জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-অস্বীকারে ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে না by শরিফুজ্জামান
গত ১৭ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: হাইকোর্টের রায়ের খণ্ডিত বাস্তবায়ন অগ্রহণযোগ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ধন্যবাদ। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেকটাই বাকরুদ্ধ। অপ্রয়োজনীয় জনবল থাকা প্রতিষ্ঠানটি এখন জনবল-সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সময়মতো পরীক্ষা বা ফল প্রকাশ হয় না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজগুলোর লেখাপড়ার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ ছাড়া হয়রানি ও দুর্নীতির পুরোনো অভিযোগ তো আছেই।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদে বলেছে, ১৩২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মর্মে সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত তথ্য সঠিক নয়। ২০০৪ সালে তিনটি পৃথক তারিখে পাঁচটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ বাতিলসংক্রান্ত রায়ে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা উল্লেখ নেই। সিন্ডিকেট এক হাজার পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করেছে মর্মে প্রকাশিত বক্তব্যও সঠিক নয়। তাদের দাবি, সিন্ডিকেট পাঁচটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মধ্যে যাদের ক্ষেত্রে রায় বাস্তবায়নে জটিলতা নেই, তাদের রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি মর্মে প্রকাশিত তথ্য বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করা হয়। বর্তমান উপাচার্য, তাঁর প্রশাসন এবং সিন্ডিকেট দলীয় বিবেচনায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না বলেও প্রতিবাদে দাবি করা হয়।
প্রতিবাদের শেষ অংশে সংবাদ পরিবেশনের আগে তা সঠিকভাবে যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো খবরের সত্যতা যাচাই করার সহজ সুযোগ নেই। বর্তমান উপাচার্য কাজী শহীদুল্লাহ গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন এবং তিনিই সম্ভবত একমাত্র উপাচার্য, যিনি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একবারের জন্য গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও তিনিই এর ব্যতিক্রম। সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যসহ বর্তমান প্রশাসন দলীয় বিবেচনায় কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না, এ কথা দাবি করলেও এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত বর্তমান প্রশাসন তৈরি করেছে।
প্রতিবাদে বলা হয়েছে, এক হাজার ১৩২ জনকে চাকরিচ্যুত করার তথ্য ঠিক নয়। তাহলে কতজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এটা এখনো জানাতে চায় না বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ চিঠি দিয়ে তাঁদের ইতিমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। প্রতিবাদে আরও বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ে চাকরিচ্যুতদের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, পাঁচটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেলায় রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। হাইকোর্ট সংখ্যার কথা না জানলেও বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাটি জানে এবং এটা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাটি প্রকাশ করতে পারত। পাঠকের জন্য পাঁচটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুতির তথ্যের চেয়ে কতজন চাকরিচ্যুত হলেন, তাঁরা কোন পদের, কোন সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত—এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবেদনে সেই সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের তথ্য গোপন করার মানসিকতা থাকায় উল্লিখিত তথ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা জানানো হলে তা প্রথম আলো প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে না।
১২৭ জনের বিষয়টি সলিসিটরের কাছে পাঠানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। আইনজ্ঞরা বলছেন, একই যাত্রায় দুই ফল হতে পারে না। হাইকোর্টের রায়টি বেশ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত একটি অংশকে (যাঁদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া, নতুন নিয়োগ পাওয়া বা পদোন্নতি পাওয়া) আইনি মারপ্যাঁচে রক্ষার চেষ্টা লক্ষণীয়।
যাই হোক, আদালতের রায়ের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এত দিন অপ্রয়োজনীয় জনবলের কাজ ছিল না, এখন কাজ করার লোকই নেই। শিক্ষার্থীরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে রাস্তায় নেমেছেন। জনবলকাঠামো তৈরিসহ যেসব নির্দেশনা আদালত দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, যাঁদের চাকরি গেছে, তাঁদের অধিকাংশই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। আদালত সঠিক রায় দিলেও এসব কর্মচারী যাঁরা ঢাকায় বসবাস করেন, যাঁদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে, তাঁদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু একটা করণীয় ছিল কি না বা এখনো আছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে।
প্রায় ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী নিয়ে পরিচালিত এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত ভেঙে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজগুলো অবমুক্ত করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ভারতের জওহরলাল নেহরু বা অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এই ইচ্ছার কথা জানান। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে ভেঙে না দেওয়া হয়, সে জন্য বিভিন্ন মহলের মতামত তুলে ধরে প্রথম আলো।
দেড় যুগ আগে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর আগে কলেজগুলো ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তখন সারা দেশে কলেজের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭০০। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব অধিভুক্ত কলেজের দিকে যথাযথ নজর দিতে পারত না। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। এখন অবস্থা ১৯৯২ সালের আগের তুলনায় বেশি খারাপ হয়েছে—এটা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন।
২০ অক্টোবর ১৯৯২ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭ নম্বর আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘কলেজশিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি আধুনিকীকরণ ও শিক্ষার উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ কলেজের যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করা সমীচীন...।’
আইনের ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় নিজ বিবেচনায় আঞ্চলিক কেন্দ্র বা ক্যাম্পাস স্থাপন করতে পারবে।
আইনে বলা থাকলেও দেড় যুগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ সম্পন্ন হয়নি। এ কাজ শুরু হলেও শেষ হচ্ছে না। কয়েকটি আঞ্চলিক কেন্দ্র চালানোর জন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এখন এসব কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য লোক নাকি পাওয়া যাচ্ছে না!
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৭৮ জন শিক্ষক, যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে কাজ না করা বা কাজ না থাকার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে দলাদলি ও কাদা ছোড়াছুড়ির অভিযোগ। উপাচার্যসহ সবাই তাঁদের তোয়াজ করে চলেন।
বর্তমান উপাচার্য গত সাড়ে তিন বছরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি বা পরিচালনায় কতটুকু সফল হয়েছেন, তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন গণমাধ্যম প্রত্যাশা করে। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি যাঁর আন্তরিকতা বা আকর্ষণ নেই, যিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে চান না বলে জনশ্রুতি রয়েছে, সেটি যাচাই করে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা কিসের?
দেশে উচ্চশিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ পূরণ হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। বহুমুখী সমালোচনা ও লেখাপড়ার মান নেমে যাওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া সনদ গুরুত্ব হারাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বাইরে অবৈধ শাখা খুলে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় কম খরচে এবং নামকাওয়াস্তে লেখাপড়ার মাধ্যমে সনদ দিচ্ছে।
দেশে কলেজের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর নেতৃত্বে থাকা সরকারের আস্থাবান শিক্ষকেরা। সময়মতো বই দেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু সাফল্য রয়েছে, কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যর্থ। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যদি এককথায় জানতে চাওয়া হয়, কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যর্থ। এর একমাত্র জবাব হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
শরিফুজ্জামান: প্রধান প্রতিবেদক, প্রথম আলো।
pintu.dhaka@gmail.com
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদে বলেছে, ১৩২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মর্মে সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত তথ্য সঠিক নয়। ২০০৪ সালে তিনটি পৃথক তারিখে পাঁচটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ বাতিলসংক্রান্ত রায়ে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা উল্লেখ নেই। সিন্ডিকেট এক হাজার পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করেছে মর্মে প্রকাশিত বক্তব্যও সঠিক নয়। তাদের দাবি, সিন্ডিকেট পাঁচটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মধ্যে যাদের ক্ষেত্রে রায় বাস্তবায়নে জটিলতা নেই, তাদের রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি মর্মে প্রকাশিত তথ্য বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করা হয়। বর্তমান উপাচার্য, তাঁর প্রশাসন এবং সিন্ডিকেট দলীয় বিবেচনায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না বলেও প্রতিবাদে দাবি করা হয়।
প্রতিবাদের শেষ অংশে সংবাদ পরিবেশনের আগে তা সঠিকভাবে যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো খবরের সত্যতা যাচাই করার সহজ সুযোগ নেই। বর্তমান উপাচার্য কাজী শহীদুল্লাহ গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন এবং তিনিই সম্ভবত একমাত্র উপাচার্য, যিনি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একবারের জন্য গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও তিনিই এর ব্যতিক্রম। সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যসহ বর্তমান প্রশাসন দলীয় বিবেচনায় কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না, এ কথা দাবি করলেও এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত বর্তমান প্রশাসন তৈরি করেছে।
প্রতিবাদে বলা হয়েছে, এক হাজার ১৩২ জনকে চাকরিচ্যুত করার তথ্য ঠিক নয়। তাহলে কতজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এটা এখনো জানাতে চায় না বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ চিঠি দিয়ে তাঁদের ইতিমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। প্রতিবাদে আরও বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ে চাকরিচ্যুতদের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, পাঁচটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেলায় রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। হাইকোর্ট সংখ্যার কথা না জানলেও বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাটি জানে এবং এটা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাটি প্রকাশ করতে পারত। পাঠকের জন্য পাঁচটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুতির তথ্যের চেয়ে কতজন চাকরিচ্যুত হলেন, তাঁরা কোন পদের, কোন সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত—এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবেদনে সেই সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের তথ্য গোপন করার মানসিকতা থাকায় উল্লিখিত তথ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা জানানো হলে তা প্রথম আলো প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে না।
১২৭ জনের বিষয়টি সলিসিটরের কাছে পাঠানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। আইনজ্ঞরা বলছেন, একই যাত্রায় দুই ফল হতে পারে না। হাইকোর্টের রায়টি বেশ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত একটি অংশকে (যাঁদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া, নতুন নিয়োগ পাওয়া বা পদোন্নতি পাওয়া) আইনি মারপ্যাঁচে রক্ষার চেষ্টা লক্ষণীয়।
যাই হোক, আদালতের রায়ের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এত দিন অপ্রয়োজনীয় জনবলের কাজ ছিল না, এখন কাজ করার লোকই নেই। শিক্ষার্থীরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে রাস্তায় নেমেছেন। জনবলকাঠামো তৈরিসহ যেসব নির্দেশনা আদালত দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, যাঁদের চাকরি গেছে, তাঁদের অধিকাংশই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। আদালত সঠিক রায় দিলেও এসব কর্মচারী যাঁরা ঢাকায় বসবাস করেন, যাঁদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে, তাঁদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু একটা করণীয় ছিল কি না বা এখনো আছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে।
প্রায় ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী নিয়ে পরিচালিত এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত ভেঙে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজগুলো অবমুক্ত করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ভারতের জওহরলাল নেহরু বা অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এই ইচ্ছার কথা জানান। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে ভেঙে না দেওয়া হয়, সে জন্য বিভিন্ন মহলের মতামত তুলে ধরে প্রথম আলো।
দেড় যুগ আগে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর আগে কলেজগুলো ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তখন সারা দেশে কলেজের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭০০। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব অধিভুক্ত কলেজের দিকে যথাযথ নজর দিতে পারত না। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। এখন অবস্থা ১৯৯২ সালের আগের তুলনায় বেশি খারাপ হয়েছে—এটা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন।
২০ অক্টোবর ১৯৯২ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭ নম্বর আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘কলেজশিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি আধুনিকীকরণ ও শিক্ষার উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ কলেজের যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করা সমীচীন...।’
আইনের ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় নিজ বিবেচনায় আঞ্চলিক কেন্দ্র বা ক্যাম্পাস স্থাপন করতে পারবে।
আইনে বলা থাকলেও দেড় যুগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ সম্পন্ন হয়নি। এ কাজ শুরু হলেও শেষ হচ্ছে না। কয়েকটি আঞ্চলিক কেন্দ্র চালানোর জন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এখন এসব কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য লোক নাকি পাওয়া যাচ্ছে না!
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৭৮ জন শিক্ষক, যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে কাজ না করা বা কাজ না থাকার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে দলাদলি ও কাদা ছোড়াছুড়ির অভিযোগ। উপাচার্যসহ সবাই তাঁদের তোয়াজ করে চলেন।
বর্তমান উপাচার্য গত সাড়ে তিন বছরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি বা পরিচালনায় কতটুকু সফল হয়েছেন, তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন গণমাধ্যম প্রত্যাশা করে। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি যাঁর আন্তরিকতা বা আকর্ষণ নেই, যিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে চান না বলে জনশ্রুতি রয়েছে, সেটি যাচাই করে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা কিসের?
দেশে উচ্চশিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ পূরণ হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। বহুমুখী সমালোচনা ও লেখাপড়ার মান নেমে যাওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া সনদ গুরুত্ব হারাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বাইরে অবৈধ শাখা খুলে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় কম খরচে এবং নামকাওয়াস্তে লেখাপড়ার মাধ্যমে সনদ দিচ্ছে।
দেশে কলেজের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর নেতৃত্বে থাকা সরকারের আস্থাবান শিক্ষকেরা। সময়মতো বই দেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু সাফল্য রয়েছে, কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যর্থ। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যদি এককথায় জানতে চাওয়া হয়, কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যর্থ। এর একমাত্র জবাব হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
শরিফুজ্জামান: প্রধান প্রতিবেদক, প্রথম আলো।
pintu.dhaka@gmail.com
No comments