ট্রানজিট-অর্থের বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে by কে এ এস মুরশিদ
ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্যে ভারতের অন্য অংশ তথা পশ্চিমাংশ থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তবে ট্রানজিট দেওয়ার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় সবার আগে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, ট্রানজিটযোগ্য পণ্যের চাহিদা নিরূপণ; দ্বিতীয়ত, ট্রানজিটের পণ্য বহনে সবচেয়ে ভালো পরিবহন (রেল, নৌ ও সড়ক) পদ্ধতি নির্ধারণ; তৃতীয়ত, সময় ও ব্যয় সাশ্রয় এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এর লাভ ভাগাভাগি; চতুর্থত, ট্রানজিট পরিচালনা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) পলিসি রিসোর্স প্রোগ্রামের (পিআরপি) আওতায় পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য নর্থইস্ট: ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রানশিপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিক কনসিডারেশন’ (বিআইডিএস-পিআরপি ওয়ার্কিং পেপার-০৬) শীর্ষক একটি গবেষণায় এ চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং কিছু নীতি-পরামর্শ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ গবেষণার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে।
ভারতের প্রধান অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর পণ্য বহন মূলত রেলপথনির্ভর ও আসামকেন্দ্রিক। রেলপথে বছরে ওই রাজ্যগুলোতে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে যে পরিমাণ পণ্য আসে (২০০৮ সালে ৬৮ লাখ ৪৭ হাজার মে. টন) এবং এখান থেকে যে পরিমাণ পণ্য যায় (২০০৮ সালে ৯০ লাখ ৮৬ হাজার মে. টন), তার যথাক্রমে ৭৯.৭ ও ৯৭.৭ শতাংশই সম্পন্ন হয় আসামের সঙ্গে। অন্য রাজ্যগুলোতে সাধারণত আসামে পণ্য খালাস করার পর তা স্থানান্তর করা হয়। অন্যদিকে, সড়কপথে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে বছরে তিন কোটি ৯০ লাখ টনের পণ্য আনা-নেওয়া হয়। ফলে সড়ক ও রেল মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে বছরে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি ট্রানজিটসুবিধা দেয়, তাহলে এই পরিমাণ পণ্যের কতখানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বহন করা হবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মণিপুরের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেঘালয়ের ক্ষেত্রেও কিছুটা পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আনা-নেওয়া হবে। এভাবে বছরে সমন্বিতভাবে ৩৩ লাখ টন (১০ লাখ টন রেলে ও ২৩ লাখ টন সড়কপথে) পণ্য ট্রানজিটে পরিবহন হতে পারে, যা বর্তমানের এই বাজারের অতি ক্ষুদ্র অংশ। সুতরাং আসামকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কতখানি বাংলাদেশি ট্রানজিটে নিয়ে আসা যাবে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে ট্রানজিট দেওয়া থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়টি।
আর তাই বাংলাদেশ সরকার যদি সত্যিই ট্রানজিট থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে আগ্রহী হয়, তাহলে এই আলোচনায় আসামের রাজ্য সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আসামের বাণিজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি পেয়ে আসছে। আসামের আগ্রহ ও সম্পৃক্ততা ছাড়া বাংলাদেশ যদি এককভাবে ট্রানজিট অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যয় শুরু করে, তাহলে তা হবে অপরিণত পদক্ষেপ।
বলা যেতে পারে, আসাম এই ট্রানজিটভিত্তিক অর্থনীতিতে কতটা যুক্ত হবে এবং আসামের সঙ্গে বাণিজ্য বাস্তবে কতটা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে—এ দুটো বিষয় নিয়ে আরও নিবিড় বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বিআইডিএসের এই গবেষণায় রেলপথভিত্তিক ট্রানজিটকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে লাভজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশে রেলওয়ের মৌলিক অবকাঠামো বিরাজমান। একে ট্রানজিট উপযোগী করতে হলে মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর তা করতে গিয়ে কার্যত গোটা রেলওয়ে খাতকেই পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঘন জনবসতির এ দেশে জায়গাজমির সাশ্রয়ী ব্যবহারে রেলওয়ের বিকল্প নেই।
তবে রেলওয়েকে ট্রানজিটের চাহিদাজনিত সুবিধার সুযোগ নিতে গেলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমূল্যের বাজারে মনোনিবেশ করতে হবে। সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে হবে এবং রেলওয়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সুশাসন ও দক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সীমান্তের একটি চেকপোস্ট থেকে আরেক চেকপোস্ট পর্যন্ত পণ্য পরিবহন হতে হবে বিরতিহীন। অর্থাৎ, যে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় পণ্য ঢুকবে, সেখানে বাংলাদেশ কাস্টমসের যাবতীয় পরীক্ষা সম্পন্ন করে ছাড়পত্র দিয়ে। এটি নিয়ে আবার উত্তর-পূর্ব রাজ্যের যে সীমান্ত দিয়ে পণ্য বাংলাদেশ ত্যাগ করবে, সেখানে গিয়ে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পণ্য ছেড়ে দেওয়া হবে।
তবে যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের বিষয়টি অনিশ্চিত থাকায় এই বিরতিহীন যাত্রা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে যমুনার এপারে-ওপারে পণ্য ওঠানো-নামানো করার ও দুই পারের জন্য পণ্যবাহী ফেরি চালু করতে হবে, যা আবার ব্যয়বহুল ও সময় ক্ষেপণকারী হবে। পাশাপাশি নানা ধরনের পরিচালনাগত ঝক্কি থাকছেই। রেল ট্রানজিটের জন্য আখাউড়া-আগরতলা সংযোগ স্থাপন এবং বন্ধ হয়ে থাকা কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন চালু করতে হবে। টঙ্গী-শাহবাজপুর রুট ডুয়েল গেজ করা প্রয়োজন। এসব কাজসহ সার্বিকভাবে অবকাঠামো ও পরিচালনা উন্নয়নে অন্তত ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে রেলওয়েকে।
চাহিদা নিরূপণ ও ট্রানজিটের পথপদ্ধতি বাছাই হয়ে গেলে পরে ট্রানজিট পরিচালনাগত দিকে মনোযোগ দিতে হয়। ট্রানজিটের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক নিষিদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, এমন ধরনের যেকোনো পণ্যও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে হবে। আধুনিক স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে পরিবহন করা পণ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য প্রবেশ ও প্রস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে তিনটি বিষয় কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এগুলো হলো: ঘোষিত চালান বা দলিলের সঙ্গে বহনকৃত পণ্যের সাযুজ্য সঠিকভাবে পরীক্ষা করা; প্রযোজ্য শুল্ক ও মাশুল আদায় ও পণ্যবাহী কনটেইনার যথাযথভাবে সিলগালা আছে কি না নিশ্চিত করা।
বিআইডিএস-পিআরপির গবেষণায় আরও প্রতীয়মান হয়েছে, কলকাতা-গুয়াহাটি রেল বা সড়কপথের বাণিজ্য ট্রানজিটের দিকে ধাবিত হবে না। কারণ বর্তমানে এই পথে যে খরচ পড়ে, বাংলাদেশ রেলওয়ে তার চেয়ে খরচ কমাতে পারবে না। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা-শিলচর বাণিজ্যপথ কিছুটা লাভজনক হবে। প্রতি টনে রেলওয়ে গড়ে ৪৭০ টাকা করে লাভ তুলতে পারবে। তবে সবচেয়ে লাভজনক হবে কলকাতা-আগরতলা বাণিজ্যপথ। বাংলাদেশ ট্রানজিট দিলে বর্তমানের ১৬৮০ কিলোমিটারের দূরত্ব নেমে আসবে মাত্র ৪৯৬ কিলোমিটারে। বাংলাদেশ প্রতি টনে দেড় হাজার টাকা করে লাভ তুলতে পারবে।
মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বছরে ৪০ লাখ টন পণ্য আনা-নেওয়ার ফলে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ট্রানজিট মাশুল নিলে বাংলাদেশ পাঁচ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রাজস্ব পাবে। এ থেকে যদি বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর দেওয়া ভর্তুকি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে প্রকৃত রাজস্ব আয় প্রায় দেড় কোটি ডলার হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদি দর-কষাকষি করে মাশুল দ্বিগুণও করা হয়, তা হলেও এই আয় তিন কোটি ডলারের বেশি হবে না। ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে দেড় থেকে তিন কোটি ডলার পর্যন্ত আয় খুব একটা খারাপ নয়। তবে আমাদের লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর এর প্রভাব খুবই অল্প হবে।
গবেষণার সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ বা প্রাপ্তিযোগ আসলে সীমিত। তার পরও বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবে তা বিদ্যমান নৌপথের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে রেল সংযোগের মাধ্যমে। এতে একদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের পুনর্গঠন জোরদার হবে। অন্যদিকে, নয়াদিল্লিকে এই ইতিবাচক বার্তা দেওয়াও সম্ভব হবে যে বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে সহযোগিতার নতুন অধ্যায় খুলতে চায়। এ জন্য সে কিছু প্রাপ্তিযোগেরও প্রত্যাশী।
তা ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের মানুষের মধ্যেও মানসিকতার কিছু পরিবর্তন দরকার। এই রাজ্যগুলোর অনেকেই বাংলাদেশকে সন্দেহের চোখে দেখে। ট্রানজিটের সুযোগে ভারতের মূল ভূখণ্ড ও বাংলাদেশ থেকে লোকজনের আগমন বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন আশঙ্কাও এসব রাজ্যের মানুষের রয়েছে।
ট্রানজিটকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনায় বাংলাদেশকে নিজের কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা গ্রহণের দিকটিও ভাবতে হবে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিনিয়োগ করা, প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ আহরণে বাণিজ্যিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে সেখানকার কাঁচামাল ব্যবহারের সুযোগ নেওয়ার মতো বিষয়গুলো চিন্তা করার সুযোগ আছে। এ জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রস্তুতি নিতে হবে। ট্রানজিটের বিনিময়ে সরকারি কোষাগারে অর্থপ্রাপ্তির বাইরে সুদূরপ্রসারী অন্য সুবিধার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
কে এ এস মুরশিদ: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
murshid@bids.org.bd
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) পলিসি রিসোর্স প্রোগ্রামের (পিআরপি) আওতায় পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য নর্থইস্ট: ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রানশিপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিক কনসিডারেশন’ (বিআইডিএস-পিআরপি ওয়ার্কিং পেপার-০৬) শীর্ষক একটি গবেষণায় এ চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং কিছু নীতি-পরামর্শ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ গবেষণার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে।
ভারতের প্রধান অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর পণ্য বহন মূলত রেলপথনির্ভর ও আসামকেন্দ্রিক। রেলপথে বছরে ওই রাজ্যগুলোতে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে যে পরিমাণ পণ্য আসে (২০০৮ সালে ৬৮ লাখ ৪৭ হাজার মে. টন) এবং এখান থেকে যে পরিমাণ পণ্য যায় (২০০৮ সালে ৯০ লাখ ৮৬ হাজার মে. টন), তার যথাক্রমে ৭৯.৭ ও ৯৭.৭ শতাংশই সম্পন্ন হয় আসামের সঙ্গে। অন্য রাজ্যগুলোতে সাধারণত আসামে পণ্য খালাস করার পর তা স্থানান্তর করা হয়। অন্যদিকে, সড়কপথে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে বছরে তিন কোটি ৯০ লাখ টনের পণ্য আনা-নেওয়া হয়। ফলে সড়ক ও রেল মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে বছরে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি ট্রানজিটসুবিধা দেয়, তাহলে এই পরিমাণ পণ্যের কতখানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বহন করা হবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মণিপুরের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেঘালয়ের ক্ষেত্রেও কিছুটা পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আনা-নেওয়া হবে। এভাবে বছরে সমন্বিতভাবে ৩৩ লাখ টন (১০ লাখ টন রেলে ও ২৩ লাখ টন সড়কপথে) পণ্য ট্রানজিটে পরিবহন হতে পারে, যা বর্তমানের এই বাজারের অতি ক্ষুদ্র অংশ। সুতরাং আসামকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কতখানি বাংলাদেশি ট্রানজিটে নিয়ে আসা যাবে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে ট্রানজিট দেওয়া থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়টি।
আর তাই বাংলাদেশ সরকার যদি সত্যিই ট্রানজিট থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে আগ্রহী হয়, তাহলে এই আলোচনায় আসামের রাজ্য সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আসামের বাণিজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি পেয়ে আসছে। আসামের আগ্রহ ও সম্পৃক্ততা ছাড়া বাংলাদেশ যদি এককভাবে ট্রানজিট অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যয় শুরু করে, তাহলে তা হবে অপরিণত পদক্ষেপ।
বলা যেতে পারে, আসাম এই ট্রানজিটভিত্তিক অর্থনীতিতে কতটা যুক্ত হবে এবং আসামের সঙ্গে বাণিজ্য বাস্তবে কতটা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে—এ দুটো বিষয় নিয়ে আরও নিবিড় বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বিআইডিএসের এই গবেষণায় রেলপথভিত্তিক ট্রানজিটকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে লাভজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশে রেলওয়ের মৌলিক অবকাঠামো বিরাজমান। একে ট্রানজিট উপযোগী করতে হলে মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর তা করতে গিয়ে কার্যত গোটা রেলওয়ে খাতকেই পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঘন জনবসতির এ দেশে জায়গাজমির সাশ্রয়ী ব্যবহারে রেলওয়ের বিকল্প নেই।
তবে রেলওয়েকে ট্রানজিটের চাহিদাজনিত সুবিধার সুযোগ নিতে গেলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমূল্যের বাজারে মনোনিবেশ করতে হবে। সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে হবে এবং রেলওয়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সুশাসন ও দক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সীমান্তের একটি চেকপোস্ট থেকে আরেক চেকপোস্ট পর্যন্ত পণ্য পরিবহন হতে হবে বিরতিহীন। অর্থাৎ, যে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় পণ্য ঢুকবে, সেখানে বাংলাদেশ কাস্টমসের যাবতীয় পরীক্ষা সম্পন্ন করে ছাড়পত্র দিয়ে। এটি নিয়ে আবার উত্তর-পূর্ব রাজ্যের যে সীমান্ত দিয়ে পণ্য বাংলাদেশ ত্যাগ করবে, সেখানে গিয়ে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পণ্য ছেড়ে দেওয়া হবে।
তবে যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের বিষয়টি অনিশ্চিত থাকায় এই বিরতিহীন যাত্রা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে যমুনার এপারে-ওপারে পণ্য ওঠানো-নামানো করার ও দুই পারের জন্য পণ্যবাহী ফেরি চালু করতে হবে, যা আবার ব্যয়বহুল ও সময় ক্ষেপণকারী হবে। পাশাপাশি নানা ধরনের পরিচালনাগত ঝক্কি থাকছেই। রেল ট্রানজিটের জন্য আখাউড়া-আগরতলা সংযোগ স্থাপন এবং বন্ধ হয়ে থাকা কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন চালু করতে হবে। টঙ্গী-শাহবাজপুর রুট ডুয়েল গেজ করা প্রয়োজন। এসব কাজসহ সার্বিকভাবে অবকাঠামো ও পরিচালনা উন্নয়নে অন্তত ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে রেলওয়েকে।
চাহিদা নিরূপণ ও ট্রানজিটের পথপদ্ধতি বাছাই হয়ে গেলে পরে ট্রানজিট পরিচালনাগত দিকে মনোযোগ দিতে হয়। ট্রানজিটের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক নিষিদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, এমন ধরনের যেকোনো পণ্যও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে হবে। আধুনিক স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে পরিবহন করা পণ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য প্রবেশ ও প্রস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে তিনটি বিষয় কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এগুলো হলো: ঘোষিত চালান বা দলিলের সঙ্গে বহনকৃত পণ্যের সাযুজ্য সঠিকভাবে পরীক্ষা করা; প্রযোজ্য শুল্ক ও মাশুল আদায় ও পণ্যবাহী কনটেইনার যথাযথভাবে সিলগালা আছে কি না নিশ্চিত করা।
বিআইডিএস-পিআরপির গবেষণায় আরও প্রতীয়মান হয়েছে, কলকাতা-গুয়াহাটি রেল বা সড়কপথের বাণিজ্য ট্রানজিটের দিকে ধাবিত হবে না। কারণ বর্তমানে এই পথে যে খরচ পড়ে, বাংলাদেশ রেলওয়ে তার চেয়ে খরচ কমাতে পারবে না। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা-শিলচর বাণিজ্যপথ কিছুটা লাভজনক হবে। প্রতি টনে রেলওয়ে গড়ে ৪৭০ টাকা করে লাভ তুলতে পারবে। তবে সবচেয়ে লাভজনক হবে কলকাতা-আগরতলা বাণিজ্যপথ। বাংলাদেশ ট্রানজিট দিলে বর্তমানের ১৬৮০ কিলোমিটারের দূরত্ব নেমে আসবে মাত্র ৪৯৬ কিলোমিটারে। বাংলাদেশ প্রতি টনে দেড় হাজার টাকা করে লাভ তুলতে পারবে।
মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বছরে ৪০ লাখ টন পণ্য আনা-নেওয়ার ফলে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ট্রানজিট মাশুল নিলে বাংলাদেশ পাঁচ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রাজস্ব পাবে। এ থেকে যদি বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর দেওয়া ভর্তুকি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে প্রকৃত রাজস্ব আয় প্রায় দেড় কোটি ডলার হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদি দর-কষাকষি করে মাশুল দ্বিগুণও করা হয়, তা হলেও এই আয় তিন কোটি ডলারের বেশি হবে না। ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে দেড় থেকে তিন কোটি ডলার পর্যন্ত আয় খুব একটা খারাপ নয়। তবে আমাদের লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর এর প্রভাব খুবই অল্প হবে।
গবেষণার সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ বা প্রাপ্তিযোগ আসলে সীমিত। তার পরও বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবে তা বিদ্যমান নৌপথের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে রেল সংযোগের মাধ্যমে। এতে একদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের পুনর্গঠন জোরদার হবে। অন্যদিকে, নয়াদিল্লিকে এই ইতিবাচক বার্তা দেওয়াও সম্ভব হবে যে বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে সহযোগিতার নতুন অধ্যায় খুলতে চায়। এ জন্য সে কিছু প্রাপ্তিযোগেরও প্রত্যাশী।
তা ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের মানুষের মধ্যেও মানসিকতার কিছু পরিবর্তন দরকার। এই রাজ্যগুলোর অনেকেই বাংলাদেশকে সন্দেহের চোখে দেখে। ট্রানজিটের সুযোগে ভারতের মূল ভূখণ্ড ও বাংলাদেশ থেকে লোকজনের আগমন বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন আশঙ্কাও এসব রাজ্যের মানুষের রয়েছে।
ট্রানজিটকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনায় বাংলাদেশকে নিজের কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা গ্রহণের দিকটিও ভাবতে হবে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিনিয়োগ করা, প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ আহরণে বাণিজ্যিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে সেখানকার কাঁচামাল ব্যবহারের সুযোগ নেওয়ার মতো বিষয়গুলো চিন্তা করার সুযোগ আছে। এ জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রস্তুতি নিতে হবে। ট্রানজিটের বিনিময়ে সরকারি কোষাগারে অর্থপ্রাপ্তির বাইরে সুদূরপ্রসারী অন্য সুবিধার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
কে এ এস মুরশিদ: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
murshid@bids.org.bd
No comments