কথা সামান্যই-আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ by ফজলুল আলম
আকাঙ্ক্ষা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে রবীন্দ্রনাথ জেগে ওঠেন। সিলেটের কোনো এক স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় তাঁর একটি বক্তৃতা পরবর্তী একপর্যায়ে 'আকাঙ্ক্ষা' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। আমার এবং আমাদের অনেকের সৌভাগ্য, ১৯৫৩-১৯৫৪ সালে সেটা সরকারি স্কুলের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে স্থান পায়।
সৌভাগ্য এ জন্য যে, সেটা পড়ে জীবনে প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, বিদ্যা অর্জন স্রেফ একটা চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে করার কথা নয়। বিদ্যা অর্জন জ্ঞানার্জন এবং সেই জ্ঞানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। সেই রচনাটি আমার হাতের কাছে নেই, কিন্তু 'আকাঙ্ক্ষা' শব্দটি শুনলেই আমার মনে রবীন্দ্রনাথের একটি বাক্য প্রতিধ্বনিত হয়- 'আকাঙ্ক্ষাকে বড় করো'।
স্কুলে থাকতে এই 'বড় আকাঙ্ক্ষা' কী হতে পারে, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকার কথা নয়; জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটের কথা মনে এসেছিল কি না, তা বলতে পারছি না। তবে জীবনের একটি সু-মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন, এটা বুঝেছিলাম। বড় হয়ে এমন কাজ করব, যাতে আমার মনুষ্যত্ব সমুন্নত থাকে, আমি যেন ছোট না হয়ে যাই। এর সঙ্গে উচ্চাভিলাষের কোনো যোগাযোগ আমি সেই সময় স্থাপন করিনি- ক্যারিয়ার তৈরির জন্য উঠেপড়ে লাগতে হয়, সেটাও ভাবিনি। আমার আকাঙ্ক্ষা কী, তাও বুঝিনি। সেই সময় আরো একটা কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। সেটা হলো 'র্যাপিড রিডার্স'-এ লেনিনের জীবনী যোগ। সেটার চেয়ে উত্তেজক আর কিছু তার আগে পড়িনি। আমি রাতারাতি আমার নিজস্ব দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলাম। নাম দিলাম 'স্ফুলিঙ্গ'- লেনিনের হাতে হাতে বিলি করা পত্রিকা 'ইসক্রা'র বঙ্গানুবাদ। আমার জীবনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পত্রিকার নামের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, তা এখন আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমার সহপাঠী প্রয়াত আমিনুল ইসলাম সেই সময় আমার সঙ্গে দিন-রাত খেটেছিলেন। সমাজতন্ত্র কী, সেটা নিয়েও পত্রিকায় আলোচনা করার চেষ্টা খুব সফল হয়নি। কারণ আমি জেনে গেলাম, সেটার সঙ্গে কমিউনিজম জড়িত এবং আমাদের জানাশোনা সব কমিউনিস্ট তখন জেলে। ফলে 'স্ফুলিঙ্গে' সবার সমান অধিকারের কথা ভাসা ভাসা থাকলেও কট্টর কিছু থাকত না (জানতামও না)। মনে করতাম, আমিনুল এবং আমার মতো সবাই তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়েই সেই দুটো রচনা (আকাঙ্ক্ষা ও লেনিন) পাঠ করেছিলেন।
চাকরিজীবনে প্রবেশ করার সময় এসে গেল। জানতে পারলাম, ফ্যাসিজম (নাৎসিতত্ত্ব) ও কমিউনিজম- এই দুই ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী হলে অথবা সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্য হলে সরকারি চাকরি মিলবে না। 'সিভিল সার্ভিসেস' পরীক্ষা দিয়ে উচ্চপদে ব্যুরোক্রেসিতে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে- এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেরই ক্যারিয়ার গঠনের ধারণার মধ্যে ছিল। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে আর কোনো উচ্চপদে বা ব্যক্তিগতভাবে শিল্পায়নে বা বড় ব্যবসায় যাওয়ার (বিশেষ করে বাঙালিদের) পথ খোলাও ছিল না। যাঁরা ব্যুরোক্রেসি পরিহার করতেন, তাঁদের জন্য শিক্ষাঙ্গন (কম বেতন হলেও) ছিল অন্য এক সম্মানিত কাজের স্থান। ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রছাত্রীরা ইউনিভার্সিটিতে এবং ভালো কলেজে শিক্ষকতা করতে যেতেন। তাঁদের চেয়ে ব্যুরোক্রেসিতে ঢোকা ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ কম ছিল- এ কথা বলব না, তবে ব্যুরোক্র্যাটদের উচ্চাভিলাষের ধরন ছিল অন্য জগতের; সেটা সম্ভবত বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক প্রশিক্ষণের জন্য হয়। প্রশিক্ষণের শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণ না করলে ব্যুরোক্র্যাটদের কর্মক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে তাঁরা আচার-ব্যবহার, চলন-বলনে কাজের ধারায় প্রায় ভিন্ন গ্রহের জীবে পরিণত হতেন। সম্ভবত, বুর্জোয়া আর ব্যুরোক্র্যাট একার্থক। তবে তাঁদের রাবীন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উচ্চাভিলাষ সম্পূরক ছিল।
এ পর্যন্ত যা লিখেছি, তা প্রায় অর্ধশতক আগের পূর্ববঙ্গের শিক্ষিতজনের কথা- সেসব কি এখনো প্রযোজ্য? বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে?
আমি যদি বলি- হ্যাঁ, এখনো প্রযোজ্য, তাহলে অনেকেই প্রীত হবেন না। না হওয়ারই কথা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগে, বড় ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পায়নে সেই ৫০ বছর আগের দেশ আর নেই। তার ওপর বিশ্বব্যবস্থাও বদলে গেছে। এখন হাজার-লক্ষ নর-নারী বিদেশে যেতে পারছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী বিকাশ ও প্রসারের সুযোগে বাংলাদেশ উন্নত মানের শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে গেছে। আরো কত কী সুযোগই না সৃষ্টি হয়েছে। স্যাটেলাইট বিনোদনের বিস্তারে এ দেশের শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক, বাজনাদার- সবাই এখন অনেক বেশি সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রসার হয়েছে যে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গণনা করলেই বোঝা যায়।
এর পরও আমি বলব, রবিঠাকুরের 'আকাঙ্ক্ষা বড় করো' কথাটি ৫০ বছর আগের মতোই ফাঁপা রয়ে গেছে। এখন আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ অনেক দুরূহ; এবং একই সঙ্গে সহজ। সহজ তাদের কাছে, যারা উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে বাঁকা পথের আশ্রয় নিতে পারে। এখন চাকরি পাওয়া যতই কঠিন হচ্ছে, ততই দুর্নীতির প্রসার হচ্ছে। নীলক্ষেত থেকে ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে বড় চাকরি কেন, ছোট চাকরিও জুটিয়ে নিচ্ছে। এমনও উদাহরণ হাজির করা যায়, একজন ব্যক্তি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেরানি পদে ঘুষ দিয়ে ঢুকে পরবর্তীকালে ডিগ্রি এনে সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। আবার এমনও উদাহরণ আছে, যোগ্য ব্যক্তিকে নিচু পদে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে দিয়েই দপ্তরের কঠিন কাজগুলো করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে 'বকলম' বলে একটা শব্দ চালু আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য। তাঁদের আকাঙ্ক্ষাও বড়, তবে উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করা।
উচ্চাভিলাষ পূরণ করার জন্য মেধা ও প্রতিভার অভাব আমাদের মধ্যে নেই। তার পরও প্রতিভাবানদের একটি বিরাট অংশ অবহেলিত হয়ে আছে। তার কারণ, আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অপব্যবস্থা। এখানে ভালো কাজ করার সৎ সুযোগের অভাব আছে। অথচ আমাদের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঝাঁকে ঝাঁকে উজ্জ্বল যেসব ছেলেমেয়ে কাজ করছে (সাংবাদিকতায়, ওষুধ শিল্পে, আমদানি-রপ্তানিতে, ডেটা প্রসেসিং ও প্রোগ্রামিংয়ে), প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা না পেয়েও পোশাক শিল্পে যেসব তরুণ-তরুণী কাজ করছে, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করার কোনো দিকের দিশা কি আমরা দিতে পেরেছি? পারিনি। তাদের কাছে রবিঠাকুর গিয়ে যদি বলতেন, আকাঙ্ক্ষাকে বড় করো, তাহলে কি তা হাস্যাস্পদ হতো? রবীন্দ্রনাথ সিলেটের সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যা বলেছিলেন, তা আমরা বড়রা ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। কারণ সেসব কথা ছোটদের উদ্দেশে বলা হয়েছিল। অথচ আমার মনে হয়, কথাগুলো আমাদের বড়দের জন্যও বলা হয়েছিল। আমরা যেন দেশের শিশু-কিশোরদের জন্য এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে তাদের আকাঙ্ক্ষা বড় করার সুযোগ থাকত, উচ্চাভিলাষ না-ই বা রইল। আজকের বাংলাদেশে কত কিছুরই না সমালোচনা হচ্ছে- অবক্ষয়, ক্ষুদ্রতা, দুর্নীতি, নীতিভ্রষ্টতা ইত্যাদি; যেন কথার ম্যাজিক দিয়ে এসব দূর করা যাবে। প্রয়োজন কিন্তু সবারই 'বড় আকাঙ্ক্ষা'র, দেশটাকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে- ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণে নয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
স্কুলে থাকতে এই 'বড় আকাঙ্ক্ষা' কী হতে পারে, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকার কথা নয়; জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটের কথা মনে এসেছিল কি না, তা বলতে পারছি না। তবে জীবনের একটি সু-মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন, এটা বুঝেছিলাম। বড় হয়ে এমন কাজ করব, যাতে আমার মনুষ্যত্ব সমুন্নত থাকে, আমি যেন ছোট না হয়ে যাই। এর সঙ্গে উচ্চাভিলাষের কোনো যোগাযোগ আমি সেই সময় স্থাপন করিনি- ক্যারিয়ার তৈরির জন্য উঠেপড়ে লাগতে হয়, সেটাও ভাবিনি। আমার আকাঙ্ক্ষা কী, তাও বুঝিনি। সেই সময় আরো একটা কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। সেটা হলো 'র্যাপিড রিডার্স'-এ লেনিনের জীবনী যোগ। সেটার চেয়ে উত্তেজক আর কিছু তার আগে পড়িনি। আমি রাতারাতি আমার নিজস্ব দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলাম। নাম দিলাম 'স্ফুলিঙ্গ'- লেনিনের হাতে হাতে বিলি করা পত্রিকা 'ইসক্রা'র বঙ্গানুবাদ। আমার জীবনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পত্রিকার নামের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না, তা এখন আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমার সহপাঠী প্রয়াত আমিনুল ইসলাম সেই সময় আমার সঙ্গে দিন-রাত খেটেছিলেন। সমাজতন্ত্র কী, সেটা নিয়েও পত্রিকায় আলোচনা করার চেষ্টা খুব সফল হয়নি। কারণ আমি জেনে গেলাম, সেটার সঙ্গে কমিউনিজম জড়িত এবং আমাদের জানাশোনা সব কমিউনিস্ট তখন জেলে। ফলে 'স্ফুলিঙ্গে' সবার সমান অধিকারের কথা ভাসা ভাসা থাকলেও কট্টর কিছু থাকত না (জানতামও না)। মনে করতাম, আমিনুল এবং আমার মতো সবাই তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়েই সেই দুটো রচনা (আকাঙ্ক্ষা ও লেনিন) পাঠ করেছিলেন।
চাকরিজীবনে প্রবেশ করার সময় এসে গেল। জানতে পারলাম, ফ্যাসিজম (নাৎসিতত্ত্ব) ও কমিউনিজম- এই দুই ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী হলে অথবা সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্য হলে সরকারি চাকরি মিলবে না। 'সিভিল সার্ভিসেস' পরীক্ষা দিয়ে উচ্চপদে ব্যুরোক্রেসিতে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে- এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেরই ক্যারিয়ার গঠনের ধারণার মধ্যে ছিল। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে আর কোনো উচ্চপদে বা ব্যক্তিগতভাবে শিল্পায়নে বা বড় ব্যবসায় যাওয়ার (বিশেষ করে বাঙালিদের) পথ খোলাও ছিল না। যাঁরা ব্যুরোক্রেসি পরিহার করতেন, তাঁদের জন্য শিক্ষাঙ্গন (কম বেতন হলেও) ছিল অন্য এক সম্মানিত কাজের স্থান। ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রছাত্রীরা ইউনিভার্সিটিতে এবং ভালো কলেজে শিক্ষকতা করতে যেতেন। তাঁদের চেয়ে ব্যুরোক্রেসিতে ঢোকা ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ কম ছিল- এ কথা বলব না, তবে ব্যুরোক্র্যাটদের উচ্চাভিলাষের ধরন ছিল অন্য জগতের; সেটা সম্ভবত বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক প্রশিক্ষণের জন্য হয়। প্রশিক্ষণের শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণ না করলে ব্যুরোক্র্যাটদের কর্মক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে তাঁরা আচার-ব্যবহার, চলন-বলনে কাজের ধারায় প্রায় ভিন্ন গ্রহের জীবে পরিণত হতেন। সম্ভবত, বুর্জোয়া আর ব্যুরোক্র্যাট একার্থক। তবে তাঁদের রাবীন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উচ্চাভিলাষ সম্পূরক ছিল।
এ পর্যন্ত যা লিখেছি, তা প্রায় অর্ধশতক আগের পূর্ববঙ্গের শিক্ষিতজনের কথা- সেসব কি এখনো প্রযোজ্য? বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে?
আমি যদি বলি- হ্যাঁ, এখনো প্রযোজ্য, তাহলে অনেকেই প্রীত হবেন না। না হওয়ারই কথা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগে, বড় ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পায়নে সেই ৫০ বছর আগের দেশ আর নেই। তার ওপর বিশ্বব্যবস্থাও বদলে গেছে। এখন হাজার-লক্ষ নর-নারী বিদেশে যেতে পারছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী বিকাশ ও প্রসারের সুযোগে বাংলাদেশ উন্নত মানের শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে গেছে। আরো কত কী সুযোগই না সৃষ্টি হয়েছে। স্যাটেলাইট বিনোদনের বিস্তারে এ দেশের শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক, বাজনাদার- সবাই এখন অনেক বেশি সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রসার হয়েছে যে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গণনা করলেই বোঝা যায়।
এর পরও আমি বলব, রবিঠাকুরের 'আকাঙ্ক্ষা বড় করো' কথাটি ৫০ বছর আগের মতোই ফাঁপা রয়ে গেছে। এখন আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ অনেক দুরূহ; এবং একই সঙ্গে সহজ। সহজ তাদের কাছে, যারা উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে বাঁকা পথের আশ্রয় নিতে পারে। এখন চাকরি পাওয়া যতই কঠিন হচ্ছে, ততই দুর্নীতির প্রসার হচ্ছে। নীলক্ষেত থেকে ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে বড় চাকরি কেন, ছোট চাকরিও জুটিয়ে নিচ্ছে। এমনও উদাহরণ হাজির করা যায়, একজন ব্যক্তি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেরানি পদে ঘুষ দিয়ে ঢুকে পরবর্তীকালে ডিগ্রি এনে সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। আবার এমনও উদাহরণ আছে, যোগ্য ব্যক্তিকে নিচু পদে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে দিয়েই দপ্তরের কঠিন কাজগুলো করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে 'বকলম' বলে একটা শব্দ চালু আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য। তাঁদের আকাঙ্ক্ষাও বড়, তবে উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করা।
উচ্চাভিলাষ পূরণ করার জন্য মেধা ও প্রতিভার অভাব আমাদের মধ্যে নেই। তার পরও প্রতিভাবানদের একটি বিরাট অংশ অবহেলিত হয়ে আছে। তার কারণ, আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অপব্যবস্থা। এখানে ভালো কাজ করার সৎ সুযোগের অভাব আছে। অথচ আমাদের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঝাঁকে ঝাঁকে উজ্জ্বল যেসব ছেলেমেয়ে কাজ করছে (সাংবাদিকতায়, ওষুধ শিল্পে, আমদানি-রপ্তানিতে, ডেটা প্রসেসিং ও প্রোগ্রামিংয়ে), প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা না পেয়েও পোশাক শিল্পে যেসব তরুণ-তরুণী কাজ করছে, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করার কোনো দিকের দিশা কি আমরা দিতে পেরেছি? পারিনি। তাদের কাছে রবিঠাকুর গিয়ে যদি বলতেন, আকাঙ্ক্ষাকে বড় করো, তাহলে কি তা হাস্যাস্পদ হতো? রবীন্দ্রনাথ সিলেটের সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যা বলেছিলেন, তা আমরা বড়রা ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। কারণ সেসব কথা ছোটদের উদ্দেশে বলা হয়েছিল। অথচ আমার মনে হয়, কথাগুলো আমাদের বড়দের জন্যও বলা হয়েছিল। আমরা যেন দেশের শিশু-কিশোরদের জন্য এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে তাদের আকাঙ্ক্ষা বড় করার সুযোগ থাকত, উচ্চাভিলাষ না-ই বা রইল। আজকের বাংলাদেশে কত কিছুরই না সমালোচনা হচ্ছে- অবক্ষয়, ক্ষুদ্রতা, দুর্নীতি, নীতিভ্রষ্টতা ইত্যাদি; যেন কথার ম্যাজিক দিয়ে এসব দূর করা যাবে। প্রয়োজন কিন্তু সবারই 'বড় আকাঙ্ক্ষা'র, দেশটাকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে- ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণে নয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments