নির্বাচন-নতুন ইতিহাস নির্মাণ করা সম্ভব by আবদুল মান্নান
২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের দুটি বড় দল ইতিমধ্যে হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে। এটি ভালো লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই নির্বাচন তাঁর সরকারের বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই অনুষ্ঠিত হবে। সংসদে প্রধান বিরোধী দল দুই বছর ধরে মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করে আসছে।
এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। বিরোধী দলে গিয়ে নিজের নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে এমন দাবি তোলা নতুন কিছু নয়। তবে বাস্তবে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া সব সরকারই তাদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা তাঁর দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৭৫টি আসনের অবস্থা ভালো, ৩০টির অবস্থা মাঝামাঝি আর ৩০টির অবস্থা খুব খারাপ। বিএনপি মনে করে, তাদের দাবি অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নামক দলটির অস্তিত্ব তেমন থাকবে না, তারা বড়জোর ১০-২০টি আসনে বিজয়ী হতে পারে। তারা মনে করে, ভোটাররা তাদের আগের শাসনামলের সব অপকর্মের কথা ইতিমধ্যে ভুলে গেছেন। তবে তাদের ধারণা তেমন অমূলক তা বলা যাবে না। কারণ, বাঙালি খুব বিস্মৃতিপরায়ণ।
শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। যেদিন তিনি তাঁর এই বক্তব্য দিলেন, সেদিন রাতের এক টক শোতে একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ১৭৫ আসন অর্ধেক হতে বেশি সময় লাগবে না। অনুজপ্রতিম সাংবাদিক সোহরাব হাসান প্রথম আলোয় উপসম্পাদকীয়তে ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে বলার চেষ্টা করলেন, ২৩৩ আসন থেকে ১৭৫ আসনে নামতে যদি সাড়ে তিন বছর সময় লাগে, তাহলে বাকি দেড় বছরে তা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা হিসাব করতে হবে। সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে কার্টুন দিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন ১৭৫-এর ১ ব্যর্থতার ভারে আবর্জনার ঝুড়িতে পড়ে যেতে পারে। বন্ধু মুনতাসীর মামুন সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের অবস্থা শহরে তেমন ভালো না হলেও গ্রামে ভালো। কারণ, শেখ হাসিনা গ্রামের মানুষের পেটে ভাত দিয়েছেন।
একটু পেছনে ফিরে গিয়ে দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সম্পূর্ণ নির্বাচন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিচ্ছেন, তখন সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি একটি দৈনিকে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে একটি উপসম্পাদকীয় পাঠিয়েছিলাম। অবশ্য সেটি তখন প্রকাশিত হয়নি। সম্ভবত পত্রিকাটি জনমনে হতাশা প্রচার করতে চায়নি। তবে একই সন্দেহ প্রকাশ করে অন্য দুটি জাতীয় দৈনিকে উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম মূসা ও আবেদ খান। নির্বাচনের পর তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। জনগণের কাতারে থেকে জনগণের মতি-গতি বোঝা খুব কঠিন নয়। শাসক জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমলা, স্তাবক, তোষামোদকারী আর গোয়েন্দানির্ভর হয়ে পড়লে বিপদ হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ের। তখনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়নি। এটি মোটামুটি নিশ্চিত, নাগরিক কমিটির ব্যানারে তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় চার দশকের। আমাকে পরিবারের একজনের মতো স্নেহ করেন। তাঁর প্রতিটা নির্বাচনের সময় সাধ্যমতো তাঁর জন্য পরিশ্রম করেছি। এবার বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে নয়। তিনবারের নির্বাচিত মেয়র অনেক পুরোনো বন্ধু ও সুহূদ হারিয়েছেন। কাছে টানতে পারেননি নতুন কাউকে। কিছু স্তাবক আর চাটুকার তাঁর চারপাশে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছিল। সময় চেয়ে নিয়ে আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে এক সকালে তাঁর বাসায় হাজির হলাম। দুজনের মধ্যে অনেকটা ক্লোজডোর মিটিং। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সামনের নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনা সহজ হবে না। যদি ছিনিয়েই আনতে হয়, তাহলে তাঁকে ঘর গোছাতে হবে এবং দূরে সরে যাওয়া মানুষদের কাছে টানতে হবে, চাটুকারমুক্ত হতে হবে। তিনি ধৈর্য সহকারে শুনলেন। কাজ হলো না কিছু। পরের ঘটনা সবাই জানে। প্রায় এক লাখ ভোটে পরাজিত হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁঁরই একজন ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে।
এবার দেখা যাক আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৭৫ আসনের ভবিষ্যদ্বাণীর কী হতে পারে। আমার আলোচনায় কেউ সহমত পোষণ করবেন তা মনে করি না। তবে বলে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে স্বস্তি বোধ করে, তার মধ্যে আমিও একজন। এই স্বস্তিবোধটা এই কারণে নয় যে দলটি ক্ষমতায় এলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো কিছু প্রত্যাশা করি। স্বস্তিবোধ এই কারণেই, দলটি বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল। এই দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনো মনে করা হয়, এই দলটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতীক। এই দল বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। ইদানীং দলে অনেক সুবিধাবাদীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে সত্য কিন্তু এই দলে এখনো তৃণমূল পর্যায়ে লাখ লাখ নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা দলটির জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর পালা করে বিএনপি-জামায়াত জোট আর আওয়ামী লীগ চার মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কোনো দল পর পর দুবার ক্ষমতায় ছিল না। সে হিসাবে সামনের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার কথা। তেমনটি হবে বলে অনেকে মনেও করেন। তবে সব সময় তা না-ও হতে পারে, যদি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাকি সময়টা কার্যকরভাবে দল গোছাতে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আরও মনোযোগী হয়।
এটা স্বীকার করতেই হবে অন্য যে কোনো দলের চেয়ে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের চাহিদা এবং প্রত্যাশা অনেক গুণ বেশি। মানুষ মনে করে যে দলটি বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে পারে, সে দল দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছুই করতে পারে। অন্য দলগুলো তো অনেকটা সুবিধাভোগীদের ক্লাবের মতো। বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই ছিল ত্যাগে ভরপুর। সুতরাং তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণেও তা থাকা উচিত। তারা বঙ্গবন্ধুর ওই শূন্যস্থানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেখতে চায়। কিন্তু বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর ওই স্থান পূরণ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তার পরও তারা শেখ হাসিনার ওপর তাদের আস্থা রাখতে চায়। কিন্তু অনেক সময় তাঁর চারপাশে থাকা কিছু ব্যক্তি, স্তাবক, কিছু মন্ত্রী এবং কিছু নেতা-নেত্রীর অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের কারণে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল, নির্বাচনে বিজয়ী হলে পদ্মা সেতু হবে। সেটা হয়নি। তাই বলে কি এই পদ্মা সেতু না হওয়াটা আগামী নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখবে? হয়তো রাখবে, তবে তার চেয়েও বেশি রাখবে দলটিকে ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সে অভিযোগ। সাধারণ মানুষ বুঝতে অক্ষম, যাঁদের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে, মন্ত্রিসভা থেকে তাঁদের ছেঁটে ফেললে দল বা সরকারের কী ক্ষতি? মন্ত্রিসভায় ডজন খানেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা না থাকলে দল বা সরকারের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। সরকারের সাড়ে তিন বছরে তাঁদের দৃশ্যমান কোনো অর্জন চোখে পড়ে না। মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে তাঁদের বাদ দিয়ে কাজের লোক মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলে বাদ যাওয়াদের ব্যক্তিগত ক্ষতি হতে পারে। তবে দল ও জাতি লাভবান হবে।
যেসব জিনিস মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারমূল্য ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শহুরে মানুষের কাছে। আবার শহুরে মানুষেরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে তাদের মতামত ব্যক্ত করে গ্রামের মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। আগামী দেড় বছরে দ্রুততম সময়ে এসব সমস্যার উন্নতি ঘটাতে হবে। মানুষ কোনো অজুহাত শুনতে নারাজ। তারা বলে অজুহাত না শোনার জন্যই তো আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছি। তা না হলে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যে দুঃশাসন চলছিল, তা তেমন আর খারাপ কী ছিল? বর্তমান অবস্থা বিচার করলে এটি সবার কাছে মনে হবে, বাংলাদেশে যেসব ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের আমদানি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা প্রত্যেকে অসাধু এবং প্রত্যেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করেন। তাঁদের খপ্পর থেকে মানুষকে বের করে আনা সরকারের দায়িত্ব। এতে হয়তো সরকারি দলের কিছু মাথা যাবে। তাতে ক্ষতি কী? এঁদের কারণেই তো আগামীবার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে।
৩০ বা ৬০ নয়, কম-বেশি ১০০ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। পিস্তলওয়ালা আর সরকারি কর্মকর্তাদের চড়-থাপ্পড় মারা সাংসদদের কোনো প্রয়োজন আওয়ামী লীগের থাকতে পারে না। যুবলীগ আর ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের দৌরাত্ম্য দমন করতে না পারলে বিপদ হতে পারে। সরকার কিছু অপরিণামদর্শী উপদেষ্টা আর অসাধু আমলার খপ্পরে পড়েছে। তাঁদের কাছ থেকে সরকারকে উদ্ধার করা কি খুব কঠিন? কোনো কিছুই কঠিন নয়। শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যার একটু সাহসের প্রয়োজন আছে। তা তাঁর আছে বলে বিশ্বাস। এই সাহস শুধু কাজে লাগাতে হবে। গত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। দলটিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তা যদি তিনি করতে পারেন, তাহলে সামনের নির্বাচনে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নতুন ইতিহাস নির্মাণ করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী দেখবেন নাকি একটু চেষ্টা করে? গোয়েন্দা সংস্থা আপনি যা শুনলে খুশি হবেন তা-ই বলবে। সব সময় সত্য কথা নয়। আওয়ামী লীগের ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের সব ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments