মিডিয়ার দায় ও শক্তি by শাহীন হাসনাত

চোখ বুজে একবার ভাবুন তো, আপনার বুকের ছাতির যা মাপ, তার চেয়ে মাত্র কয়েক ইঞ্চি বড় ব্যাসার্ধের একটি গর্ত দিয়ে পা পিছলে হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন গভীরে। ৬০ ফুট বা ৮৪ ফুট গভীর অপরিসর গর্ত। নিকষ কালো অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে মাটি আর পোকামাকড় অধ্যুষিত গর্তে কোনোমতে বসা যায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উপায় নেই।


যে কোনো মুহূর্তে মাটিচাপা পড়তে পারেন আপনি। কোনো বিষাক্ত কীটও কাটতে পারে আপনাকে। সে সময় আপনার মনের অবস্থা কী হবে! আপনি তখন কী করছেন, সজ্ঞানে আছেন নাকি অজ্ঞানে, মৃত না জীবিত, আপনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছেন কি-না, নাকি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন! আপনার ৫০ ঘণ্টা সময় কাটবে কি-না, খিদে-তেষ্টার কথা মনে থাকবে তো?
ঠিক এমনই এক অতল গর্ত, সেখানে যদি ৪-৫ বছরের কোনো শিশু পড়ে যায় তাহলে তার মনের অবস্থা কী হবে_ সেটা বোঝানো খুব কঠিন নয়।
এমনই এক গর্তে পড়েছিল মাহি। দীর্ঘ ৮৬ ঘণ্টার তৎপরতায় মাহি উদ্ধার হলেও সে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে। মাহির জন্য কাঁদছে গোটা ভারতবাসী। হারিয়ানা প্রদেশের মানসের গ্রামের মাহি গত বুধবার রাতে নলকূপের জন্য তৈরি করা গর্তে পড়ে যায়। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও মেট্রো রেলকর্মীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিকল্প গর্ত করে মাহিকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সে মৃত। এ ঘটনায় গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভিড় জমান সেখানে। সারা পৃথিবীর উৎকণ্ঠিত মানুষকে জানাতে থাকেন ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি।
মাহির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৩০ ফুট গভীর কুয়োয় পড়ে মারা গেল হাওড়ার কিশোর রোশন পানেরি। টানা ১১ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। তবে রোশনকে উদ্ধারে প্রশাসনের গাফিলতির কথা শোনা যাচ্ছে।
মনে আছে প্রিন্সের কথা? ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে হরিয়ানা প্রদেশের শাহবাদ গ্রামের প্রিন্স এভাবেই পড়ে গিয়েছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন কূপে। প্রিন্সকে উদ্ধার করতে সেনাবাহিনীর বিশেষ টিম কামান-বন্দুক ছেড়ে কাজ করেছিল শিশু উদ্ধারে। পুরো ভারতজুড়ে মন্দির-মসজিদ-গির্জা ও গুরুদ্বারে তার জন্য প্রার্থনা হয়েছিল। মিডিয়ার কল্যাণে প্রিন্সের সেই উদ্ধার কাহিনী দুনিয়ার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। সৃষ্টিকর্তার অপার অনুগ্রহে টানা ৫৬ ঘণ্টা চেষ্টায় জীবিত প্রিন্সকে মাটির তলা থেকে উদ্ধার করা হয়। এবারও সবার আশা ছিল মাহি ও রোশনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা হয়নি।
প্রিন্স, মাহি ও রোশনের ঘটনায় মিডিয়া যদি সোচ্চার না হতো, তাহলে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে তাদের উদ্ধারে এমন তৎপরতা চালাত না। মিডিয়ায় সমস্ত খবর হয়তো পেঁৗছায় না, তারপরও যেখানে মিডিয়া পেঁৗছেছে এবং তাদের সক্রিয়তায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসায় শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করা হয়েছে। দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম ভুলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেশবাসীকে চিন্তামুক্ত রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টায় রত মিডিয়ার মানবিকতা এখানেই। এ থেকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মানবিকতার শিক্ষা পেয়েছে। দেখেছে মিডিয়ার শক্তি ও দায়বদ্ধতা। মিডিয়া চাইলেই কোনো কিছু এক মুহূর্তে ভাঙতে পারে, আবার গড়তেও পারে।
সংবাদমাধ্যমে একটা কথা চালু আছে, কুকুর কামড়ালে তা সংবাদ নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ হয়ে ওঠে। এই কথার মধ্যে হয়তো কোনো খেদ রয়েছে। কিন্তু সংবাদ নিয়ে যাদের কায়-কারবার তাদের কোনো ঘটনার নিউজ ভ্যালু বের করতে হয় পেশার স্বার্থে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে দেশজোড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও নিউজ মিডিয়ার যে বিস্টেম্ফারণ ঘটেছে, তার জন্য সংবাদ সংগ্রহের পরিধি বেড়েছে, সংবাদ পরিবেশনের ধরন বদলেছে এবং সংবাদের বৈচিত্র্যও বেড়েছে। ওপরের ঘটনাগুলো এর কোনো একটিও নয় শুধুই মানবিকতা।
আমাদের বিশ্বাস, সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মাহি-প্রিন্সদের মতো সকল প্রাণের গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে বিশ্বের সকল মিডিয়া তার ভূমিকা সমান্তরালভাবে পালন করবে।

No comments

Powered by Blogger.