চারদিক-গৌরব ও অর্জনের সত্তর বছর by আবদুল্লাহ আল মোহন
আজ ৭ জুলাই আলোকিত মানুষ তৈরির সূতিকাগার সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর পূর্ণ করছে। এটি মানিকগঞ্জ জেলার প্রাচীনতম তথা প্রথম কলেজ। ১৯৪২ সালের ৭ জুলাই ঘিওরের তেরশ্রীতে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়।
আর দেবেন্দ্র কলেজের কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মহান দানবীর, কর্মবীর রণদা প্রসাদ (আর পি) সাহার মুখ। আর পি সাহার বাবার নামেই কলেজটির নামকরণ করা হয়।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম অধ্যক্ষ বাবু হিমাংশু ভূষণ সরকার দেবেন্দ্র কলেজের জন্মের ইতিহাস বিষয়ে যা লিখেছেন, তারই কিছু অংশবিশেষ বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য তুলে ধরছি: ‘মানিকগঞ্জে প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠার গৌরব অবশ্যই দেবেন্দ্র কলেজের প্রাপ্য, কিন্তু ইহা ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল ঘিওর উপজেলার অন্তর্গত তেরশ্রী নামক গ্রামে।...একটি অদ্ভুত যোগাযোগের জন্য আমি এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পুরোধা হইয়া গেলাম।...১৯৩৮ সালে বাড়ি আসিলে তেরশ্রীর জমিদার শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী আমাকে আমন্ত্রণ জানাইলেন স্থানীয় কালী নারায়ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়টি পুনর্গঠন করিয়া উহাকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার মানে উন্নয়ন করিবার জন্য। তখন সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িবার ব্যবস্থা ছিল।...আমার বাড়ি বন্যা প্রসাদ গ্রাম তেরশ্রী হইতে ৮-৯ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া ১৯৩৮ সালের গোড়ার দিকেই কাজে যোগদান করিলাম।...১৯৪১ সালে গুজব রটিল যে পূর্ব মানিকগঞ্জের একটি গ্রামে কলেজ করিবার আয়োজন চলিতেছে। আমি ভাবিলাম, তেরশ্রীতে নয় কেন?...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে খবর লইয়া জানিতে পারিলাম যে, কলেজ স্থাপন করিতে হইলে রিজার্ভ ফান্ডে চাই দশ হাজার টাকা। স্থানীয় স্কুলটিকে উচ্চ মানে পৌঁছাইয়া দিবার সুকৃতিত্বে তেরশ্রীর জমিদার মহাশয় আমার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন। আমি কলেজের রিজার্ভ ফান্ডের জন্য দশ হাজার টাকা এবং গৃহাদি নির্মাণের জন্য উপযুক্ত জায়গা চাহিলে তিনি উহা দিতে স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু শর্ত হইল যে যদি কোন কারণে কলেজ উঠিয়া যায় বা স্থানান্তরিত হয়, তাহা হইলে রিজার্ভ ফান্ডের টাকাসহ সমস্তই প্রত্যর্পণ করিতে হইবে। আমি ইহাতে স্বীকৃত হইয়া পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। হাইস্কুলের সংলগ্ন পশ্চিম প্রান্তের জমিতে কলেজ নির্মাণ করিবার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট হইল।...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করিবার পর আমি কলেজ গভর্নিং বডির পক্ষে আইএ ক্লাস খুলিবার জন্য অনুমোদন চাহিয়া পত্র দিলাম। উহা ১৯৪২ সালের গোড়ার দিকের কথা।...বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভের পর অধ্যাপক নিয়োগ করা হইল। আর্থিক সঙ্গতির দিকে লক্ষ রাখিয়া আমরা প্রথম বৎসর মাত্র কয়েকটি বিষয় লইয়াই অধ্যাপনা আরম্ভ করিলাম। অধ্যাপকগণকে পঞ্চাশ টাকা করিয়া বেতন দেওয়া হইত। আমি প্রিন্সিপাল হিসাবে তেরশ্রীতে কলেজ থাকাকালীন কোন বেতন লইতাম না।...এদিকে যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দ্রব্যমূল্যও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গেল। চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্র নিদারুণভাবে সংকুচিত হওয়ায় আমরা প্রমাদ গুনিলাম।...চাঁদা আদায় প্রায় বন্ধ হওয়ায় শুধুমাত্র ছাত্র বেতনে কলেজ চলিতে পারে না, অর্থাগমের অন্য কোন উৎসস্থলও বিদ্যমান ছিল না। এই বিপদে কলেজ রক্ষা করিবার কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। ...তৎকালে মানিকগঞ্জের মহকুমা-শাসক ছিলেন খুরশীদ আলম সাহেব। তাহার নিকট আমাদের বিপদের কথা জ্ঞাপন করিলে তিনি বলিলেন যে কলেজটিকে মানিকগঞ্জে স্থানান্তরিত করিলে তিনি কলেজের সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। এইরূপে কলেজ এক বৎসর তেরশ্রীতে থাকিবার পর ১৯৪৩ সালের বর্ষাকালে কলেজটিকে স্থানান্তরিত করা হইল। বড় বড় নৌকায় করিয়া কলেজের টিনের ঘরগুলি মানিকগঞ্জ শহরে আসিয়া পৌঁছাল। তেরশ্রীতে যে-সমস্ত অধ্যাপক ছিলেন তাহারও এখানে কাজে যোগদান করিলেন। তেরশ্রী পরিত্যাগ করিবার পূর্বে আমি অঙ্গীকারমত জমিদার মহাশয়ের প্রদত্ত রিজার্ভ ফান্ডের দশ হাজার টাকা এবং জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ করিয়া আসিলাম।...মানিকগঞ্জে কলেজ স্থানান্তরিত হইবার কয়েক বৎসর পূর্বেই টাঙ্গাইল মহকুমার (এখন জেলা) মির্জাপুর নিবাসী সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা মহাশয় টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ নামে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তাহার মাতাঠাকুরাণীর স্মৃতি রক্ষার্থে। আমি রণদা বাবুকে প্রস্তাব দিলাম যে তিনি মাতাঠাকুরাণীর স্মৃতি রক্ষার্থে কুমুদিনী কলেজ করিয়া দিয়াছেন, পিতার নামানুসারে মানিকগঞ্জ কলেজটিকেও আর্থিক সাহায্য দিয়া দেবেন্দ্র কলেজে রূপায়িত করিলে তাহার পিতার স্মৃতিও অক্ষয় হইবে। আমার প্রস্তাবটি তাহার মনে ধরিল।...তিনি মানিকগঞ্জে আসিলেন। বোধ হয় সেটা ১৯৪৩-৪৪ সালের কথা হইবে। তিনি মহকুমা শাসক খুরশীদ আলম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়া উপরোক্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করিলেন। রায় বাহাদুর আর পি সাহা বিরাট অঙ্ক ষাট হাজার টাকা দান করিলেন। তিনি আরো মাসিক আর্থিক ঘাটতির টাকা পূরণ করিতে সম্মত হইলেন। তাহার পিতার নামানুসারে কলেজের নাম পরিবর্তন করা হইল।’
১৯৮০ সালের ১ মার্চ কলেজটিকে সরকারি করা হয়। এভাবেই একদা তেরশ্রী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘মানিকগঞ্জ কলেজ’ ‘দেবেন্দ্র কলেজ’ পর্যায় অতিক্রম করে ‘সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ’ নাম ধারণ করে নবযাত্রা শুরু করে। পেরিয়ে আসে প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর।
আবদুল্লাহ আল মোহন
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম অধ্যক্ষ বাবু হিমাংশু ভূষণ সরকার দেবেন্দ্র কলেজের জন্মের ইতিহাস বিষয়ে যা লিখেছেন, তারই কিছু অংশবিশেষ বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য তুলে ধরছি: ‘মানিকগঞ্জে প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠার গৌরব অবশ্যই দেবেন্দ্র কলেজের প্রাপ্য, কিন্তু ইহা ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল ঘিওর উপজেলার অন্তর্গত তেরশ্রী নামক গ্রামে।...একটি অদ্ভুত যোগাযোগের জন্য আমি এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পুরোধা হইয়া গেলাম।...১৯৩৮ সালে বাড়ি আসিলে তেরশ্রীর জমিদার শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী আমাকে আমন্ত্রণ জানাইলেন স্থানীয় কালী নারায়ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়টি পুনর্গঠন করিয়া উহাকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার মানে উন্নয়ন করিবার জন্য। তখন সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িবার ব্যবস্থা ছিল।...আমার বাড়ি বন্যা প্রসাদ গ্রাম তেরশ্রী হইতে ৮-৯ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া ১৯৩৮ সালের গোড়ার দিকেই কাজে যোগদান করিলাম।...১৯৪১ সালে গুজব রটিল যে পূর্ব মানিকগঞ্জের একটি গ্রামে কলেজ করিবার আয়োজন চলিতেছে। আমি ভাবিলাম, তেরশ্রীতে নয় কেন?...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে খবর লইয়া জানিতে পারিলাম যে, কলেজ স্থাপন করিতে হইলে রিজার্ভ ফান্ডে চাই দশ হাজার টাকা। স্থানীয় স্কুলটিকে উচ্চ মানে পৌঁছাইয়া দিবার সুকৃতিত্বে তেরশ্রীর জমিদার মহাশয় আমার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন। আমি কলেজের রিজার্ভ ফান্ডের জন্য দশ হাজার টাকা এবং গৃহাদি নির্মাণের জন্য উপযুক্ত জায়গা চাহিলে তিনি উহা দিতে স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু শর্ত হইল যে যদি কোন কারণে কলেজ উঠিয়া যায় বা স্থানান্তরিত হয়, তাহা হইলে রিজার্ভ ফান্ডের টাকাসহ সমস্তই প্রত্যর্পণ করিতে হইবে। আমি ইহাতে স্বীকৃত হইয়া পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। হাইস্কুলের সংলগ্ন পশ্চিম প্রান্তের জমিতে কলেজ নির্মাণ করিবার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট হইল।...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করিবার পর আমি কলেজ গভর্নিং বডির পক্ষে আইএ ক্লাস খুলিবার জন্য অনুমোদন চাহিয়া পত্র দিলাম। উহা ১৯৪২ সালের গোড়ার দিকের কথা।...বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভের পর অধ্যাপক নিয়োগ করা হইল। আর্থিক সঙ্গতির দিকে লক্ষ রাখিয়া আমরা প্রথম বৎসর মাত্র কয়েকটি বিষয় লইয়াই অধ্যাপনা আরম্ভ করিলাম। অধ্যাপকগণকে পঞ্চাশ টাকা করিয়া বেতন দেওয়া হইত। আমি প্রিন্সিপাল হিসাবে তেরশ্রীতে কলেজ থাকাকালীন কোন বেতন লইতাম না।...এদিকে যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দ্রব্যমূল্যও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গেল। চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্র নিদারুণভাবে সংকুচিত হওয়ায় আমরা প্রমাদ গুনিলাম।...চাঁদা আদায় প্রায় বন্ধ হওয়ায় শুধুমাত্র ছাত্র বেতনে কলেজ চলিতে পারে না, অর্থাগমের অন্য কোন উৎসস্থলও বিদ্যমান ছিল না। এই বিপদে কলেজ রক্ষা করিবার কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। ...তৎকালে মানিকগঞ্জের মহকুমা-শাসক ছিলেন খুরশীদ আলম সাহেব। তাহার নিকট আমাদের বিপদের কথা জ্ঞাপন করিলে তিনি বলিলেন যে কলেজটিকে মানিকগঞ্জে স্থানান্তরিত করিলে তিনি কলেজের সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। এইরূপে কলেজ এক বৎসর তেরশ্রীতে থাকিবার পর ১৯৪৩ সালের বর্ষাকালে কলেজটিকে স্থানান্তরিত করা হইল। বড় বড় নৌকায় করিয়া কলেজের টিনের ঘরগুলি মানিকগঞ্জ শহরে আসিয়া পৌঁছাল। তেরশ্রীতে যে-সমস্ত অধ্যাপক ছিলেন তাহারও এখানে কাজে যোগদান করিলেন। তেরশ্রী পরিত্যাগ করিবার পূর্বে আমি অঙ্গীকারমত জমিদার মহাশয়ের প্রদত্ত রিজার্ভ ফান্ডের দশ হাজার টাকা এবং জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ করিয়া আসিলাম।...মানিকগঞ্জে কলেজ স্থানান্তরিত হইবার কয়েক বৎসর পূর্বেই টাঙ্গাইল মহকুমার (এখন জেলা) মির্জাপুর নিবাসী সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা মহাশয় টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ নামে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তাহার মাতাঠাকুরাণীর স্মৃতি রক্ষার্থে। আমি রণদা বাবুকে প্রস্তাব দিলাম যে তিনি মাতাঠাকুরাণীর স্মৃতি রক্ষার্থে কুমুদিনী কলেজ করিয়া দিয়াছেন, পিতার নামানুসারে মানিকগঞ্জ কলেজটিকেও আর্থিক সাহায্য দিয়া দেবেন্দ্র কলেজে রূপায়িত করিলে তাহার পিতার স্মৃতিও অক্ষয় হইবে। আমার প্রস্তাবটি তাহার মনে ধরিল।...তিনি মানিকগঞ্জে আসিলেন। বোধ হয় সেটা ১৯৪৩-৪৪ সালের কথা হইবে। তিনি মহকুমা শাসক খুরশীদ আলম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়া উপরোক্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করিলেন। রায় বাহাদুর আর পি সাহা বিরাট অঙ্ক ষাট হাজার টাকা দান করিলেন। তিনি আরো মাসিক আর্থিক ঘাটতির টাকা পূরণ করিতে সম্মত হইলেন। তাহার পিতার নামানুসারে কলেজের নাম পরিবর্তন করা হইল।’
১৯৮০ সালের ১ মার্চ কলেজটিকে সরকারি করা হয়। এভাবেই একদা তেরশ্রী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘মানিকগঞ্জ কলেজ’ ‘দেবেন্দ্র কলেজ’ পর্যায় অতিক্রম করে ‘সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ’ নাম ধারণ করে নবযাত্রা শুরু করে। পেরিয়ে আসে প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর।
আবদুল্লাহ আল মোহন
No comments