দুই দু’গুণে পাঁচ-ঈর্ষার রং ও রূপ by আতাউর রহমান
ঘটনাটা বিলেতের। সহধর্মিণী সমভিব্যাহারে লন্ডনের রাস্তা দিয়ে মোটরগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম; বোধ করি ছুটির দিন ছিল বিধায় রাস্তাঘাট ছিল অনেকটা ফাঁকা। একটি জেব্রা-ক্রসিংয়ে এসে শ্বেতচর্ম এক লোককে রাস্তা পার হতে দেখে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমাদের দেশে কেউ এগুলো মানতে চায় না;
কিন্তু ওই সব দেশে ওসব অমান্য করার প্রশ্নই ওঠে না। ডানে-বাঁয়ে সেই ক্ষণে অন্য কোনো গাড়ি ছিল না, আর লোকটি একটি সাইকেল ধাক্কাতে ধাক্কাতে জেব্রা-ক্রসিং অতিক্রম করছিল। তো সে গাড়ির সামনে এসে একনজর আমাদের দিকে তাকিয়েই ভ্রুকুঞ্চিত করে গাড়ির বনেটে একদলা থুথু ফেলে দিয়ে নির্বিকার চলে গেল।
সঙ্গিনী যখন লোকটির এমন ব্যবহারের কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন আমি তাঁকে বললাম, আরে বুঝলে না, এটা হচ্ছে ঈর্ষাপ্রসূত ঘটনা। সে সাদা চামড়ার লোক হয়ে সাইকেল ধাক্কিয়ে রাস্তা দিয়ে চলছে, আর আমরা বাদামি বর্ণের হলেও ওদের বিবেচনায় আমি কালা আদমি বউকে নিয়ে আরামসে মোটরগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, এটা ওর সহ্য হচ্ছিল না, তাই সে এরূপ করেছে।
বাঙালিদের বহুবিধ গুণাবলির (!) মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে আমরা নাকি খুব ঈর্ষাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতর; কেউ কেউ আবার পরস্ত্রীকাতরও। কিন্তু উপরিউক্ত ঘটনাটি প্রমাণ করে যে ঈর্ষা বা হিংসা হচ্ছে মানুষের প্রকৃতিগত। বোধ করি এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে কেবল সেই লোকটিকেই ঈর্ষা করা যায়, যার মনের মধ্যে কোনো ঈর্ষা নেই। আর ‘ঈর্ষা’ ও ‘হিংসা’ শব্দ দুটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে প্রায় সমার্থক হলেও একটুখানি পার্থক্য আছে বৈকি—ঈর্ষার প্রাবল্যই হিংসার উদ্রেক করে থাকে। এবং বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানীগুণী এ বিষয়টি সম্পর্কে অনেক তথ্যপূর্ণ ও মজাদার উক্তি করেছেন। এ স্থলে আমি কেবল গোটাকয়েক উপস্থাপন করছি।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল বলে গেছেন, ‘ঈর্ষা থেকে আত্মরক্ষা করা উচিত। কিন্তু যে ঈর্ষায় আত্মশুদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, তা কিছুতেই পরিত্যাগ করা উচিত নয়।’ মহাত্মা গান্ধীও বলেছেন, ‘এমনকি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও আমি হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করার ঘোর বিরোধী।’ আর আইরিশ লেখক অসকার ওয়াইল্ড বলেছেন, ‘সাদামাটা মেয়েরা সব সময় তাঁদের স্বামীদের ব্যাপারে ঈর্ষাপরায়ণ। সুন্দরী মেয়েরা কখনো না। ওঁরা সব সময়ই অন্যের স্বামীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া নিয়েই পরিব্যাপ্ত থাকেন।’ প্রসঙ্গত, আমাদের মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে অবস্থান করবে, কেননা আগুন যেমন কাঠকে পুড়ে খেয়ে ফেলে তদ্রূপ ঈর্ষাও সৎকর্মকে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলে।’ আর খ্রিষ্টধর্ম মতেও, ‘এনভি’ (envy) তথা ঈর্ষা হচ্ছে সাতটি ‘ডেডলি সিন’ অর্থাৎ মারাত্মক পাপের অন্যতম।
শেকসিপয়ারের বিখ্যাত বিয়োগান্তক নাটক ওথেলো এই ঈর্ষাবিষয়ক ঘটনার ওপরই আবর্তিত। ওই নাটকে ঈর্ষাকে যথার্থই তিনি ‘গ্রিন-আইড মনস্টার’ তথা ‘সবুজ-চোখের দানব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনিতেও ঈর্ষা বা হিংসার রং হচ্ছে সবুজ আর রূপ বহু বৈচিত্র্যময়। প্রতিবেশীর ক্রয় করা নতুন গাড়ি রাতারাতি আমাদের পুরোনো গাড়ির বয়স বাড়িয়ে দেয়। আমরা পুরোনো প্রজন্মের লোকজন যখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিরূপ সমালোচনা করি, সেটাও অনেকটা ঈর্ষাপ্রসূত। আর স্মার্ট রাজনীতিবিদ যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে তদকর্তৃক জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযুক্ত করেন, তখনো ঈর্ষাটাই থাকে প্রচ্ছন্ন।
সে যাহোক। ঈর্ষা তার লালনকারীর ক্ষতি করে সর্বাগ্রে। এ কারণে বলা হয়ে থাকে যে কেউ ঈর্ষাপরায়ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়া—তিনি যতই গভীরে যাবেন, ততই বেরিয়ে আসা কঠিনতর হবে। ঈশপের নীতিগল্প আছে: এক লোকের একটি গাধা ও একটি নধরকান্তি ছাগল ছিল। তো গাধাটা অনেক কাজ করত বিধায় মালিক তাকে খুব ভালোবাসত। আর এটা দেখে ছাগলের খুব জ্বলন হতো। ছাগল একদিন গাধাকে পরামর্শ দিল এত খাটুনি না করে একবার মূর্ছা যাওয়ার ভান করে পড়ে থাকতে; তাহলে অন্তত এক দিনের জন্য হলেও বিশ্রাম মিলবে। গাধা ছাগলের পরামর্শ মেনে তা-ই করল। মালিক তখন গাধার চিকিৎসার জন্য একজন পশু চিকিৎসককে ডেকে আনলেন। পশু চিকিৎসক এসে গাধাটাকে নেড়েচেড়ে দেখে মালিককে বললেন, ‘ওহ্, আমি বুঝেছি এর কী অসুখ। ছাগলের কলিজা চটকে খাওয়ালেই অসুখটা তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।’ মালিক তখন গাধার চিকিৎসার জন্য নিজের ছাগলটাকেই জবাই করে ফেললেন। ঈশপের অন্যান্য নীতিগল্পের ন্যায় এ গল্পটারও একটা উপদেশ আছে এবং সেটা হচ্ছে ঈর্ষাবশত অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে নিজেকেই বিপাকে পড়তে হয়।
তবে হ্যাঁ, চালাক-চতুর যাঁরা, তাঁরা প্রায়ই ঈর্ষাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় সমর্থ হন। সম্রাট আকবরের দরবারে আবুল ফজল, মোল্লা দোঁপিয়াজা, রাজা মানসিংহ, খান খানান, গঙ্গ, ফৈজি, তানসেন, বীরবল ও টোডরমল—এই ‘নবরত্ন’ সভাসদ ছিলেন। তো সম্রাট একবার মোল্লা দোঁপিয়াজার মারফত পারস্যের শাহের কাছে কিছু মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। বীরবল মোল্লাকে মনে মনে ঈর্ষা করতেন। তাই তিনি মোল্লার অজান্তে বাক্সের মূল্যবান সামগ্রী সরিয়ে তদপরিবর্তে কিছু পাথর ও মাটি রেখে দেন। মোল্লা যথাসময়ে শাহের দরবারে পৌঁছে সবার সামনে বাক্সটি খুলে বেকুব বনে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আর কেউ নয় বীরবলই এ কাজ করেছেন। কিন্তু মোল্লা দমবার পাত্র নন। তিনি জানতেন, পারস্যের শাহ ও সেখানকার অধিকাংশ লোকই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই তিনি বলে উঠলেন, ‘হে শাহানশাহ, আমি বাক্সে যা নিয়ে এসেছি তা অতি পবিত্র বস্তু; এগুলো কারবালার ময়দান থেকে সংগৃহীত, দিল্লির সম্রাট অনেক কষ্টে এগুলো জোগাড় করে আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।’ শাহ তাতে যৎপরোনাস্তি খুশি হয়ে উপস্থিত সবাইকে সেগুলো ভাগ করে দিলেন।
তা ঈর্ষা থেকেই জন্ম নেয় ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা, যে কারণে বলা হয়ে থাকে যে ঘৃণায় পৌঁছার রাস্তা অনেকগুলো হলেও ঈর্ষার রাস্তাটাই সবচেয়ে শর্টকাট। অবশ্য ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘লাভ বিগেটস লাভ অ্যান্ড হেট্রেড বিগেটস হেট্রেড’; বাংলায় যেটার অর্থ দাঁড়ায়, ‘ভালোবাসা ভালোবাসার জন্ম দেয় আর ঘৃণা জন্ম দেয় ঘৃণার’। আর ঘৃণার সম্পর্কে জর্জ বার্নার্ড শ একটি সুন্দর কথা বলেছেন, ‘ঘৃণা হচ্ছে কাপুরুষের পক্ষে অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ।’
ডাক্তার সাহেবরা আমাদের বলেন যে, মানুষকে ঘৃণা করা ক্যানসার, হূদরোগ, মাথাধরা, চর্মরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি রোগের উপদ্রব ঘটাতে পারে। তবে যাদের ঘৃণা হয় তারাও যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তেমনটা কিন্তু নয়। অন্য কথায়, ঘৃণাকে যে পাত্রে ঢালা হয় সেই পাত্রের চাইতে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে পাত্রে ওটা রক্ষিত হয়, সেই পাত্রটি। আর বাইবেলে বলা আছে, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’।
প্রসঙ্গত গল্পটা মনে পড়ে গেল: স্ত্রী গিয়েছেন উকিলের কাছে স্বামীর সঙ্গে স্থায়ী বিচ্ছেদের ব্যাপারে পরামর্শ করতে। তো উকিল সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আপনার স্বামীকে ডিভোর্স করতে চাইছেন কেন?’ প্রতুত্তরে স্ত্রী জানালেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই কোনো মিল নেই। আমরা এমনকি ঘৃণাও একই ব্যক্তিকে করি না।’
যাকগে, শেষ করছি এ-সংক্রান্ত আব্রাহাম লিংকনের শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য উপাখ্যানটি দিয়ে: দাসপ্রথার উচ্ছেদ নিয়ে গৃহযুদ্ধের সময়কালে একবার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের প্রশংসা করছিলেন। সে জায়গায় উপস্থিত একজন মহিলা এতে বিস্ময় প্রকাশ করে তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, শত্রুদের যেখানে নিন্দা ও ধ্বংস করার কথা, সেখানে আপনি কী করে ওদের প্রশংসা করতে পারলেন?’
‘ম্যাডাম,’ লিংকন বিনম্র কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমি যদি ওদের শত্রুর পরিবর্তে বন্ধু বানাতে পারি, তাহলে কি ওদের ধ্বংস করা হলো না?’
আতাউর রহমান: ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক। রম্যলেখক।
সঙ্গিনী যখন লোকটির এমন ব্যবহারের কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন আমি তাঁকে বললাম, আরে বুঝলে না, এটা হচ্ছে ঈর্ষাপ্রসূত ঘটনা। সে সাদা চামড়ার লোক হয়ে সাইকেল ধাক্কিয়ে রাস্তা দিয়ে চলছে, আর আমরা বাদামি বর্ণের হলেও ওদের বিবেচনায় আমি কালা আদমি বউকে নিয়ে আরামসে মোটরগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, এটা ওর সহ্য হচ্ছিল না, তাই সে এরূপ করেছে।
বাঙালিদের বহুবিধ গুণাবলির (!) মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে আমরা নাকি খুব ঈর্ষাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতর; কেউ কেউ আবার পরস্ত্রীকাতরও। কিন্তু উপরিউক্ত ঘটনাটি প্রমাণ করে যে ঈর্ষা বা হিংসা হচ্ছে মানুষের প্রকৃতিগত। বোধ করি এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে কেবল সেই লোকটিকেই ঈর্ষা করা যায়, যার মনের মধ্যে কোনো ঈর্ষা নেই। আর ‘ঈর্ষা’ ও ‘হিংসা’ শব্দ দুটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে প্রায় সমার্থক হলেও একটুখানি পার্থক্য আছে বৈকি—ঈর্ষার প্রাবল্যই হিংসার উদ্রেক করে থাকে। এবং বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানীগুণী এ বিষয়টি সম্পর্কে অনেক তথ্যপূর্ণ ও মজাদার উক্তি করেছেন। এ স্থলে আমি কেবল গোটাকয়েক উপস্থাপন করছি।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল বলে গেছেন, ‘ঈর্ষা থেকে আত্মরক্ষা করা উচিত। কিন্তু যে ঈর্ষায় আত্মশুদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, তা কিছুতেই পরিত্যাগ করা উচিত নয়।’ মহাত্মা গান্ধীও বলেছেন, ‘এমনকি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও আমি হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করার ঘোর বিরোধী।’ আর আইরিশ লেখক অসকার ওয়াইল্ড বলেছেন, ‘সাদামাটা মেয়েরা সব সময় তাঁদের স্বামীদের ব্যাপারে ঈর্ষাপরায়ণ। সুন্দরী মেয়েরা কখনো না। ওঁরা সব সময়ই অন্যের স্বামীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া নিয়েই পরিব্যাপ্ত থাকেন।’ প্রসঙ্গত, আমাদের মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে অবস্থান করবে, কেননা আগুন যেমন কাঠকে পুড়ে খেয়ে ফেলে তদ্রূপ ঈর্ষাও সৎকর্মকে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলে।’ আর খ্রিষ্টধর্ম মতেও, ‘এনভি’ (envy) তথা ঈর্ষা হচ্ছে সাতটি ‘ডেডলি সিন’ অর্থাৎ মারাত্মক পাপের অন্যতম।
শেকসিপয়ারের বিখ্যাত বিয়োগান্তক নাটক ওথেলো এই ঈর্ষাবিষয়ক ঘটনার ওপরই আবর্তিত। ওই নাটকে ঈর্ষাকে যথার্থই তিনি ‘গ্রিন-আইড মনস্টার’ তথা ‘সবুজ-চোখের দানব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনিতেও ঈর্ষা বা হিংসার রং হচ্ছে সবুজ আর রূপ বহু বৈচিত্র্যময়। প্রতিবেশীর ক্রয় করা নতুন গাড়ি রাতারাতি আমাদের পুরোনো গাড়ির বয়স বাড়িয়ে দেয়। আমরা পুরোনো প্রজন্মের লোকজন যখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিরূপ সমালোচনা করি, সেটাও অনেকটা ঈর্ষাপ্রসূত। আর স্মার্ট রাজনীতিবিদ যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে তদকর্তৃক জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযুক্ত করেন, তখনো ঈর্ষাটাই থাকে প্রচ্ছন্ন।
সে যাহোক। ঈর্ষা তার লালনকারীর ক্ষতি করে সর্বাগ্রে। এ কারণে বলা হয়ে থাকে যে কেউ ঈর্ষাপরায়ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়া—তিনি যতই গভীরে যাবেন, ততই বেরিয়ে আসা কঠিনতর হবে। ঈশপের নীতিগল্প আছে: এক লোকের একটি গাধা ও একটি নধরকান্তি ছাগল ছিল। তো গাধাটা অনেক কাজ করত বিধায় মালিক তাকে খুব ভালোবাসত। আর এটা দেখে ছাগলের খুব জ্বলন হতো। ছাগল একদিন গাধাকে পরামর্শ দিল এত খাটুনি না করে একবার মূর্ছা যাওয়ার ভান করে পড়ে থাকতে; তাহলে অন্তত এক দিনের জন্য হলেও বিশ্রাম মিলবে। গাধা ছাগলের পরামর্শ মেনে তা-ই করল। মালিক তখন গাধার চিকিৎসার জন্য একজন পশু চিকিৎসককে ডেকে আনলেন। পশু চিকিৎসক এসে গাধাটাকে নেড়েচেড়ে দেখে মালিককে বললেন, ‘ওহ্, আমি বুঝেছি এর কী অসুখ। ছাগলের কলিজা চটকে খাওয়ালেই অসুখটা তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।’ মালিক তখন গাধার চিকিৎসার জন্য নিজের ছাগলটাকেই জবাই করে ফেললেন। ঈশপের অন্যান্য নীতিগল্পের ন্যায় এ গল্পটারও একটা উপদেশ আছে এবং সেটা হচ্ছে ঈর্ষাবশত অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে নিজেকেই বিপাকে পড়তে হয়।
তবে হ্যাঁ, চালাক-চতুর যাঁরা, তাঁরা প্রায়ই ঈর্ষাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় সমর্থ হন। সম্রাট আকবরের দরবারে আবুল ফজল, মোল্লা দোঁপিয়াজা, রাজা মানসিংহ, খান খানান, গঙ্গ, ফৈজি, তানসেন, বীরবল ও টোডরমল—এই ‘নবরত্ন’ সভাসদ ছিলেন। তো সম্রাট একবার মোল্লা দোঁপিয়াজার মারফত পারস্যের শাহের কাছে কিছু মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। বীরবল মোল্লাকে মনে মনে ঈর্ষা করতেন। তাই তিনি মোল্লার অজান্তে বাক্সের মূল্যবান সামগ্রী সরিয়ে তদপরিবর্তে কিছু পাথর ও মাটি রেখে দেন। মোল্লা যথাসময়ে শাহের দরবারে পৌঁছে সবার সামনে বাক্সটি খুলে বেকুব বনে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আর কেউ নয় বীরবলই এ কাজ করেছেন। কিন্তু মোল্লা দমবার পাত্র নন। তিনি জানতেন, পারস্যের শাহ ও সেখানকার অধিকাংশ লোকই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই তিনি বলে উঠলেন, ‘হে শাহানশাহ, আমি বাক্সে যা নিয়ে এসেছি তা অতি পবিত্র বস্তু; এগুলো কারবালার ময়দান থেকে সংগৃহীত, দিল্লির সম্রাট অনেক কষ্টে এগুলো জোগাড় করে আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।’ শাহ তাতে যৎপরোনাস্তি খুশি হয়ে উপস্থিত সবাইকে সেগুলো ভাগ করে দিলেন।
তা ঈর্ষা থেকেই জন্ম নেয় ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা, যে কারণে বলা হয়ে থাকে যে ঘৃণায় পৌঁছার রাস্তা অনেকগুলো হলেও ঈর্ষার রাস্তাটাই সবচেয়ে শর্টকাট। অবশ্য ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘লাভ বিগেটস লাভ অ্যান্ড হেট্রেড বিগেটস হেট্রেড’; বাংলায় যেটার অর্থ দাঁড়ায়, ‘ভালোবাসা ভালোবাসার জন্ম দেয় আর ঘৃণা জন্ম দেয় ঘৃণার’। আর ঘৃণার সম্পর্কে জর্জ বার্নার্ড শ একটি সুন্দর কথা বলেছেন, ‘ঘৃণা হচ্ছে কাপুরুষের পক্ষে অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ।’
ডাক্তার সাহেবরা আমাদের বলেন যে, মানুষকে ঘৃণা করা ক্যানসার, হূদরোগ, মাথাধরা, চর্মরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি রোগের উপদ্রব ঘটাতে পারে। তবে যাদের ঘৃণা হয় তারাও যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তেমনটা কিন্তু নয়। অন্য কথায়, ঘৃণাকে যে পাত্রে ঢালা হয় সেই পাত্রের চাইতে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে পাত্রে ওটা রক্ষিত হয়, সেই পাত্রটি। আর বাইবেলে বলা আছে, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’।
প্রসঙ্গত গল্পটা মনে পড়ে গেল: স্ত্রী গিয়েছেন উকিলের কাছে স্বামীর সঙ্গে স্থায়ী বিচ্ছেদের ব্যাপারে পরামর্শ করতে। তো উকিল সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আপনার স্বামীকে ডিভোর্স করতে চাইছেন কেন?’ প্রতুত্তরে স্ত্রী জানালেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই কোনো মিল নেই। আমরা এমনকি ঘৃণাও একই ব্যক্তিকে করি না।’
যাকগে, শেষ করছি এ-সংক্রান্ত আব্রাহাম লিংকনের শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য উপাখ্যানটি দিয়ে: দাসপ্রথার উচ্ছেদ নিয়ে গৃহযুদ্ধের সময়কালে একবার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের প্রশংসা করছিলেন। সে জায়গায় উপস্থিত একজন মহিলা এতে বিস্ময় প্রকাশ করে তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, শত্রুদের যেখানে নিন্দা ও ধ্বংস করার কথা, সেখানে আপনি কী করে ওদের প্রশংসা করতে পারলেন?’
‘ম্যাডাম,’ লিংকন বিনম্র কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমি যদি ওদের শত্রুর পরিবর্তে বন্ধু বানাতে পারি, তাহলে কি ওদের ধ্বংস করা হলো না?’
আতাউর রহমান: ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক। রম্যলেখক।
No comments