স্মরণ-শওকত ওসমান by মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
এবার যেখানে যাবো/অসম্ভব ফিরে আসা। কাঁকড়ার মত অগ্রে পশ্চাতে/জেনো বিচরণ-শীল/অনুজের প্রতি তার ভালোবাসা। অনুজের প্রতি রেখে যাওয়া ভালোবাসাই শুধু নয় বরং রেখে যাওয়া কর্মের কারণে তিনি যেখানেই যান না কেন, বারবার ফিরে আসেন আমাদের মননে।
১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে তিনি বাবা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া ও মা গুলজান বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু আমরা তাঁর ছদ্মনামের সঙ্গেই বেশি পরিচিত। তিনি আর কেউ নন, আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্যিক শওকত ওসমান। পড়াশোনা করেছেন মক্তব, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও স্নাতক করেন অর্থনীতিতে, পরে তিনি এমএ করেন বাংলায়। ১৯৩৪ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপার অক্ষরে তাঁর কবিতা ছাপা হয়। শুরুটা কবিতার মাধ্যমে হলেও নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রস-রচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ইত্যাদিতে তাঁর অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তাঁর কণ্ঠ ছিল স্পষ্ট ও সোচ্চার। কবি আহসান হাবীব ও লেখক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল। হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন 'অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ'। ১৯৪১ সালে কলকাতা গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে তিনি লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং একই সালে চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে যোগ দেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন ঢাকা কলেজে। পরে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ক্লাসের বাইরেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান। প্রবাসের সেই নির্বাসিত জীবনে তাঁর থাকা-খাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তবু তিনি তাঁর প্রতিবাদের ভাষা জানিয়েছেন নিজের মতো করে। জীবনে কোনো দিন ভোগ-বিলাসের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেননি। জাতীয় স্বার্থে জাতি তাঁকে সর্বদাই লেখক হিসেবে, সেবক হিসেবে পাশে পেয়েছে। এমনকি বয়স যখন আশির কোঠায় তখনো স্বৈরাচারী সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন আমাদের শওকত ওসমান। নিজেকে তিনি ঝাড়ুদার পরিচয় দিতেন এবং অনায়াসে বলতেন, সমাজের আনাচে-কানাচে যত ময়লা আছে, সেসব জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করাই ছিল তাঁর ব্রত। 'জননী', 'ক্রীতদাসের হাসি'র মতো কালজয়ী উপন্যাস দুটি আমরা পেয়েছি এই শওকত ওসমানের কলম থেকে। এ ছাড়া 'সমাগম', 'দুই সৈনিক', 'পতঙ্গ', 'পিঞ্জর', 'ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী', 'মুসলিম মানুষের রূপান্তর'-এর মতো শতাধিক গ্রন্থ তিনি রেখে গেছেন তাঁর কাঁকড়ার মতো অগ্র-পশ্চাতে বিরাজমান ভালোবাসায় বেষ্টিত অনুজদের জন্য। তিনি তাঁর ছাত্রদের 'আপনি' সম্বোধন করতেন এবং কেউ অসুস্থ হলে তাদের বাসায় গিয়ে খবরাদি নিতেন। লেখক হিসেবে তো তিনি বড় ছিলেনই; এর চেয়েও বড় ছিলেন মানুষ হিসেবে। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে এই মহান মানুষটি ঢাকার বারডেম হাসপাতাল থেকে না ফেরার দেশে চলে যান।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
No comments