সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু ৫ জুন-গোলাম আযমের বিচার শুরু
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরুর দুই বছরেরও বেশি সময় পরে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল রোববার তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেছেন।
আগামী ৫ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে।
ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেছেন, সেগুলো হলো: মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। এই পাঁচটি অভিযোগে ৬০টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ষড়যন্ত্রের ছয়টি, পরিকল্পনার তিনটি, উসকানিদানের ২৮টি, সহযোগিতার ২২টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনা। তবে গোলাম আযম নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন মানবতা-বিরোধী অপরাধের চারটি মামলার মধ্যে তৃতীয় মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এই ট্রাইব্যুনাল। ২৮ মে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অপর চারটি মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়েছে।
আদেশের দিন ধার্য থাকায় সকালে গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কারাকক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়ার পর বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক, এ কে এম জহির আহমেদ। আদেশের আগে গোলাম আযমকে আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা ধরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আদেশ পড়ে শোনান।
আদেশ: আদেশের শুরুতে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, ১৯২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আযম প্রথমে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি জামায়াতে যোগ দেন, ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি এবং ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত আমির পদে ছিলেন। স্বাধীনতার আগমুহূর্তে পাকিস্তানে চলে যান এবং পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকেন। লন্ডনে তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সোনার বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, সৌদি রাজা ফয়সালের সঙ্গে দেখা করে বলেন, হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
আদেশের পরবর্তী অংশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২০১০ সালের ১ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সুবিন্যস্ত না থাকায় ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল এটি পুনর্দাখিলের নির্দেশ দেন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ পুনর্দাখিল করলে ৯ জানুয়ারি অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ব নির্দেশ অনুসারে গোলাম আযম ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে হেফাজতে পাঠানো হয়। এর পর থেকে তিনি বিএসএমএমইউর কারাকক্ষে আছেন। সেখানে তিনি সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আছেন, শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে বাড়িতে রান্না করা খাবার সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ ও কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। বিপরীতে গোলাম আযমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী তাজুল ইসলাম, যুক্তি দেন আবদুর রাজ্জাক। অভিযোগ গঠনের আদেশে বিষয়টি উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল এই সময়ের শুনানি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন খারিজ করেন।
এরপর ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ পড়ে শোনান। প্রথমটিতে একাত্তরের ছয়টি ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। দ্বিতীয়টিতে তিনটি ঘটনায় পরিকল্পনা এবং তৃতীয়টিতে ২৮টি ঘটনায় উসকানিদানের অভিযোগ আনা হয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত চতুর্থ অভিযোগে ২২টি ঘটনায় অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। সবশেষে একটি ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এখানে একাত্তরের ২১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে সিরুমিয়া দারোগাসহ ৩৮ জনকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে গোলাম আযমের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের কাছে জানতে চান, তিনি দোষী না নির্দোষ? গোলাম আযম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করেছিল। সেখানে আমার নাম নেই। পরে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। যাদের দালাল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের বিচারের জন্য আইন হয়েছিল। আমাকে কোলাবরেটর হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। আসলদের মাফ করে সহযোগীদের বিচার হয় না, এ জন্য শেখ সাহেব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গটি আসে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় সমান ভোট পেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৮ আসন পায়, যেখানে বিএনপি পেয়েছিল ১৯৭টি। জোটের কারণে আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে হেরেছে। যত দিন চারদলীয় জোট থাকবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পাস করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ এই জোট ভেঙে জামায়াতকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে উৎখাত করতে চায়। এ জন্য ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই বিচার। শেখ মুজিব নিজেও পাকিস্তান ভাঙতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে।...’
এই পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমকে বলেন, ‘আপনি এখন আপনার ডিফেন্সকে উন্মুক্ত করবেন না, আপনার আইনজীবীরা পরে এটা ব্যবহার করবেন। আইন অনুসারে আপনি দোষী না নির্দোষ, সেটা বলবেন। পরে আপনি আরও কথা বলার সুযোগ পাবেন। আমরা আপনাকে বসতে অনুরোধ করছি।’ এ সময় গোলাম আযম চেয়ারে বসে পড়লে ট্রাইব্যুনাল ৫ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: আদেশের পর জেয়াদ-আল-মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল দোষী না নির্দোষ জিজ্ঞাসা করলে গোলাম আযম একাত্তরে যা বলেছেন, বারবার সেই একই কথা বলেছেন। বলেছেন, তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত দালাল। কিন্তু একটি অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেননি। তাঁর কেনো ফতোয়াবাজি শোনার আইনগত অবকাশ ট্রাইব্যুনালের ছিল না।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য সঠিক নয় উল্লেখ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন, গোলাম আযম বলেছেন, এই আইনের অধীনে তাঁকে দণ্ডিত করা যায় না। তাঁর বিরুদ্ধে দালাল আইনে অভিযোগ আনা যেত, কিন্তু তাঁদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বলছি, ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ৬১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করেছেন, তা আইনত সম্পূর্ণ ভুল। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ নয়। তাঁর বিচার সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আর যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার হয়, তখন ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।
ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেছেন, সেগুলো হলো: মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। এই পাঁচটি অভিযোগে ৬০টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ষড়যন্ত্রের ছয়টি, পরিকল্পনার তিনটি, উসকানিদানের ২৮টি, সহযোগিতার ২২টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনা। তবে গোলাম আযম নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন মানবতা-বিরোধী অপরাধের চারটি মামলার মধ্যে তৃতীয় মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এই ট্রাইব্যুনাল। ২৮ মে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অপর চারটি মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়েছে।
আদেশের দিন ধার্য থাকায় সকালে গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কারাকক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়ার পর বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক, এ কে এম জহির আহমেদ। আদেশের আগে গোলাম আযমকে আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা ধরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আদেশ পড়ে শোনান।
আদেশ: আদেশের শুরুতে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, ১৯২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আযম প্রথমে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি জামায়াতে যোগ দেন, ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি এবং ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত আমির পদে ছিলেন। স্বাধীনতার আগমুহূর্তে পাকিস্তানে চলে যান এবং পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকেন। লন্ডনে তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সোনার বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, সৌদি রাজা ফয়সালের সঙ্গে দেখা করে বলেন, হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
আদেশের পরবর্তী অংশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২০১০ সালের ১ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সুবিন্যস্ত না থাকায় ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল এটি পুনর্দাখিলের নির্দেশ দেন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ পুনর্দাখিল করলে ৯ জানুয়ারি অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ব নির্দেশ অনুসারে গোলাম আযম ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে হেফাজতে পাঠানো হয়। এর পর থেকে তিনি বিএসএমএমইউর কারাকক্ষে আছেন। সেখানে তিনি সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আছেন, শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে বাড়িতে রান্না করা খাবার সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ ও কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। বিপরীতে গোলাম আযমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আবেদন করেন তাঁর আইনজীবী তাজুল ইসলাম, যুক্তি দেন আবদুর রাজ্জাক। অভিযোগ গঠনের আদেশে বিষয়টি উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল এই সময়ের শুনানি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন খারিজ করেন।
এরপর ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ পড়ে শোনান। প্রথমটিতে একাত্তরের ছয়টি ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। দ্বিতীয়টিতে তিনটি ঘটনায় পরিকল্পনা এবং তৃতীয়টিতে ২৮টি ঘটনায় উসকানিদানের অভিযোগ আনা হয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত চতুর্থ অভিযোগে ২২টি ঘটনায় অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। সবশেষে একটি ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এখানে একাত্তরের ২১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে সিরুমিয়া দারোগাসহ ৩৮ জনকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে গোলাম আযমের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের কাছে জানতে চান, তিনি দোষী না নির্দোষ? গোলাম আযম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করেছিল। সেখানে আমার নাম নেই। পরে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। যাদের দালাল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের বিচারের জন্য আইন হয়েছিল। আমাকে কোলাবরেটর হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। আসলদের মাফ করে সহযোগীদের বিচার হয় না, এ জন্য শেখ সাহেব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গটি আসে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় সমান ভোট পেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৮ আসন পায়, যেখানে বিএনপি পেয়েছিল ১৯৭টি। জোটের কারণে আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে হেরেছে। যত দিন চারদলীয় জোট থাকবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পাস করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ এই জোট ভেঙে জামায়াতকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে উৎখাত করতে চায়। এ জন্য ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই বিচার। শেখ মুজিব নিজেও পাকিস্তান ভাঙতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে।...’
এই পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমকে বলেন, ‘আপনি এখন আপনার ডিফেন্সকে উন্মুক্ত করবেন না, আপনার আইনজীবীরা পরে এটা ব্যবহার করবেন। আইন অনুসারে আপনি দোষী না নির্দোষ, সেটা বলবেন। পরে আপনি আরও কথা বলার সুযোগ পাবেন। আমরা আপনাকে বসতে অনুরোধ করছি।’ এ সময় গোলাম আযম চেয়ারে বসে পড়লে ট্রাইব্যুনাল ৫ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: আদেশের পর জেয়াদ-আল-মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল দোষী না নির্দোষ জিজ্ঞাসা করলে গোলাম আযম একাত্তরে যা বলেছেন, বারবার সেই একই কথা বলেছেন। বলেছেন, তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত দালাল। কিন্তু একটি অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেননি। তাঁর কেনো ফতোয়াবাজি শোনার আইনগত অবকাশ ট্রাইব্যুনালের ছিল না।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য সঠিক নয় উল্লেখ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন, গোলাম আযম বলেছেন, এই আইনের অধীনে তাঁকে দণ্ডিত করা যায় না। তাঁর বিরুদ্ধে দালাল আইনে অভিযোগ আনা যেত, কিন্তু তাঁদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বলছি, ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ৬১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করেছেন, তা আইনত সম্পূর্ণ ভুল। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ নয়। তাঁর বিচার সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আর যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার হয়, তখন ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।
No comments