লিবিয়ায় নির্বাচন-গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ by ম্যাগি মিখাইল

এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে


আবদেল-হাকিম বেলহাজ আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন সাবেক জিহাদি কমান্ডার। অতি সম্প্রতি তিনি তার পুরনো জুব্বা ও যোদ্ধা বেশ ছেড়ে বিজনেস সুট ধরেছেন। এই ব্যক্তিটিই লিবিয়ায় একটি ইসলামী পার্টি গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আজ শনিবার অনুষ্ঠানরত লিবিয়ার সংসদ নির্বাচনে তার দল অন্যদের থেকে এগিয়ে রয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে একটানা শাসনের পর সেখানে এটাই গণতন্ত্রের পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। রাজধানী ত্রিপোলিতে বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর সমর্থনে পোস্টার-ব্যানার দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই দেশটিতেই গাদ্দাফি দীর্ঘকাল সকল রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। তখন গাদ্দাফির স্বৈরশাসনকেই এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন নামে অভিহিত করা হতো। নয় মাস আগে গাদ্দাফি উৎখাত ও নিহত হওয়ার পর এই প্রথম গৃহযুদ্ধে দীর্ণ দেশটির ২৮ লাখ ভোটার আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। লিবীয়রা মনে করছে, এরপর তাদের ৬০ লাখ লোকের তেলসমৃদ্ধ দেশটির উন্নতি হবে। এখানকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ক্ষমতা বাড়বে।
এদিকে এখনও বেপরোয়া মিলিশিয়া দলগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলছে। আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সহিংসতার বিস্তার ঘটছে। সেখানে বস্তুত কোনো বৈধ তথা নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণেই এসব ঘটনা ঘটতে পারছে। আটককৃতদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন, এমনকি হত্যার মতো ঘটনা সেখানে ব্যাপকভাবেই ঘটছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রমাণ পেয়েছে।
এবার নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলোর সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। কারণ গাদ্দাফির সরকার ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী। মিসরে হোসনি মোবারকও একই পথের পথিক ছিলেন। এসব ইসলামী দলের মধ্যে মডারেট ইসলামী ব্রাদারহুড থেকে শুরু করে উগ্র সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী ও সাবেক জিহাদিরা রয়েছে।
অনেক অর্থ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা ব্রাদারহুড জাস্টিস ও কনস্ট্রাকশন পার্টি ভালো অবস্থান করে নিতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা ব্রাদারহুডের প্রতীক ধারণ করে ঘরে ঘরে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। আর তিনটি দল বেশ আসন জিতে নেবে বলেই মনে হচ্ছে। এই তিনটি দলের মধ্যে রয়েছে_ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ধর্মনিরপেক্ষ অ্যালায়েন্স ফর ন্যাশনাল ফোর্সেস, বেলহাজ আল-ওয়াতন ও লিবিয়ার প্রাচীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি। শেষোক্ত এই দলটি গাদ্দাফিকে হত্যা করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়েছিল।
২শ' আসনের এই লিবীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নতুন ট্রানজিশনাল সরকার গঠন করবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ওই সরকার দেশ পরিচালনা করবে। নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৩ সালে। তবে বর্তমান ট্রানজিশনাল সরকার এক ডিক্রিতে বলেছে, ভোটাররা এই প্যানেলের সদস্যদের সরাসরি নির্বাচিত করবে। অর্থাৎ ফেডারেটিভ শাসন প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা এতে লক্ষণীয়।
মিসর ও তিউনিসিয়াসহ আরব বিশ্বে যে গণবিপ্লব দেখা দেয় এই ফেডারেল ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সুফল মিলতে পারে। ওই বিপ্লবের সময় গাদ্দাফিকে উৎখাতের আহ্বানের মধ্য দিয়ে সেখানেও জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হলে তারা গাদ্দাফি বাহিনীর সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় বিদেশি সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতার। ন্যাটো তখন আকাশপথে হামলা চালানোসহ গাদ্দাফি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। গাদ্দাফি উৎখাতে নেতৃত্বদানকারী ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সাবেক মুখপাত্র গুমা এল-গামাতি বলেছেন, বিগত ৪৩ বছর ধরে একজন ভাগ্যবিধাতা দেশ শাসন করেছেন, আর এখন হাজারজনের উদ্ভব ঘটেছে। তিনি বলেন, এই নির্বাচন আয়োজনের ফলে মানুষ মনে করছে, অবশেষে ট্রেন চলতে শুরু করেছে অর্থাৎ অচলাবস্থা কাটতে শুরু করেছে। এই নেতাও একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিবাদরত লিবিয়ানদের মধ্যে প্রীতি-মৈত্রী প্রতিষ্ঠার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ না দেখা যাওয়ায় এতদিন খেয়োখেয়ি চলছিল। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সে অভাব দূর হতে পারে।
নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে দশকের পর দশক ধরে এক ব্যক্তির শাসনের জন্য বিকশিত হতে না পারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলো তাদের বিকাশের সুযোগ পাবে। সরকার অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। নিজেদের খেয়ালখুশিমতো পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে একটা সামরিক বাহিনীর কমান্ডের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
নতুন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। যাতে লিবীয়দের বিবাদগুলো মীমাংসা করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হয়, মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতে গাদ্দাফি বাহিনীর ৪ হাজারের ওপর সদস্য আটক রয়েছে।
নির্বাচনের জন্য দেশ এখন সম্পূর্ণ উৎসবের মেজাজে রয়েছে। এটা আমাদের জনগণের সংগ্রামের ফসল বলে বেলহাজ উল্লেখ করেন। তিনি বুধবার ত্রিপোলিতে এক নির্বাচনী বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছেন, তারা লিবিয়াকে আধুনিক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনও ঘটাতে চান এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র ও ইসলামপন্থিদের একটা মিশ্র অবস্থা লক্ষ্য করা যাবে। তবে অন্যরা মনে করেন, ইসলামপন্থিরা মোট আসনের অর্ধেকের বেশি জিতে নেবে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সাইফকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বললেও মিলিশিয়ারা তার বিচার লিবিয়াতেই অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। এক সময় গাদ্দাফির উত্তরসূরি বিবেচিত সাইফের সঙ্গে আঁতাতকারী হিসেবে আইসিসি টিমকে চিহ্নিত করে জিনতান বাহিনী গোটা টিমকে এক মাস আটক করে রেখেছিল।
অন্যদিকে জিবরিলকেও সাবেক গাদ্দাফি সরকারের অংশ মনে করা হয়ে থাকে। কারণ তিনি সে সময় জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান ছিলেন এবং তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া দেখভাল করতেন।
গত বৃহস্পতিবার অবমুক্ত করা এক রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্য্যালনাল আইন প্রণেতা ও সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা মানবাধিকার রক্ষার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
অ্যামনেস্টির মহিলা মুখপাত্র হাসিবা হাদি এক বিবৃতিতে বলেন, গাদ্দাফি সরকারের বিদায় নেওয়ার পর অনেক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও দেশের নিরাপত্তা মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর হাতেই রয়ে গেছে। এর মধ্যে মারাত্মক সব ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। বিবাদ দেশকে প্রায় বিভক্তির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। সারা পূর্বাঞ্চলীয় অংশেই বিভক্তির আওয়াজ বেশ জোরালো। এই অংশটি দশকের পর দশক ধরে গাদ্দাফির শাসনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনাবোধ জন্ম নেয়। আর এটা গত বছর গাদ্দাফিবিরোধী অভ্যুত্থানের সূতিকাগারও ছিল। তারা দেশের পশ্চিমাংশ থেকে তাদের আসন সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় ক্ষুব্ধ। এ জন্য তারা আজকের নির্বাচন বয়কটেরও আহ্বান জানিয়েছিল।
তবে অ্যামনেস্টি বলেছে, দেশের পরিস্থিতি উন্নতির জন্য নির্বাচন হলো প্রথম পদক্ষেপ।

নিউজউইক থেকে ভাষান্তরিত
 

No comments

Powered by Blogger.