সিবিএর হাত বিমানে by আশরাফুল হক রাজীব

বিমানে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া সংস্থাটির সিবিএ। তারা বিমানের কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে। অনেক সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করতে সাহস পাচ্ছেন না সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তা।


বিমানের ইতিহাসে এই প্রথম ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সংগঠন সিবিএ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। এ কারণে তাদের দাপট অনেক বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ধারণার সঙ্গে একমত নন সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মন্তাসার রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিমানে সিবিএ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে না। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছি।'
এ বিষয়ে সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম : বিমানের কর্মচারীদের উপস্থিতি সংক্রান্ত অনিয়ম ঠেকানোর জন্য বছরের শুরুতে সংস্থাটির বিভিন্ন দপ্তরের প্রবেশপথে ৩০টি বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) বসানো হয়। অবিহিত ওভারটাইম রোধ করা যাবে এবং বিমানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে- এ উদ্দেশ্যে ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক এসব ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন বসানো হয়। কিন্তু সিবিএর মদদে কিছু অসাধু কর্মচারী বিমান ব্যবস্থাপনার এ সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওভারটাইমের বাড়তি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে- এ আশঙ্কায় তারা এসব মেশিনের ওপর চড়াও হয়। এরই মধ্যে বিমানের গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইক্যুইপমেন্ট (জিএসই) ভবনে স্থাপিত মেশিনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। কার্গো টার্মিনালে বসানো মেশিন অকার্যকর করার জন্য তাতে সুপার গ্লু ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিমানের প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার বলাকায় বসানো মেশিনের ওপর স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়।
রবিবার বলাকা ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনের ওপর সাঁটানো আছে একটি স্টিকার। তাতে লেখা- 'ফিঙ্গার পাঞ্চ আপাতত স্থগিত করা হলো। বিমান শ্রমিক লীগ (সিবিএ)।'
বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকার জানান, বিমানের কিছু স্থাপনায় বসানো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিনের প্রিজম ঘষামাজা করা হয়েছে; কিছু স্থানে মেশিনটিই ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিমান করপোরেশন এমপ্লয়িজ (সার্ভিস) রেগুলেশন ১৯৭৯-এর ৫৫ বিধি অনুযায়ী এটা অসদাচরণ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বিমানের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
জানা গেছে, বিমানে কাজ না করে অনেকে ওভারটাইম নিয়ে থাকে। কাগজপত্রে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) থাকলে সহজেই তাদের চিহ্নিত করা যাবে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম চালু রয়েছে। কিন্তু বিমানের কর্মচারীরা এর বিরোধিতা করছে। গত বছর বিমানকে ওভারটাইম বাবদ প্রায় ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
গত ৩১ মে বিমানের প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার বলাকা পরিদর্শন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব আতাহারুল ইসলাম। ভারপ্রাপ্ত এমডির কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানতে পারেন, সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানের নেতৃত্বে কিছু শ্রমিক-নেতা সংস্থার সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফজলুর রহমানকে নিগৃহীত করেছেন। লাঞ্ছিত এ কর্মকর্তা সচিবকে জানান, মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য তিনি কাজ করছিলেন। চিঠি প্রস্তুত করার কারণে সিবিএ নেতারা তাঁর ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত এমডির পিএস মামুনুর রশিদের উপস্থিতিতে তাঁকে মারধর করতে উদ্যত হন তাঁরা। সচিব বিষয়টি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। নির্দেশনাপত্রে সচিব বলেন, 'অফিস চলাকালে এ ধরনের আচরণ বিধিসম্মত নয়। বরং চরমতম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির একটি নগ্ন পদক্ষেপ। এরূপ অবস্থা অবহিত হওয়ার সময় বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক পরিলক্ষিত হয়েছে, যা বিমানের সামগ্রিক উন্নতি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পথে অন্তরায়।' সচিব সহকারী ব্যবস্থাপককে নিগৃহীত করার ঘটনা তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এ নির্দেশ পাওয়ার পর বিমান থেকে সচিবকে অনুরোধ করা হয় যেন এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে করা হয়। কারণ বিমানের কোনো কর্মকর্তা এ ঘটনার তদন্ত করতে সাহস পাবেন না। যে কর্মকর্তা তদন্ত করবেন তাঁকে আবারও নাজেহাল করা হতে পারে। কিন্তু সচিব বিমান কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তদন্ত করানোর সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটনসচিব আতাহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তদন্ত বিমান কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই করতে হবে। কারণ যাঁর দায়িত্ব তাঁকেই তা পালন করতে হবে। তাঁরা ব্যর্থ হলে মন্ত্রণালয় তদন্ত করবে।
বিমান সূত্র জানায়, ফজলুর রহমানকে নাজেহাল করার ঘটনা নিয়ে সিবিএ নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। তাঁরা কোনো কর্মকর্তাকে নাজেহাল করার পক্ষে নন বলে সিবিএ সভাপতিকে জানিয়েছেন। পাশাপাশি বিষয়টি আওয়ামী শ্রমিক লীগের নেতাদেরও অবগত করা হয়েছে।
এদিকে আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিমান সরকারের কাছে এক হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চাইতে হলে তা পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন করানোই রেওয়াজ। কারণ সরকারের তিনজন সচিব পর্ষদের সদস্য। তাঁরা টাকা দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া সহজ হয়। কিন্তু বিমানের ভারপ্রাপ্ত এমডি ক্যাপ্টেন শেখ নাসির উদ্দিন আহমদ পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপনের আগেই সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছেন। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় তাঁর সেই প্রস্তাব নাকচ করেছে।
এ বিষয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব আতাহারুল ইসলাম বলেন, 'বিমানকে তাদের পরিকল্পনা জানাতে বলেছি। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের কত টাকা দরকার তা জানাতে বলেছি। কারণ অবশিষ্ট টাকা তারা কিভাবে সংগ্রহ করবে সে বিষয়ে প্রস্তাবে কিছুই বলা হয়নি। আর বিমানের পরিকল্পনা কী অর্থাৎ বিমান কী করতে চায়, কিভাবে নানা অনিয়ম দূর করবে- তার পরিকল্পনা থাকতে হবে।'
ভারপ্রাপ্ত এমডি ক্যাপ্টেন শেখ নাসির উদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বোর্ডে উপস্থাপনের আগেই তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরে বোর্ডের বৈঠকে তা জানানো হয়েছে।
কারা পদোন্নতি পাচ্ছেন বিমানে!
বিমানের কিছু পদে অতিরিক্ত লোক রয়েছে। আবার অনেক পদে লোকের সংকট। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে লোকবল সমন্বয় করা দরকার। কিন্তু তা না করে কর্মকর্তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি করা হচ্ছে বা পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি একজন কেবিন ক্রুকে বেতনক্রম ৫ থেকে বেতনক্রম ৭-এ সহকারী ব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) পদে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিকল্পনা শাখায় বেতনক্রম ৬-এর লোক থাকা সত্ত্বেও অন্য পরিদপ্তরের বেতনক্রম ৫ থেকে বেতনক্রম ৭-এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে বিমানে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বেতনক্রম ৫ থেকে বেতনক্রম ৬-এ পদোন্নতি না দিয়ে সরাসরি বেতনক্রম ৭-এ পদোন্নতি দিয়ে সহকারী ব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) করা হয়েছে। তাঁর নাম মনির খান। এর নেপথ্যে ভারপ্রাপ্ত এমডি এবং সিবিএ কাজ করেছে বলে জানা গেছে।
মনির খানকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিমানের অভ্যন্তরে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী যাঁরা বিমানে কর্মরত শুধু তাঁদেরই আবেদন করতে বলা হয়। মনির খানের যেসব যোগ্যতা রয়েছে বিজ্ঞাপনে সেসব যোগ্যতাকেই মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও এ পদের যোগ্য দাবিদার ছিলেন পরিকল্পনা শাখার নজরুল ইসলাম। নিয়ম থাকলেও এ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে রেগুলেশন শাখার মতামত নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি প্ল্যানিং শাখায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে কেবিন ক্রু সাবরিনা শারমিন ছন্দাকে। তাঁকে বেতনক্রম ৪ থেকে বেতনক্রম ৬-এ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এখানেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.