বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ: ২০০৯ববিতা খাতুন-জলের সঙ্গে মিতালি
যেন একটা জলপরি। জলের মধ্যে ডুবসাঁতার খেলছেন। কখনো বাটারফ্লাই, কখনো ব্যাকস্ট্রোক। সুইমিং কমপ্লেক্সের নীল জল নয়। খরস্রোতা গড়াইয়েও নয়। কুষ্টিয়া আমলা খামারপাড়ার ছোট্ট একটা পুকুরে। এঁদো ডোবার মতো ছোট্ট পুকুর। দুর্গন্ধ। সেই পানিতে মিশে থাকে শেওলা। পচা শামুকে পা কাটে।
রক্তে লাল হয়ে যায় পুকুরের জল। সেদিকে খেয়াল নেই। শুধু জানেন সাঁতরাতে হবে। দুই হাতে পানি কেটে এগিয়ে যান পুকুরের এপার থেকে ওপারে। সাঁতারু গড়ার কারখানা কুষ্টিয়ার সাগরখালি সুইমিং ক্লাবে এভাবেই বেড়ে ওঠেন রুবেল রানা, সবুরাদের উত্তরসূরি একজন ববিতা খাতুন।
সাঁতারু হওয়ার ইচ্ছা মোটেও ছিল না ববিতার। হতে চেয়েছিলেন শ্যুটার। পানি দেখলেই ভয় পেতেন। এ জন্য শুরুর দিকে অনুশীলনেই যেতে চাইতেন না। চাচা বশির উদ্দিন একরকম জোর করেই একদিন পানিতে নামালেন। নিজে বড় সাঁতারু হতে পারেননি, ভাইঝিকে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করবেন—মনে এমন স্বপ্নের বীজ বুনেই ববিতাকে অনুশীলনে পাঠাতেন।
বাড়ির কাছের পুকুরে মনের মতো অনুশীলন হতো না বলে গ্রামের পাশেই গড়াই নদীতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু সেই অনুশীলনও নিত্যদিনের রুটিন মেনে করতে চাইত না ছোট্ট ববিতা। তখন কতই বা বয়স, বড়জোর সাত-আট। খেলার সাথিরা গোল্লাছুট আর কানামাছিতে মেতে উঠলে অনুশীলন ফাঁকি দিয়ে ববিতাও চলে যেতেন বন্ধুদের সঙ্গে। একদিন চাচা ঠিকই তা জেনে গেলেন। সেকি অগ্নিমূর্তি! এমনিতেই রেগে গেলে গালাগালের ফোয়ারা ছোটে চাচার মুখে। সেদিন গতি গেল আরও বেড়ে। রাগ করে সারা দিন ভাতই মুখে দেননি ববিতা। পরে মা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভাত খাইয়েছিলেন। চাচা সেদিন অত রাগ না করলে হয়তো ববিতার আজকের ববিতা হওয়া হতো না। হতে পারতেন না গ্রামীণফোন-প্রথম আলো বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদও।
প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে আবির্ভাব ২০০৪ সালে। বগুড়ায় বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। সেবার দুটি সোনার পদক জিতেছিলেন। ২০০৭ সালে ঢাকায় বয়সভিত্তিক সাঁতারে আলাদাভাবে নজর কাড়েন। জেতেন ১১টি সোনা। পরের বছর জ্বরের কারণে একেবারেই ম্রিয়মাণ, জিতেছিলেন মাত্র একটি সোনা। ২০০৯ সালে আবারও ১১টি সোনা, সঙ্গে বোনাস হিসেবে দুটি জাতীয় রেকর্ড। পুরস্কারটা এই সাফল্যেরই স্বীকৃতি।
মাঝখানে এক বছর পানিতেই নামা হয়নি। বাবা গ্রামের কৃষক। অন্যের জমিতে কাজ করেন। নুন আনতে পানতা ফুরায়। মেয়েকে পাত্রস্থ করে নিশ্চিন্ত হলেন। বিয়ে দিয়ে দিলেন গ্রামেরই যুবক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর নিজেও একজন অ্যাথলেট। বিয়ের পর তাই ববিতাকে বাধা দেননি। কিছুদিন আগে দুজনের সংসার আলো করে এসেছে ছোট্ট অতিথি জান্নাতুল ফেরদৌস। তিন মাসের দুধের শিশুকে ফেলে ঢাকায় আসতে কিছুতেই মন টানছিল না ববিতার। বলছিলেন, ‘গাড়িতে যখন উঠি, তখন বারবার মেয়ের মুখ ভেসে উঠছিল। একটুও মনে হচ্ছিল না যে ঢাকায় আসি। মেয়েটার গায়ে জ্বর। ভাবছিলাম এত কষ্ট করে গিয়ে যদি পুরস্কার না পাই। পরে ভাবলাম, পুরস্কার পাই আর না পাই, আমন্ত্রণ যখন পেয়েছি যাবই।’ ববিতার ভেতরে আছে ভালো করার অদম্য সাহস আর জেদ। একটু প্রতিবাদীও। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ফেডারেশন থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন! কোচ ইমদাদুল হকের ‘বাজে কথার’ প্রতিবাদেই এমন নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। তবে এসব তিনি ভয় পান না। শুধু কষ্ট পান, ‘আমার খুবই কষ্ট লেগেছিল সেদিন। বেশি কষ্ট লাগছিল এই জন্য যে সত্যি কথা বলেও শাস্তি পেলাম।’
সাঁতরে গড়াইয়ের এপার-ওপার যাওয়া তাঁর কাছে ফুঁ-মন্ত্রের মতো ব্যাপার। কিন্তু এভাবে গাঁয়ের নদীতে নয়, আবারও ঢেউ তুলতে চান সুইমিং কমপ্লেক্সে। যে ঢেউয়ের ধাক্কায় একদিন গলায় এসে ঝুলবে এসএ গেমসের সোনার পদক। সেই সোনালি দিনেরই অপেক্ষায় থাকেন ববিতা।
বদিউজ্জামান
No comments