কালান্তরের কড়চা-মেয়েদের বয়স এবং পত্রিকার কাটতি by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আমার আজকের এই লেখাটির জন্য কালের কণ্ঠের পাঠিকাদের (পাঠকদের নয়) কাছে বিশেষভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার এই লেখার শিরোনাম 'মেয়েদের বয়স এবং পত্রিকার কাটতি'। পত্রিকার কাটতি নিয়ে টিপ্পনী কাটা চলে; কিন্তু এ যুগে মেয়েদের বয়স নিয়ে টিপ্পনী কাটা চলে না। এটা আগের যুগে চলত,


যখন মেয়েদের সম্পর্কে রসিকতা করা হতো তার বয়স কমানো নিয়ে। এ যুগে এই রসিকতা করা চলে না। আমিও রসিকতা করিনি। কেবল লেখার সুবিধার জন্য আগের যুগের প্রবাদসিদ্ধ রসিকতাটা ব্যবহার করেছি। সে জন্য শুধু কালের কণ্ঠ নয়, সব পাঠিকার কাছেই ক্ষমা চাই।
আধুনিক যুগে নারীদের বয়স নিয়ে রসিকতা করার দিন বাসি হয়ে গেছে। কিন্তু যেকোনো দেশের পত্রপত্রিকার কাটতি সম্পর্কে রসিকতা করার দিন এখনো বাসি হয়ে যায়নি। মেয়েদের সম্পর্কে অভিযোগ ছিল, তারা বয়স কমিয়ে বলে। আর পত্রিকা সম্পর্কে অভিযোগ ছিল এবং এখনো আছে যে তারা কাটতি বা প্রচারসংখ্যা বাড়িয়ে বলে। গল্প আছে, কলকাতার একটি দৈনিকের মালিক একসময় দাবি করেছিলেন, তাঁর পত্রিকার কাটতি কয়েক লাখ। প্রতিপক্ষ ওই মালিককে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, 'আপনার পত্রিকার কাটতির ঘাটতি পূরণের জন্য সংখ্যাটার সামনে কয়টা শূন্য যোগ করলেন দাদা?'
আজ ঢাকার কাগজের কাটতি নিয়ে লিখতে বসেছি একটু বাধ্য হয়ে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কলাম লিখছি। সুতরাং ছোট হোক আর বড় হোক, আমার একটি পাঠকগোষ্ঠী থাকবে, তা স্বাভাবিক। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কয়েক বছর ধরেই আমার কাছে একটি বার্তা পাঠান। কখনো ফ্যাক্সে করে, কখনো টেলিফোনে, কখনো ডাকযোগে। তাঁদের একটাই অভিযোগ, আমি কেন একটি বহুল কাটতির বাংলা দৈনিকে লিখি না। এই কাগজটির জন্ম থেকে আমি কয়েক বছর ধরে নিয়মিত তাতে কলাম লিখেছি। এখন লিখছি না কেন? না লিখে বহু পাঠক হারাচ্ছি বলে তাঁদের অভিযোগ। তাঁদের এই অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্যই আজকের এই লেখা।
আমি এত দিন তাঁদের অভিযোগে কান দিইনি। কিন্তু ইদানীং এমন দু-একজন প্রবীণ পাঠক আমাকে চিঠি লিখেছেন, যাঁদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁদের মতেও আমি ওই বহুল কাটতির কাগজটিতে লিখলে আরো বহু পাঠক পেতাম। এই কথাটা প্রবীণ কলামিস্ট বন্ধু এবিএম মূসাও বহুবার আমাকে বলেছেন। মূসা আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি যে আজকাল মাত্র একটি কাগজেই লেখেন তার কারণ, কাগজটির বহুল কাটতি। বেশি পাঠক তাঁর লেখা পড়বে বলেই তিনি ওই কাগজে লেখেন।
আমি এ কথার জবাবে বন্ধুবরকে একটি গল্প বলেছি। বর্তমানে কলকাতায় সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা। আজকাল নাকি প্রচারসংখ্যা আট লাখের ওপর। আজ থেকে ৬০ বছর আগেই পত্রিকাটির মাস্তুলে লেখা থাকত, 'দৈনিক নীট বিক্রয় সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার।' তখন একসময় এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁর ছিল অগি্নবর্ষী লেখনী। কিন্তু নীতিগত মতান্তরের দরুন তিনি আনন্দবাজারের মতো পত্রিকার সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়ে একটি ছোট দৈনিকের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর অগুনতি ভক্ত-পাঠক তাতে মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁরা সত্যেন মজুমদারকে পত্রাঘাতে জর্জরিত করে তোলেন, কেন আপনি বিশাল কাটতির কাগজটি ছাড়লেন। জবাবে সত্যেন মজুমদার তাঁর এক লেখায় একটি ছোট্ট মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর অনেক লেখায় শ্লীলতার বালাই থাকত না। তাঁর এই লেখাটিতেও তিনি লিখেছিলেন, 'প্রমোদবালাদের খদ্দের বেশি, কিন্তু গৃহবধূদের রয়েছে বেশি সম্মান। আমি গৃহবধূদের সেই সম্মানকেই মাথায় তুলে নিয়েছি।'
'আনন্দবাজার' একসময় পশ্চিমবঙ্গের জনমত নিয়ন্ত্রণ করত। এখন করতে পারে না। কারণ তার চরিত্রভ্রষ্টতা পাঠকদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। পত্রিকাটির রঙচঙ, বিষয়বৈচিত্র্য ও বেশি পাতার জন্য তার প্রচারসংখ্যা এখনো সর্বোচ্চ, কিন্তু জনমত প্রভাবিত করার ক্ষমতা আর নেই। এটা প্রমাণিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য নির্বাচনে। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জি বামফ্রন্টের মতো মহাবাহু এবং ৩১ বছরের ক্ষমতাসীন দল-সমষ্টিকে যে পরাজিত করলেন, তার পেছনে রাজ্যের বনেদি কাগজগুলোর সমর্থন ছিল খুব কমই। নতুন বাংলা কাগজ দৈনিক স্টেটসম্যান তখন সবে বেরিয়েছে। প্রচারসংখ্যা লাখের কোঠায়ও পৌঁছেনি। কিন্তু মমতার পক্ষে জনমত প্রভাবিত করেছে এ দৈনিকটি বেশি। তাই অনেকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে এবার ক্ষমতার পালাবদলে দৈনিক স্টেটসম্যানের একটি বড় ভূমিকা ছিল।
কাটতি দিয়ে কোনো পত্রিকার প্রভাব ও জনপ্রিয়তা সব সময় যাচাই করা যায় না। টাটকা জিলাপির খদ্দের বেশি। ঠাণ্ডা হলেই বিক্রিবাট্টা থাকে না। কিন্তু রসগোল্লা গরম অথবা ঠাণ্ডা- দুই অবস্থায়ই জনপ্রিয়। পাকিস্তান আমলে ঢাকার মর্নিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভারের মধ্যে সার্কুলেশন-ওয়ার ছিল। অবজারভারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য মর্নিং নিউজ 'গেট এ ওয়ার্ড' নামে একটি খেলার (আসলে জুয়া) প্রবর্তন করেছিল। এ খেলায় অংশ নিয়ে অর্থোপার্জনের জন্য একজন ক্রেতা একসঙ্গে বহু কপি মর্নিং নিউজ কিনত। তাতে জনপ্রিয়তায় সে অবজারভারকে হারাতে পারেনি। ইংরেজি কাগজ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জনমত প্রভাবিত করেছে অবজারভার, মর্নিং নিউজ নয়।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় আজাদ এবং মর্নিং নিউজই বাজারের সর্বেসর্বা কাগজ এবং মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থক। তখন টেলিভিশন নেই এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে। নুরুল আমিন সরকার অবজারভারের কণ্ঠরোধ করে রেখেছিল এবং ইত্তেফাক তখন সাপ্তাহিক কাগজ থেকে চার পৃষ্ঠার ছোট দৈনিক হিসেবে মাত্র বেরিয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, যুক্তফ্রন্ট তো হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও প্রচার ও মিডিয়া সাপোর্টের অভাব এবং আজাদ ও মর্নিং নিউজের মতো দুটি ইংরেজি-বাংলা দৈনিকের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আশানুরূপ সুবিধা করতে পারবে না।
তাদের এই আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। ১৯৫৪ সালে জনমত প্রভাবিত করেছে চার পৃষ্ঠার ছোট এবং নতুন দৈনিক (তখনো প্রচারসংখ্যায় আজাদকে ছুঁতে পারেনি) ইত্তেফাক। নির্বাচনে বিরাট বিজয়ের অধিকারী হয়েছে যুক্তফ্রন্ট। হক-ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দী- এই তিন নেতাই নির্বাচনের পর মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন সাফল্যের পেছনে ইত্তেফাকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আবারও মেয়েদের কথায় আসছি। এ জন্য পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চাই। বাংলাদেশের প্রবাদ-প্রবচনে তাঁরা এতটা ছড়িয়ে আছেন যে তাঁদের বাদ দিয়ে কথা বলা মুশকিল। এই বাংলাদেশেরই একটি প্রবাদ- মেয়েদের রূপ আর পত্রিকার কাটতি বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। পত্রিকার কাটতির বেলায় এ কথাটির সত্যতা বহুবার জেনেছি। সাম্প্রতিক উদাহরণ, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের আরেকটি বাংলা দৈনিক (ইত্তেফাকের কথা বলছি না। ইত্তেফাক এখন রামকৃষ্ণ মিশন রোড থেকে সরে গেছে)।
হঠাৎ একদিন ঢাকার মানুষ দেখেছে, রামকৃষ্ণ মিশন রোডে একটি লাল দালান গজিয়ে উঠেছে এবং উচ্চতায় ইত্তেফাক ভবনকেও ছাড়াতে চলেছে। সম্ভবত এরশাদ আমলে এই লাল দালান থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকের রবরবা সবার চোখ টাটিয়ে দিয়েছিল। কিছুকাল মনে হয়েছিল, ঢাকার আর সব দৈনিকের কাটতি এই একটি কাগজ একাই গ্রাস করবে। তারপর রহস্য ফাঁস হতে দেরি হয়নি। অভিযোগ উঠল, এই পত্রিকার এককালের রাজাকার মালিক এরশাদ সরকারের কৃপায় এবং মাদ্রাসা পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি পদে থাকার সুযোগে মাদ্রাসা ফান্ডের টাকা হাতিয়ে এবং মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র ও শিক্ষককে এই পত্রিকায় গ্রাহক হতে বাধ্য করে এই বিশাল দাপটের সৃষ্টি করেছেন। এই দাপটের পেছনে লিবিয়ার গাদ্দাফির অর্থ-সাহায্য এবং জামায়াতের সাহায্য-সহযোগিতাও যুক্ত হয়েছিল বলে বাজারে গুজব রটেছিল।
এই দাপুটে কাগজটি এখনো টিকে আছে। কিন্তু আগের সেই দাপট নেই। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন, লাল দালানে এখন লাল বাতি জ্বলেছে। আগেও পত্রিকাটির মৌলবাদী ভূমিকার জন্য জনমত প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা ছিল না; কিন্তু বিশাল কাটতি ছিল। বোঝা যায়, তা ছিল কৃত্রিম কাটতি। সেই কাটতিও এখন নেই। জোয়ারের ফেনার মতো তা এখন অবসিত।
তারপর বাংলাদেশে আরেকটি দাপুটে কাগজের আবির্ভাব হয়েছে, যে কাগজটিতে আমি লিখতাম, এখন লিখি না বলে কোনো কোনো পাঠক বন্ধু অভিযোগ তুলেছেন। বন্ধুবর মূসা যে কাগজে লেখেন, বড় ধরনের পাঠকসংখ্যা পাবেন বলে, আমি তাঁকে বলেছি, বড় কাটতির কাগজে লিখলেই বেশি পাঠক পাওয়া যায় এই ধারণাটি ভুল। যে লেখক পাঠকপ্রিয় নন, যাঁর লেখা পাঠকরা পছন্দ করেন না, তিনি যত বড় কাটতির কাগজেই লিখুন না কেন, তাঁর লেখা কেউ পড়ে না। কিন্তু যাঁদের লেখা পাঠক পছন্দ করে, তাঁরা যেকোনো কাগজেই লিখুন, পাঠক সেই কাগজ খুঁজে নিয়ে তাঁর লেখা পড়েন। একজন লেখক তখনই নিজেকে জনপ্রিয় অথবা পাঠকপ্রিয় ভাবতে পারেন, যখন তাঁর লেখা যেকোনো কাগজেই বের হোক, পাঠক খুঁজে নিয়ে পড়ে। কোনো লেখক যদি বেশি পাঠকের চোখে পড়ার জন্য বেশি কাটতির কাগজে লেখেন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁর আত্মবিশ্বাস নেই, পাঠকপ্রিয়তাও নেই।
যে কাগজটিতে আমি লিখতাম, এখন লিখি না বলে কোনো কোনো বন্ধু অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলি, এই পত্রিকাটির একটি প্রগতিশীলতা ও নিরপেক্ষতার মুখোশ আছে। এ মুখোশের আড়ালে যে আসল চেহারা, তা আমি দেখেছি। তা না হলে মতানৈক্য সত্ত্বেও কাগজটিতে লিখতাম। কাগজটিতে আমি না লেখায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। আবার আমিও পাঠক হারাইনি। বরং একটির বদলে একাধিক কাগজে লিখে আমি আরো বেশি পাঠক পেয়েছি। অন্যদিকে নিজের চরিত্রও রক্ষা করতে পেরেছি।
আর এই কাগজটি যে প্রচারসংখ্যা দাবি করে, তা যে সঠিক তার প্রমাণ কী? বাংলাদেশে ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো পত্রিকার কাটতি নির্ণয়ের জন্য সরকারি অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশন (এবিসি) কি আছে? এক শ্রেণীর পত্রিকা যে সার্কুলেশন দাবি করে, তথ্যমন্ত্রী তা যাচাই-বাছাই না করেই সংসদে দায়িত্বহীনভাবে বলে দেন। সংসদে কিছুকাল আগে দেওয়া তথ্যমন্ত্রীর এ ধরনের একটি পরিসংখ্যান দেখে আমি হেসেছি। যে কাগজগুলো বাজারে একেবারেই চলে না বলে সবাই জানে, সেগুলোরও সার্কুলেশন এক লাখের ঘরে দেখানো হয়েছে। সরকারি বিজ্ঞাপন এই অসত্য ও বানানো হিসাবের ওপর নির্ভর করেই বণ্টন করা হয়।
ধরা যাক, আমাদের আলোচ্য দৈনিক পত্রিকাটির কাটতি তার প্রতিযোগী দৈনিকগুলোর চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু প্রতিযোগী দৈনিকগুলোর কোনো কোনোটি সিরিয়াস ও সচেতন পাঠকের কাছে যতটা আদৃত, পাঠকদের কাছে তার যতটা ক্রেডিবিলিটি, আলোচ্য পত্রিকাটি তা দাবি করতে পারে কি? জনমত প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতাও তার আছে কি?
হ্যাঁ, অবশ্যই এককালে তা তার ছিল। তখনো তার নিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার মুখোশটি উন্মোচিত হয়নি। ফলে অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিলিয়ে সুশীল সমাজের কিছু অংশ এবং মুক্তচিন্তার কিছু বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টকেও বিভ্রান্ত করে দলে টানার সুযোগ পত্রিকাটি পেয়েছিল। ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় জনজীবনে তাই এই প্রভাব খাটিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি দ্বারাই পত্রিকাটি বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আনার জন্য কৌশলী সমর্থন দিয়ে সফল হতে পেরেছিল।
২০০৮ সালে এই কৌশল আর ধোপে টেকেনি। যত দিন সম্ভব পত্রিকাটি আওয়ামী লীগ ও গণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায় আসাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে। কখনো হাসিনা-নেতৃত্বকে অসাধু সমালোচনা করে, কখনো ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূসকে বিকল্প রাজনৈতিক নেতা হিসেবে খাড়া করার চেষ্টা চালিয়ে এক-এগারোর শাসন, মাইনাস টু থিওরিকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থিতিশীল হতে না দেওয়ার কোনো চেষ্টা থেকেই পত্রিকাটি বিরত থাকেনি। দেশের মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছে, পত্রিকাটি দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের ক্রমাগত চরিত্র হনন দ্বারা একটি অনির্বাচিত এনজিও পৃষ্ঠপোষিত সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। পত্রিকাটি নিজেও তাই একাধিক বিশাল এনজিওর সমর্থন এবং একটি এনজিওর সাবেক প্রধানও এ পত্রিকার সর্বাত্মক সমর্থন ভোগ করছেন। তাঁকে ক্ষমতায় আনারও বড় চেষ্টা আছে এ পত্রিকাটির।
পত্রিকাটি এখন বাংলাদেশের পশ্চিমা অর্থ ও সমর্থননির্ভর বড় বড় এনজিওর অঘোষিত মুখপত্র। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা একসময় বাধ্য হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের লাল দালানের কাগজটির ক্রেতা হতে বাধ্য হওয়ায় কাগজটির কাটতি যেমন বেড়ে উঠেছিল এবং সেই ক্রেতারা সরে যেতেই কাটতি একেবারে কমে গেছে, আমাদের আলোচ্য দৈনিকটিও তেমনি দেশের এনজিওগুলোর একচেটিয়া সমর্থন লাভ করায় এবং এনজিওগুলোর অসংখ্য অফিস ও কর্মীবাহিনী কাগজটির ক্রেতা হতে বাধ্য হওয়ায় তার এই দাপুটে প্রচার। আসলে তা কৃত্রিম। এনজিওগুলোর সাপোর্ট কমে গেলে দেখা যাবে, পত্রিকাটির আসল সার্কুলেশন প্রতিযোগী কোনো কোনো দৈনিকের তুলনায় অনেক কম।
কৃত্রিম কাটতি দ্বারা কোনো সংবাদপত্র কখনো জনমত নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে পারে না। ২০০৮ সালে সেটাই হয়েছে। পত্রিকাটির তখন এত জৌলুস, এত শানশওকত, আগেকার রাজা-বাদশাহদের 'ঘাটে বাঁধা হাতীর' মতো পত্রিকাটির বগলে এত অনুগ্রহভোগী বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট; তথাপি দেশের জনমত নিয়ন্ত্রণে সে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারেনি। এই পত্রিকাটির মতো অনেক মিডিয়ার কৌশলী প্রচারণা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ বা গণতান্ত্রিক মহাজোট ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়েছে।
ভবিষ্যতেও কি এই পত্রিকা জনগণ ও পাঠকের কাছে ক্রেডিবিলিটি ফিরে পাবে? আমার মনে হয় না। কৃত্রিম কাটতি বজায় থাকতে পারে; কিন্তু ক্রেডিবিলিটির সে গুড় থেকে বালি সম্ভবত বাছাই করা যাবে না। পশ্চিমে মিডিয়া-মোগল নামে খ্যাত টাইমস-সানডে টাইমস গ্রুপের কাগজগুলোর মালিক রুপার্ট মারডকের সাম্রাজ্যে এখন ভাঙন ধরেছে। যার ইঙ্গিতে ইউরোপে বড় বড় সরকারের পতন হয়েছে, যার নির্দেশ ছিল ইরাক-যুদ্ধের পেছনে, সেই মহাপরাক্রমশালী মারডক এখন সামান্য টেলিফোন হ্যাকিংয়ের স্ক্যান্ডালে জড়িত হয়ে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। তাঁর সর্বাধিক প্রচারিত কাগজ নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু টাইমস বা সানডে টাইমসের কাটতি কমেনি। লোকে ঠাট্টা করে বলে, টাইটানিক ডুবিতেও তো সময় লেগেছিল।
আমি বাংলাদেশের আলোচ্য দৈনিকটির পতন কামনা করি না। এই কাগজটিতে অনেক সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক আছেন। পত্রিকাটির ব্যবসা-সাফল্যও প্রশংসীয়। সুতরাং এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হোক, আমরা তা কেউ চাইতে পারি না। আমাদের আশা, পত্রিকাটির কুমতি দূর হয়ে সুমতি ফিরে আসবে। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজে সে তার শক্তির অপপ্রয়োগ ঘটাবে না। আমাদের মহাগ্রন্থে আছে- 'হে আল্লাহ, তুমি শয়তানের অসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) থেকে আমাদের মুক্ত করো।' আমার একান্ত প্রার্থনা, এই পত্রিকাটি যেন দেশের মানুষকে কুমন্ত্রণা দিতে না পারে।

লন্ডন, ২৫ জুন, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.