ওষুধ নিয়ে অন্ধকারে মানুষ নেপথ্যে ব্যবসা by তৌফিক মারুফ
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। চিকিৎসকের পরামর্শপত্র হাতে নিয়ে ওষুধ কেনার জন্য একটি কক্ষ থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে বের হলেন আরমান আলী। বাইরে করিডরে তখন একদল যুবকের জটলা। তাঁরা আরমান আলীকে কাগজ হাতে দেখেই একযোগে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। একজন পরামর্শপত্রটি কেড়ে নিলেন।
এরপর সবাই মিলে চলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওষুধের নাম পড়া। এ অবস্থায় আরমান আলী অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আরমান আলীর ব্যবস্থাপত্রের ওপর হামলে পড়া এই যুবকরা বিভিন্ন ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধি। তাঁদের হাত থেকে সাত-আট মিনিট পর ছাড়া পেয়ে ওষুধের দোকানের দিকে যেতে যেতে আরমান কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার ভাগি্নটার অপারেশন চলছে। তালিকা অনুসারে আগেই অনেক ওষুধ কিনে দিয়েছি। কিন্তু ভেতর থেকে এখন জরুরিভাবে আরো দুটি ওষুধ নিয়ে আসতে বলল। কিন্তু ওই লোকগুলো আমাকে দেরি করিয়ে দিল। হাসপাতালের মধ্যে এই অবস্থা কিভাবে চলছে, বুঝতে পারছি না।' পরক্ষণেই তিনি বলেন, 'যে কম্পানির ওষুধ লেখা হয়েছে, ঠিক সেটাই নিতে বলে দিয়েছেন ডাক্তার। অন্য কম্পানির হলে নাকি চলবে না!'
ওই হাসপাতালের সামনের পরপর তিনটি ওষুধের দোকান ঘুরেও পাওয়া যায়নি ওই ওষুধ। পরে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে আরেক দোকান থেকে আনা হয় ওষুধটি। এতে প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজে পড়িমরি করে ওষুধ নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই আরমান আলীকে ধমক লাগান কর্তব্যরত একজন নার্স, 'ওই মিয়া, এত দেরি লাগল ক্যান? যেই কম্পানির ওষুধ লিখছে সেইটাই আনছেন তো!'
আরেক রোগীর স্বজন অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন, 'এ কী অবস্থা দেখেন! নিজের টাকায় ওষুধ খাবেন, কিন্তু কোন কম্পানির ওষুধ খাবেন, তা ঠিক করে দেন চিকিৎসকরা! এ জন্য ওষুধ কম্পানির লোকেরা আগে থেকেই লেগে আছেন চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতাদের পেছনে। এর সঙ্গে এখন কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে ভোক্তা বা ওষুধ ক্রেতাকে ঘিরে ধরার প্রবণতা। ওষুধের ক্ষেত্রে ক্রেতা বা ভোক্তার কোনো পছন্দ-অপছন্দের অধিকার নেই।' এ ঘটনা গত রবিবার দুপুরের।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসকদের দায়িত্ব কেবল রোগীর প্রয়োজন অনুসারে ওষুধের মূল বা জেনেরিক নাম লিখে দেওয়া। কিন্তু চিকিৎসকরা তা না করে নিজেদের পছন্দমতো কম্পানির ওষুধের নাম লিখে দেন। আর ওষুধ কম্পানিগুলোও প্রকাশ্যে চিকিৎসকদের পায়ে পায়ে ঘুরে তাঁদের প্রভাবিত করছেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের মতো এ দেশেও ওষুধের জেনেরিক নাম চালু করে বাছাই করা কিছু জরুরি ওষুধকে জনস্বার্থে প্রচারণার আওতায় আনা উচিত। ফলে ওষুধ কেনা ও সেবনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি ও হয়রানি অনেক কমে যাবে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ওষুধের প্রচারণার অনুমতিদান এবং ওসিটি তালিকা প্রকাশেরও পক্ষে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ওষুধ সম্পর্কে মানুষের জানাশোনার পরিধি বাড়ানো ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধান হতে হবে যাতে হিতে বিপরীত না হয়। মানুষ যেন সব ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারে আসক্ত হয়ে না পড়ে।
অধ্যাপক ফারুক আরো বলেন, 'সাধারণ ওষুধ, বিশেষ করে যেসব ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতির সম্ভাবনা কম এমন কিছু ওষুধ বাছাই করে একটি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) তালিকা করার জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা আছে।' তাঁর মতে, ওটিসি তালিকা হলে মানুষ সাধারণ জ্ঞান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে তালিকাভুক্ত ওষুধ কিনতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শিফায়েত উল্লাহ বলেন, এমবিবিএস না করেই অনেকে চিকিৎসাসেবার নামে বিভিন্ন কম্পানির ওষুধের নাম লিখে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেও অনেক ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ওটিসি তালিকা হলে এসব কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি কমে আসবে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মতো এখানেও ওটিসি তালিকা করা উচিত। এতে মানুষের সুবিধা হবে। ওষুধ শিল্পও উপকৃত হবে। তিনি আরো বলেন, ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সে দেশের অনেক ওষুধের বিজ্ঞাপন থেকে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ কেনার জন্য প্রভাবিত হয়। এভাবে দেশে ভারতীয় ওষুধের বাজার যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি প্রচারের অভাবে স্থানীয় ওষুধের বাজার নষ্ট হচ্ছে।
সবাই যে ওটিসি তালিকার পক্ষে, এমনও নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, ওটিসি তালিকা ভোক্তাদের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া ছোট কম্পানিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা একটি ওটিসি ওষুধের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা করেছি। প্রক্রিয়াধীন ওষুধ নীতিমালার ভেতরেও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হবে। নীতিমালা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯৭ সালে সংশোধিত) অনুসারে ওষুধের বাণিজ্যিক প্রচারণা নিষিদ্ধ। আইনে শুধু চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর সুযোগ আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ থাকলেও ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সে দেশের ওষুধের প্রচার চলে। বাংলাদেশে এসব চ্যানেল দেখা যায় বলে এর প্রভাবও পড়ছে। সূত্র মতে, বিষয়টি ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে এবং বিদ্যমান আইনের পক্ষে-বিপক্ষে মত পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে এখনো সরকারের তরফে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে দেশে অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা ১ হাজার ২০০। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী ২৬৫টি প্রতিষ্ঠানই জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাত করছে প্রায় ২২ হাজার ওষুধ। এসব ওষুধ সম্পর্কে কেবল চিকিৎসকদের মধ্যে প্রচারণা চালানো যায়। তবে ফুড সাপ্লিমেন্টারি কোনো আইটেমের প্রচারণায় বাধা নেই।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএর সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য আন্দোলন-বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ওটিসি তালিকা নিয়ে কাজ চলছে। তবে তালিকা করার পর এসব ওষুধের কথা প্রচারের সুযোগ দেওয়া হবে কি হবে না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, ওষুধ সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা থাকা ভালো। এ জন্য প্রচারণামূলক ব্যবস্থার যেমন সুবিধা আছে তেমনি অনেক ঝুঁকিও আছে। কোনো বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে এমনটা হলে তা হবে খুবই বিপজ্জনক। তাই প্রচারণার ব্যবস্থা করা হলে তা মনিটরিংয়ের জন্যও শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মীর মিসবাহ উদ্দিন অবশ্য ওটিসি নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে এমনিতেই অনেক ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কেউ কিনতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এতে ওষুধের অপপ্রয়োগ বেড়ে যাচ্ছে। সবার আগে ওষুধ অধিদপ্তরকে কার্যকর ও শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার। তা না করে ওটিসি তালিকা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।'
আরমান আলীর ব্যবস্থাপত্রের ওপর হামলে পড়া এই যুবকরা বিভিন্ন ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধি। তাঁদের হাত থেকে সাত-আট মিনিট পর ছাড়া পেয়ে ওষুধের দোকানের দিকে যেতে যেতে আরমান কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার ভাগি্নটার অপারেশন চলছে। তালিকা অনুসারে আগেই অনেক ওষুধ কিনে দিয়েছি। কিন্তু ভেতর থেকে এখন জরুরিভাবে আরো দুটি ওষুধ নিয়ে আসতে বলল। কিন্তু ওই লোকগুলো আমাকে দেরি করিয়ে দিল। হাসপাতালের মধ্যে এই অবস্থা কিভাবে চলছে, বুঝতে পারছি না।' পরক্ষণেই তিনি বলেন, 'যে কম্পানির ওষুধ লেখা হয়েছে, ঠিক সেটাই নিতে বলে দিয়েছেন ডাক্তার। অন্য কম্পানির হলে নাকি চলবে না!'
ওই হাসপাতালের সামনের পরপর তিনটি ওষুধের দোকান ঘুরেও পাওয়া যায়নি ওই ওষুধ। পরে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে আরেক দোকান থেকে আনা হয় ওষুধটি। এতে প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজে পড়িমরি করে ওষুধ নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই আরমান আলীকে ধমক লাগান কর্তব্যরত একজন নার্স, 'ওই মিয়া, এত দেরি লাগল ক্যান? যেই কম্পানির ওষুধ লিখছে সেইটাই আনছেন তো!'
আরেক রোগীর স্বজন অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন, 'এ কী অবস্থা দেখেন! নিজের টাকায় ওষুধ খাবেন, কিন্তু কোন কম্পানির ওষুধ খাবেন, তা ঠিক করে দেন চিকিৎসকরা! এ জন্য ওষুধ কম্পানির লোকেরা আগে থেকেই লেগে আছেন চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতাদের পেছনে। এর সঙ্গে এখন কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে ভোক্তা বা ওষুধ ক্রেতাকে ঘিরে ধরার প্রবণতা। ওষুধের ক্ষেত্রে ক্রেতা বা ভোক্তার কোনো পছন্দ-অপছন্দের অধিকার নেই।' এ ঘটনা গত রবিবার দুপুরের।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসকদের দায়িত্ব কেবল রোগীর প্রয়োজন অনুসারে ওষুধের মূল বা জেনেরিক নাম লিখে দেওয়া। কিন্তু চিকিৎসকরা তা না করে নিজেদের পছন্দমতো কম্পানির ওষুধের নাম লিখে দেন। আর ওষুধ কম্পানিগুলোও প্রকাশ্যে চিকিৎসকদের পায়ে পায়ে ঘুরে তাঁদের প্রভাবিত করছেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের মতো এ দেশেও ওষুধের জেনেরিক নাম চালু করে বাছাই করা কিছু জরুরি ওষুধকে জনস্বার্থে প্রচারণার আওতায় আনা উচিত। ফলে ওষুধ কেনা ও সেবনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি ও হয়রানি অনেক কমে যাবে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ওষুধের প্রচারণার অনুমতিদান এবং ওসিটি তালিকা প্রকাশেরও পক্ষে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ওষুধ সম্পর্কে মানুষের জানাশোনার পরিধি বাড়ানো ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধান হতে হবে যাতে হিতে বিপরীত না হয়। মানুষ যেন সব ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারে আসক্ত হয়ে না পড়ে।
অধ্যাপক ফারুক আরো বলেন, 'সাধারণ ওষুধ, বিশেষ করে যেসব ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতির সম্ভাবনা কম এমন কিছু ওষুধ বাছাই করে একটি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) তালিকা করার জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা আছে।' তাঁর মতে, ওটিসি তালিকা হলে মানুষ সাধারণ জ্ঞান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে তালিকাভুক্ত ওষুধ কিনতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শিফায়েত উল্লাহ বলেন, এমবিবিএস না করেই অনেকে চিকিৎসাসেবার নামে বিভিন্ন কম্পানির ওষুধের নাম লিখে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেও অনেক ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ওটিসি তালিকা হলে এসব কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি কমে আসবে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মতো এখানেও ওটিসি তালিকা করা উচিত। এতে মানুষের সুবিধা হবে। ওষুধ শিল্পও উপকৃত হবে। তিনি আরো বলেন, ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সে দেশের অনেক ওষুধের বিজ্ঞাপন থেকে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ কেনার জন্য প্রভাবিত হয়। এভাবে দেশে ভারতীয় ওষুধের বাজার যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি প্রচারের অভাবে স্থানীয় ওষুধের বাজার নষ্ট হচ্ছে।
সবাই যে ওটিসি তালিকার পক্ষে, এমনও নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, ওটিসি তালিকা ভোক্তাদের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া ছোট কম্পানিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা একটি ওটিসি ওষুধের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা করেছি। প্রক্রিয়াধীন ওষুধ নীতিমালার ভেতরেও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হবে। নীতিমালা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯৭ সালে সংশোধিত) অনুসারে ওষুধের বাণিজ্যিক প্রচারণা নিষিদ্ধ। আইনে শুধু চিকিৎসকদের কাছে ওষুধ সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর সুযোগ আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ থাকলেও ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সে দেশের ওষুধের প্রচার চলে। বাংলাদেশে এসব চ্যানেল দেখা যায় বলে এর প্রভাবও পড়ছে। সূত্র মতে, বিষয়টি ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে এবং বিদ্যমান আইনের পক্ষে-বিপক্ষে মত পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে এখনো সরকারের তরফে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে দেশে অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা ১ হাজার ২০০। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী ২৬৫টি প্রতিষ্ঠানই জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাত করছে প্রায় ২২ হাজার ওষুধ। এসব ওষুধ সম্পর্কে কেবল চিকিৎসকদের মধ্যে প্রচারণা চালানো যায়। তবে ফুড সাপ্লিমেন্টারি কোনো আইটেমের প্রচারণায় বাধা নেই।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএর সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য আন্দোলন-বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ওটিসি তালিকা নিয়ে কাজ চলছে। তবে তালিকা করার পর এসব ওষুধের কথা প্রচারের সুযোগ দেওয়া হবে কি হবে না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, ওষুধ সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা থাকা ভালো। এ জন্য প্রচারণামূলক ব্যবস্থার যেমন সুবিধা আছে তেমনি অনেক ঝুঁকিও আছে। কোনো বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে এমনটা হলে তা হবে খুবই বিপজ্জনক। তাই প্রচারণার ব্যবস্থা করা হলে তা মনিটরিংয়ের জন্যও শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মীর মিসবাহ উদ্দিন অবশ্য ওটিসি নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে এমনিতেই অনেক ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কেউ কিনতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এতে ওষুধের অপপ্রয়োগ বেড়ে যাচ্ছে। সবার আগে ওষুধ অধিদপ্তরকে কার্যকর ও শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার। তা না করে ওটিসি তালিকা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।'
No comments