাঁরা ওই সময়ের বিদ্যমান আইন এবং এখনো যা রয়েছে, সে বিষয়ে অবহিত নন। বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধিতে আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত জনসেবকের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। তবে এর মধ্যেও শর্ত রয়েছে। শর্তটি হলো, অনূর্ধ্ব ৬০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ যদি সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে অভিযুক্তের বিচার করার জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পূর্বানুমতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম টিআইবির একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তি দিয়েছে যে সংস্থার জরিপে প্রায় ৯৬ শতাংশ ব্যক্তিই পূর্বানুমতি প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। জরিপের বিষয়বস্তু না হলেও গুণগত মান নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। বিচার বিভাগের দুর্নীতির যে প্রতিবেদন সাম্প্রতিককালে টিআইবি প্রকাশ করেছে, তা হয়েছে বিতর্কিত। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এ প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছে যে প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই দুর্নীতি করার অধিকতর সুযোগ পান। এ কারণে দুর্নীতির যেকোনো আলোচনায় তাঁরাই হন সন্দেহভাজন গোষ্ঠী। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত দুর্নীতি দমন কৌশলের মধ্যে অন্যতম কৌশল হলো, দুর্নীতি যে প্রতিষ্ঠানে হয় সে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় সংস্কার সাধন করা। সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণে সব সরকারই উদাসীন অথবা ব্যর্থ। এ জন্য দুর্নীতির বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়।
দুর্নীতি দমনে সফলতার জন্য নাগরিক সমাজের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ভারতীয় প্রথার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, যা বলা হয়েছে তা অর্ধসত্য। কারণ একাধিক। এক. ভারতীয় প্রথায়ও সরকারি কর্মকর্তা বা মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সত্ত্বেও বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা সম্পর্কে লোকসভায় সরকার তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ভারতেও সাম্প্রতিককালে কর্নাটক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতিবিষয়ক মামলা করার জন্য ওই রাজ্যের গভর্নর অনুমোদন প্রদান করেছেন। অতএব সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অনুমতির বাধ্যবাধকতার জন্যই দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যাবে_এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্পূর্ণ বিষয়টি নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও সততার ওপর। যে দেশে ক্রমাগত সংসদ বর্জনের মানসিকতা নেই, সে দেশের উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য সঠিক নয়।
দুই. ভারতের ২-জি-সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। মামলা তদন্তাধীন। সিএজির প্রতিবেদন যে নির্ভুল নয়, সে বিষয়ে নব্য টেলিকমমন্ত্রী যে একাই উক্তি করেছেন, তা নয়। সম্প্রতি বিশ্ব টেলিকম ফোরামে একই মতামত বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরাও ব্যক্ত করেছেন। ভারতে সরকারি দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে ভিজিল্যান্স কমিশন, যার প্রধান কর্মকর্তা হলেন চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনার (সিভিসি)। বর্তমানে কর্মরত সিভিসির অতীত দুর্নীতি নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। এটা সম্ভব হয়েছে ভারতীয় প্রথার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শক্তির জন্য। এ শক্তির প্রধান উৎস একাধিক। যেমন_(ক) সিভিসির নিয়োগের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া ছিল দ্বিপক্ষীয় (নরঢ়ধৎঃরংধহ) প্যানেলভুক্তদের মধ্যে বিরোধী দলের সদস্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন; (খ) সংসদ সব সময়ই সচল; (গ) যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়ে সাবধানতা এবং (ঘ) উচ্চ আদালতের তীক্ষ্ন নজরদারি। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য আইনের বিধানের প্রয়োজন হলেও তা যথেষ্ট নয়।
তিন. শুধু দুর্নীতি দমনই নয়, সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিষয়টির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, রাষ্ট্রীয় অঙ্গ তিনটির সচলতা ও নৈর্ব্যক্তিক কার্যপরিচালনা। এ বিষয়টিরই অভাব বাংলাদেশে। এদের বিষয়ে উদাসীন হলে একমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশনের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব নয়।
বৈশ্বিক পর্যায়ে দুর্নীতি দমনের কৌশলে জাতীয় সততা পদ্ধতির (National Integrity System) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় বলা হয়েছে যে কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই এ পদ্ধতির আওতাভুক্ত করতে হবে তা নয়; বরং রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানসহ জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে কৌশলটা সংকীর্ণভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments