বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন পরিকল্পনা জনস্বার্থে হতে হবে by ড. এম শামসুল আলম

বুধবারের পর) সরকারি ও ব্যক্তি যৌথ খাত : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যক্তি এবং সরকারি যৌথ অংশীদারির কথা বলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা টেকসই হওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যাঁরা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) কথা বলেন, তাঁরা কী মনে করেন, দুটো ব্যর্থ খাতকে যোগ করলে তারা যৌথভাবে সফল হবে?


আমরা মনে করি না, এমন ধারণা আদৌ যৌক্তিক। নাইকোর ক্ষেত্রে পিপিপি অনুসরণ করা হয়েছিল। তাতে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, পিপিপি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কোনো ভূমিকাই তারা রাখতে পারেনি। কোনো একটি কাজও ঠিকমতো হয়নি। এ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পিপিপি দিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা আসবে_এমন মনে করার কোনো সুযোগ নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উৎপাদনযন্ত্র এবং বণ্টনব্যবস্থা নিজ মালিকানায় রেখে সরকার জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্য কোনো অজুহাতে এ প্রতিশ্রুতি থেকে সরকারের সরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
সংকট মোকাবিলায় সরকারি খাত : জরুরি ভিত্তিতে সংকট সমাধানের জন্য সরকার ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করেছে। প্রচুর পরিমাণে ক্ষুদ্র এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। তাড়াহুড়োর সুযোগে অদক্ষ সব ব্যক্তি খাত এখানে এসে উৎপাদন শুরু করেছে। এতে প্রত্যাশিত পরিমাণে উৎপাদন বাড়েনি; বরং ব্যয় বেড়েছে। ভাড়াভিত্তিক এবং ক্ষুদ্র বিদ্যুতের যেসব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে পর্যবেক্ষণের (মনিটরিং) কাজটিও সঠিকভাবে হয়নি। তারা পুরনো বাতিল কোনো যন্ত্রপাতি কিনে আনছে কি না, ঠিকমতো তারা উৎপাদনে যেতে পারবে কি না_তার ঠিক নেই। তারা যাতে নতুন যন্ত্রপাতি আনে, তাদের দক্ষতা এবং কার্যকারিতা যেন বেশি হয়, এ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর বিইআরসিতে যে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়, তাতে প্রতীয়মান হয়েছে, এগুলো না করে পিডিবিকে যদি প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া যেত, তাদের দক্ষ জনশক্তিকে যদি কাজে লাগানো যেত, তাহলে তারা তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারত।
সংকট মোকাবিলায় এ পরিকল্পনা : এটা সবারই জানা, বললেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় জ্বালানি জোগানের বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় রাখা দরকার। আমাদের ভাবা উচিত ছিল, গ্যাসের প্রমাণিত মজুদে বেশি দিন চলবে না। কয়লা অবশ্যই তার বিকল্প হবে। তাই কয়লার ব্যাপারে অবশ্যই সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা না থাকায় হাতের কাছে যা রইল, তা দিয়েই কাজ চালাতে লাগল। অর্থাৎ, আমদানিকৃত তেলের ওপর নির্ভর হতে হলো। এটা বড় ভুল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ওঠা-নামাটা সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল একটি বিষয়। তেলের যে দাম মাথায় রেখে বিদ্যুতের দাম হিসাব করা হয়েছে, তেলের সেই দাম এখনই বেড়ে গেছে। আমাদের কথা হচ্ছে, সংকটটা তো আজকের নয়। ৮-৯ বছর ধরে এই সংকট চলছে। তাহলে শুরুতেই কেন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো না? শুরুতেই যদি আমরা সুস্পষ্ট যৌক্তিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতাম, তাহলে জ্বালানি আমাদের কোনো সমস্যা করতে পারত না। এত দিনে কয়লা আমরা কাজে লাগাতে পারতাম। এ বিষয়টি পরিকল্পনায় গুরুত্ব পায়নি।
বিদ্যুৎ ও কয়লানীতি : কয়লানীতির ব্যাপারে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের কথা সবাই জানেন। তাঁরা প্রায়ই বলে থাকেন, কয়লা তুলতে পারছি না বলেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ বক্তব্য আমরা যৌক্তিক মনে করি না। কারণ যদি মনে করা হয়, উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই কয়লা তুলতে হবে, কিন্তু আন্দোলনকারীদের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না; তাহলে দীঘিপাড়া ও খালাসপীর খনির কয়লা কেন তোলা হচ্ছে না? সেখানে উন্মুক্ত খনি হবে না। তাহলে সেখানকার কয়লা তোলার ব্যাপারে আমরা কেন অগ্রসর হচ্ছি না? এখানে তো কোনো আন্দোলন নেই। এর কোনো সদুত্তর নেই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তি খাতে কয়লা তুলতে হলে উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যতীত তা লাভজনক হবে না। লাভজনক না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। অর্থাৎ উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে হলে সরকারি বিনিয়োগেই তুলতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কয়লানীতি দরকার। সরকারি বিনিয়োগে কয়লা তোলা হলে কয়লানীতি লাগে না। বিদেশি বিনিয়োগে উন্মুক্ত খনির বিধান রেখে কয়লানীতি হবে_এমন প্রত্যাশায় সরকার বিনিয়োগে এগিয়ে আসেনি বলেই কয়লা তোলা হয়নি। আমরা মনে করি না, এ ব্যাপারে সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখানে প্রয়োজন অর্থ নয়, সরকারের নীতি ও দর্শনগত অবস্থান। উল্লেখ্য, অর্থের ব্যবহার বা বিনিয়োগ না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ কিনেছে।
বিদ্যুতের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য : আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুতের যে মূল্য, তার সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। কারণ, জ্বালানিসম্পদের মালিকানা জনগণের। জনগণ যদি তাদের নিজ মালিকানায় সেই সম্পদ গ্যাস বা কয়লা উত্তোলন করে, তাহলে তার দাম (উৎপাদন ব্যয় প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস ৫০ টাকা এবং টনপ্রতি কয়লা ৬০ ডলার) অনেক কম হয়। সেই গ্যাস দিয়ে নিজেই নিজের মালিকানায় যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তাহলে সেই বিদ্যুতের দামও (প্রতি একক ১.৪৯ টাকা) কম হয়। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে, মুনাফার উদ্দেশ্যে সরকার নিজ জনগণের ওপর উচ্চমূল্য আরোপ করতে পারে না। এখন কেউ যদি বলে, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় এখানে বিদ্যুতের দাম কম হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে, তাহলে তা সত্য বলা হবে না। কারণ গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা জানি, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি এক হাজার ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ ব্যয় ১০৯ টাকা। আর তা ভোক্তাপর্যায়ে বিক্রি হয় গড়ে ১১১.৩৬ টাকায়। এখানে সরকার লাভ করছে। তাহলে কেন ভর্তুকির প্রশ্ন আসে? আবার গণশুনানিতে দেখা গেছে, সরকারি খাতের আর্থিক সক্ষমতা থাকলে এবং যথাযথভাবে এ খাতে উৎপাদন নিশ্চিত করা হলে অনায়াসে ২.৩৭ টাকা বিক্রি করায় বিদ্যুৎ লাভজনক হতো। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে যে মুনাফা বৃদ্ধি হবে, জনগণ তাতে অর্থ জোগান দেবে_জনগণের সরকার তা কি হতে দিতে পারে? পারে না। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী তা হতে দেননি। সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে বিইআরসি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করেছে এবং এই মর্মে তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছে যে সংকট মোকাবিলায় উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনায় বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় যে আর্থিক ঘাটতি হয়েছে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে নয়, সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা পূরণ করবে। ফলে ভোক্তাপর্যায়ে ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। আবার সেই অর্থ বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনে বিনিয়োগ হবে। এ অর্থ বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় কমে আসবে। উল্লেখ্য, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা জমছে এবং তা অনুদান হিসেবে গ্যাস খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ হচ্ছে। তা ছাড়া এর আগে বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির পর ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি না করা সত্ত্বেও ডেসকো লাভজনক ছিল। সিস্টেম লস কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামালে ডিপিডিসিও লাভজনক হতো। ওভারহেড কস্ট অত্যধিক হওয়ায় 'পশ্চিম অঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানি'-র বিতরণ ব্যয় (প্রতি একক বিদ্যুতে ১.২৬ টাকা) বেশি। তা ছাড়া সিস্টেম ক্যাপাসিটি অপ্রতুল ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বেড়ে যায়। এ কথা আরইবির ক্ষেত্রে বড় বেশি প্রযোজ্য। যদি সিস্টেম লস এবং বিতরণ ব্যয় স্ট্যান্ডার্ডাইজ্ড হতো, তাহলে ভোক্তার কাছ থেকে কী পরিমাণ অর্থ আদায় করা যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত হতো, তা নির্ধারণ করা সহজ হতো। তাই আমরা বারবার বলে আসছি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অঙ্লিারি কনজামশন, হিট-রেট এবং প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর স্ট্যান্ডার্ডাইজ্ড হতে হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে সিস্টেম লস এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় স্ট্যান্ডার্ডাইজ্ড হতে হবে। তার ভিত্তিতেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে। সংস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব এবং সক্ষমতার স্বল্প ব্যবহারের কারণে যদি গ্যাস বা বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ে, তাহলে এর দায় ভোক্তারা নেবে না। এর দায় ভোক্তাদের ওপরে চাপানো ন্যায়সংগতও নয়।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প : আমরা বলে এসেছি, খাদ্যে যখন সংকট দেখা দেয়, দুুর্ভিক্ষ যখন নেমে আসে, তখন জনগণকে বাঁচানোর জন্য ভর্তুকি দিয়ে সরকার খাদ্য সরবরাহ করে। নতুন খাদ্য বাজারে আসায় দুর্ভিক্ষ কেটে যায় এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। বিদ্যুতের এই যে সংকট, একে আমরা বিদ্যুতের দুর্ভিক্ষ বলি। এ অবস্থায় যদি মনে করা হয়, তেল-বিদ্যুৎ দিয়ে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হলে এবং এর মধ্যে বিকল্প জ্বালানি কয়লার সংস্থান হলে বিদ্যুতের দাম আবার কমে আসবে, তাহলে এ পরিস্থিতিতে তিন-চার বছর আপৎকালীন সময়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে সংকট মোকাবিলা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন করতে পারে। তাতে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ভোক্তাপর্যায়ে চাপ সৃষ্টি হবে না। অন্যথায় আপৎকালীন ব্যয় মোকাবিলার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেই অর্থে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়। তাতে এ খাতের সমস্যা সমাধান হবে না। বরং বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকবে। ভোক্তাপর্যায়ে সরকার অপ্রিয় হবে।
কেন ভর্তুকি : অনেকেই বলেন, বিশ্বের কোথাও বিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি দেওয়া হয় না। এর আগে হয়তো সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার এ খাতে বিধিবদ্ধভাবে সরাসরি ভর্তুকি দেয়নি, ঋণ দিয়েছে। পিডিবিকে ঋণগ্রস্ত করেছে। পিডিবি ঋণের দায় মাথায় নিয়ে ব্যক্তি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে বিদ্যুৎ খাত বিধিবদ্ধভাবে প্রতিবছর ভর্তুকি পাবে। আমরা দরিদ্র দেশ। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য জনগণকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। এতে তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে। তারা উৎপাদনে অংশ নেবে। আয় বাড়বে। পরবর্তীকালে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতেও সক্ষম হবে। এতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে। এ খাত থেকে আয়ের সূত্র ধরে উৎপাদনও বাড়বে। অর্থাৎ, পুরো ব্যবস্থাটাই উন্নত হবে। আর যদি এ পরিকল্পনামাফিক বেঁধে দেওয়া পথে সরকারকে হাঁটতে হয়, তাহলে বিদ্যুতের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হবে। মানুষ আরো দরিদ্র হবে। সরকারকে ক্ষতির শিকার হতে হবে। রাষ্ট্র পেছনের দিকে যাবে। আমরা মনে করি, সরকারের কাজ হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। সে জন্য অবশ্যই তাকে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। এ জন্য পুরো উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা সরকার তথা জনগণের মালিকানায় রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে একটা সময় পর্যন্ত ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এখন আমরা যদি আমাদের এই প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশের মডেল অনুসরণ করতে গিয়ে বলি, বিদেশে বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয় না, তাই দাম বাড়াতে হবে, তাহলে এটা হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী এই ঝুঁকি নেননি। যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিইআরসিকে সদয় সহযোগিতা করেছেন। এসব বিষয় এই পরিকল্পনা প্রস্তাবে না থাকায় জনগণ ভুল সংকেত পেতে পারে।
জনগণ ও সরকার : সরকার জনগণের। আমরা যে কথা বলছি, তা-ও জনগণের। এ যাবৎ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কার্যক্রমে আমরা যখন এ কথাগুলো খুঁজে পাইনি, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, সরকার অন্য কারো দ্বারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। কে কিভাবে এটা করছে, তা অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও তদন্তের ব্যাপার। আমরা সেদিকে যাব না। আমরা সেই সময় মনে করেছি, সরকার বিভ্রান্ত হচ্ছে। আমরা যেহেতেু জনগণকে রক্ষা করতে চাই, সেহেতু সরকারকেও রক্ষা করতে চাই। সরকার যদি বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, তাহলে জনস্বার্থ রক্ষা হবে না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন এবং বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রদান_এসব কারণে আজ বলার সময় এসেছে, সরকার সেই বিভ্রান্তি থেকে ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছে। এতে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার যেন সেই বিভ্রান্তি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারে, সে জন্য সরকারের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
সক্ষমতা ও বিনিয়োগ : দীর্ঘদিন ধরে জনগণ শুনে আসছে, সরকারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আবশ্যক। তার জন্য এ খাতের মালিকানা সরকার তথা জনগণের হাত থেকে ব্যক্তির হাতে যেতে হবে। ওপরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকার বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে সক্ষম। এই অর্থ ইকুইটি মানি হলে সরকার নিজ মালিকানায় ঋণের অর্থসহ এই খাত উন্নয়নে বছরে বিনিয়োগ করতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা সরকারের বিনিয়োগ সক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং সরকারের বিনিয়োগ সক্ষমতার অভাবে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ-কৌশল হিসেবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ যৌক্তিক নয়।
মালিকানা : দেশের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ জ্বালানিসম্পদের মালিকানা জনগণের। ১৯৭৫ সালে বিয়োগান্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে পরিবর্তন না হলেও অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। সেই সঙ্গে জ্বালানিসম্পদের মালিকানার প্রশ্নে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শগত অবস্থানে পরিবর্তন আসে। ফলে জনগণের মালিকানা পরিবর্তন করে বিদেশি ঋণ দানকারী সংস্থার পরামর্শে বেসরকারিকরণের নামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ব্যক্তি খাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধান মতে, ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিধিবদ্ধভাবে সরকারি খাতে আনা হয় এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, বণ্টন ও বিপণনব্যবস্থায় জনগণ তথা সরকারের মালিকানা নিশ্চিত হয়।
পরামর্শ : বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানি উত্তোলন, সরবরাহ_এগুলো ব্যক্তি খাতে যাবে, এমন ধারণা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। কয়েকটি মৌলিক নীতিগত ক্ষেত্রে সরকারকে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। প্রথমত, সংসদে বিল হিসেবে উপস্থাপিত 'জ্বালানি রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন' অবিলম্বে পাস হতে হবে। তাতে জ্বালানিসম্পদে জনগণের মালিকানা নিশ্চিত হবে। যেহেতু সরকার '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করছে, সেহেতু জ্বালানিসম্পদে জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য এ আইন অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে জ্বালানি উত্তোলন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সরকার নিজে করবে। প্রয়োজনে ব্যক্তি খাতকে কাজে লাগাবে। কিন্তু তাদের মালিকানার জায়গায় আনা যাবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ-কৌশল গ্রহণে সরকারের এমন অবস্থান যদি সুস্পষ্ট হয় এবং জ্বালানি-কৌশল হিসেবে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার না করে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লা প্রাধান্য পায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকট নিরসন হবে এবং স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। অন্তত ২০২৫ সাল পর্যন্ত যদি এমন বিনিয়োগ-কৌশল ও জ্বালানি-কৌশল গ্রহণ করা যায়, তাহলে এই এক যুগের মধ্যে আমাদের বিদ্যুৎ খাত এমন একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে যে চাইলেও সহজে এ খাতকে কোনো সমস্যায় ফেলা যাবে না। তখন এ খাতে পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি খাতের সম্প্রসারণ হলে তার সুফল জনগণ পাবে। (শেষ)
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.