বাংলাদেশ-নেপাল-উজান থেকে নেওয়া by শেখ রোকন

কাঠমান্ডুর নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম এখনও বাংলাদেশের মতো সংগঠিত নয়। সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও আমাদের তুলনায় বালকমাত্র। নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কথাবার্তাও খুব সম্ভবত কম। কিন্তু নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তারা দৃশ্যত আমাদের তুলনায় এগিয়ে আছে


সন্দেহ নেই, পর্বতকন্যা কাঠমান্ডু থেকে ঘণ্টাখানেকের উড়ানে সমতলের সন্তান ঢাকায় নামলে কেবল ভূ-প্রাকৃতিক নয়, আরও বৈসাদৃশ্যই চোখে পড়বে। তবে যে সাদৃশ্যটি সবার আগে কারও কারও চোখে পড়বে, তা বোধহয় নদীসংক্রান্ত। কাঠমান্ডু শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাগমতী ও বিষ্ণুমতীর দশা আমাদের বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার মতোই। নদী দুটির পানির রাসায়নিক মান হয়তো বুড়িগঙ্গার চেয়ে ভালো; ভৌত পরিস্থিতি আমাদের চেয়েও খারাপ। ঢাকা বেষ্টনকারী নদীগুলোর তুলনায় আকারে খালের মতো তিরতির করে কাঠমান্ডুর বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী দুটিতে এখানকার মতোই পলিথিনসহ নাগরিক বর্জ্যের আধিক্য। বাড়তি হচ্ছে গোবরের বিরাট বিরাট স্তূপ আর ভূমিহীন দলিত বস্তির ঝুপড়ি। বাগমতী ও বিষ্ণুমতীর অন্য তাৎপর্যও রয়েছে। এ দুটি নদী হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র। বাগমতীর পানি ছাড়া নেপালি হিন্দুদের সৎকার হয় না। কিন্তু তারপরও নদী দুটির এমন দূষণ কেন_ এ প্রশ্নের উত্তরে যা মেলে, তা যেন ঢাকাই বেদনারই কাঠমান্ডু সংস্করণ।
নেপাল ও বাংলাদেশের জনজীবনের বৈসাদৃশ্যের কথা যদি বলতে হয়, খুব সম্ভবত রাস্তায় নারীদের সাবলীল চলাফেরার বিষয়টি প্রথমে আসবে। কাঠমান্ডুর দোকানে দোকানে নারী বিক্রেতা, রাস্তায় রাস্তায় নারী ট্রাফিক পুলিশ কিংবা নারী নিরাপত্তারক্ষী তো আছেই; সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেলে নারী চালক ও আরোহী। ট্যাক্সিক্যাবের চড়া ভাড়া ও গণপরিবহনের গুঁতাগুঁতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাঠমান্ডুর রাস্তায় দলে দলে নেপালি নারী মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে চলে। একা কিংবা যুগলে। কেউ কেউ হয়তো পেছনের সিটে; বেশিরভাগই চালকের আসনে। অফিসগামী মায়ের পেছনে স্কুল-কলেজগামী কন্যা, দিদির সঙ্গে বোন, হ্যান্ডেলে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে মোটা সিঁদুরপরা গৃহবধূর পেছনে পছন্দের প্রতিবেশী কিংবা কোনো কোনো নারী আরোহী যে বান্ধবীকে নিয়ে নিছক ঘুরতে বের হয়েছেন, তাও স্পষ্ট। তেজদীপ্ত নারী চালকের পেছনের আসনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা পুরুষ যাত্রীও বিরল নয়।
ঢাকার রাস্তায় এমন দৃশ্য, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যেমনটি ডেইলি সানের নিজস্ব প্রতিবেদক আবু বকর সিদ্দিকের চোখে পড়েছিল, একেবারে নেই। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত কিছু এনজিও মাঠকর্মী হয়তো সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালান। মোটরসাইকেলের বাকি নারী আরোহীদের বেশিরভাগই বসে থাকেন পুরুষ সঙ্গীর পেছনে, দুই পা এক পাশে ঝুলিয়ে অত্যন্ত অনিরাপদ ভঙ্গিতে। ঢাকার রাশ আওয়ারে অফিস ও স্কুল-কলেজগামী সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন, বাসের ভিড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে চলাচল করেন, অন্যায্য দাম হাঁকানো রিকশা, অটোরিকশা ও ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে বাদানুবাদ করেন; কিন্তু নিজে স্বাধীনভাবে মোটরসাইকেল চালানোর কথা ভাবতে পারেন না। এ দুর্বলতা নারীর নয়, আমাদের সমাজের। যে দেশের সমাজ এখনও মোটরসাইকেলে নারীর দুই পাশে পা ঝুলিয়ে বসাকে মেনে নিতে পারে না, সেখানে রাস্তায় নারীর সাবলীল ড্রাইভিং কীভাবে সম্ভব? আসলে প্রশ্নটি নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা স্বাধীনতার নয়, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। যে কারণে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী কেবল নয়, তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি প্রত্যন্ত সিন্ধুপলচক জেলার কাপিঙ এলাকার উঁচু পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি অবস্থিত পল্লীর নারীও সমান সাবলীলতায় জীবনযাত্রা চালায়। ঘরে ও বাইরে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, কখনও কখনও পুরুষকে পেছনে ফেলে কাজ করছে তারা। জিডিপিসহ বিভিন্ন সূচকে আমাদের তুলনায় পিছিয়ে থাকা পাশের দেশ নেপাল নারীকে যে সাবলীলতা দিতে পেরেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা পারিনি। লাল নাকি বিজয়ের রঙ। নেপালের অধিকাংশ নারী লাল রঙের কাপড় পরার বিষয়টি সেদিক থেকে দারুণ প্রতীকী।
রাস্তায় মোটরসাইকেলে নারী আরোহীর আধিক্য কিংবা পাহাড়ি পল্লীতে তাদের বহুমাত্রিক তৎপরতা নেপালে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। কাঠমান্ডুর নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম এখনও বাংলাদেশের মতো সংগঠিত নয়। সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও আমাদের তুলনায় বালকমাত্র। নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কথাবার্তাও খুব সম্ভবত কম। কিন্তু নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তারা দৃশ্যত আমাদের তুলনায় এগিয়ে আছে। দ্বিপক্ষীয় এক ভোজসভায় কথা হচ্ছিল সাংবিধানিক সভার সদস্য সাবিত্রী বাসকাটার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, সন্তান যাতে পিতার পাশাপাশি কেবল মায়ের পরিচয়েও পরিচিত হতে পারে, নতুন সংবিধানে তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সবাই একমত হয়েছে। চৌদ্দবার কাটাকুটি করা আমাদের চলি্লশ বছর বয়সী সংবিধানে কি নাগরিকের এমন অধিকার সংরক্ষণ করা কঠিন ছিল?
আসলে প্রশ্নটি দৃষ্টিভঙ্গির। আর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় সম্ভবত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে। কেবল রাজধানীর রাস্তা নয়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি নেটওয়ার্কের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাত দিনের নেপাল ভ্রমণে গিয়ে পদে পদে এ কথাটি মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, সমাজের উদার দৃষ্টিভঙ্গিই নেপালকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও কিছুদিন আগ পর্যন্ত নেপালের রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু ছিল এবং এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক দৈনন্দিন জীবনযাপনে নিষ্ঠাবান হিন্দু; সেখানকার মানুষ ধর্মান্ধ নয়। বস্তুত নেপালের হিন্দুত্ববাদ কতটা উদার তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ হচ্ছে, তারা গৌতম বুদ্ধকেও শ্রীকৃষ্ণের মতো অবতার মনে করেন। নেপালি সংস্কৃতিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ভেদরেখা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। ধর্মীয় আচার ও স্মারককে তারা ছুৎমার্গীয় বিষয় করে ফেলেনি। বরং সেগুলোকে পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত করেছে। মূলত মাউন্ট এভারেস্টের কল্যাণে সারাবিশ্ব থেকে নেপাল ভ্রমণে আসা হাজার হাজার পর্যটকের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি ও স্মারক পরিচিতি পাচ্ছে প্রান্তে প্রান্তে।
এটা ঠিক, সদ্য রাজতন্ত্র বিলুপ্তকারী নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও যথেষ্ট ভঙ্গুর। সংবিধান সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো মিলে অন্তর্বর্তীকালীন একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে বটে, নিজ নিজ দলীয় দর্শন ও এজেন্ডার ব্যাপারে কেউ যে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। ওই জোটের প্রধান দুটি দল মাওবাদী ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মন্ত্রিত্বের প্রশ্নে যে গভীর কোন্দল রয়েছে, নেপালে অবস্থানকালীন সাত দিনের সংবাদপত্রে তা বড় বড় খবর ও কার্টুন আকারে এসেছে। আমাদের মেজবান আনফা (অল নেপাল পিজনস ফেডারেশন) মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এর নেতাদের কাছে শুনেছি রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে বটে রাজনীতিতে রাজতন্ত্রপন্থি সেনাবাহিনী ও জাতীয় বুর্জোয়া গোষ্ঠীর প্রভাব কাটানো যাচ্ছে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, নেপালি সমাজের উদার ও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই স্থায়ী ভরসা হয়ে থাকবে।
আমাদের মতো নেপালে নাগরিক সমাজও বৃহৎ প্রতিবেশীটির ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। আমাদের মতো নেপালের পানিসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে। কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন আমাদের মতোই। কিন্তু নেপালের মানুষের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, তারা হতাশ নয়। এসব কাটিয়ে উঠতে বেগ পাবে না। বাড়তি ঝামেলা হতে পারত নৃগোষ্ঠীগত ব্যাপক বিভাজন। নেপালের উদার, গঠনমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সেটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশে দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক বছরে তা আরও উন্নত হয়েছে। নেপালের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ভালো লেগেছিল যে সেখানে 'নেপাল-বাংলাদেশ' নামে একটি ব্যাংকও রয়েছে। এবারের ভ্রমণে নেপালি নাগরিক সমাজের অনেকেই বলেছেন, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে কীভাবে দু'দেশই লাভবান হতে পারে। নেপাল-বাংলাদেশ যৌথ প্রচেষ্টায় ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেও সুরাহা যে সহজ হতো, তা এখানে বহুল আলোচিত বিষয়। আমার মনে হয়েছে, পানির সঙ্গে সঙ্গে যদি উজানের ওই সমাজের উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসা যেত, সুরাহা হতো আরও অনেক কিছুরই।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.