মৎস্যসম্পদ-উপেক্ষিত গভীর সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ by ফারুক মঈনউদ্দীন
আমরা আদৌ কখনো উপলব্ধি করেছি কি না, আমাদের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হওয়া নতুন মুখগুলোতে শুধু দুই বেলা খাবার জোটানোর জন্য প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদেরকে নিঃশেষে নিংড়ে নিতে হচ্ছে খাদ্য। এ-ছাড়া বাড়তি মানুষের অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্যও আমাদের যেতে হচ্ছে প্রকৃতির কাছে।
কিন্তু প্রকৃতির ভান্ডার অফুরন্ত কি না সে ভাবনা বহু আগে থেকেই শুরু করা উচিত ছিল। উচ্চফলনশীল কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পৃথিবীর গর্ভ থেকে তুলে আনছি জল, তার সঞ্চিতি কি আবহমান কাল ধরে অটুট থাকবে? শুধু জমির উৎপাদিকা শক্তি থেকে নয়, ক্রমবর্ধমান মানুষের পাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমরা নদী-নালা, খাল-বিল এমনকি সমুদ্রের জল ছেঁকে নির্বিচারে তুলে আনছি মাছ, রেণু ও পোনা। শত আইন সত্ত্বেও প্রজনন এবং ডিম ছাড়ার মৌসুমে নির্বিচার মৎস্য শিকার প্রমাণিত করে আমাদের দুর্নিবার লোভ ও দারিদ্র্য। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে কার্যরত দেড় শতাধিক সমুদ্রগামী ট্রলার যখন সমুদ্র মন্থন করে মাছ তুলে আনছে, তখন মাঝপানিতে মাছ ধরার নতুন আরও ৩০টি ট্রলারের লাইসেন্স দেওয়ার খবরে চিন্তাশীল বিবেকবান মানুষের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কিত। বিভিন্ন সূত্রের হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে সমুদ্রগামী ১৭০টি ট্রলার ছাড়াও আছে প্রায় ৪৪ হাজার মাছ ধরা নৌকা, যেগুলো অগভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে। তীরের কাছে বিচরণকারী এসব নৌকা মাছের ডিম এবং পোনা ধ্বংস করে আরও বেশি ক্ষতি করে আমাদের মৎস্য সম্পদের। খুব ক্ষুদ্র মাপে হলেও বিকল্প পেশার অভাবে সমুদ্রতীরে চিংড়ির পোনা সংগ্রহকারীরা সামুদ্রিক চিংড়ি এবং অন্যান্য মাছের বংশ বৃদ্ধিতে যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে সেটা সহজ দৃষ্টিতে উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। তার সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরও ৩০টি সমুদ্রগামী ট্রলার, যেগুলোর লাইসেন্স দেওয়ার আগে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডার কিংবা অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো ধরনের জরিপ কিংবা গবেষণা চালানো হয়নি। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় সর্বশেষ জরিপ চালানো হয়েছিল ২২ বছর আগে, ১৯৯০ সালে।
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করেছিল, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ভান্ডার সম্পর্কে জরিপ চালানোর আগে নতুন আর কোনো ট্রলারের অনুমতি যাতে দেওয়া না হয়। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে এই সুপারিশ উপেক্ষা করে পরবর্তী সরকারও ২০০২ সালে একইভাবে দিয়েছিল ৫০টি লাইসেন্স। অভিযোগ আছে, এগুলোর বেশির ভাগই দেওয়া হয় রাজনৈতিক এবং দলীয় বিবেচনায়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাগানো এসব লাইসেন্সের অনেকগুলোই আবার অবিশ্বাস্য চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হয় প্রকৃত মৎস্য আহরণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। জানা গেছে, এ বছর নাকি একটা জরিপ জাহাজ কেনা হচ্ছে, অথচ এই জাহাজ পৌঁছার আগেই ৩০টি লাইসেন্স দেওয়া হলো। তবে লাইসেন্সগুলো দেওয়ার পর গত বছরের শেষে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ফলে আমাদের সামুদ্রিক মৎস্যভান্ডার অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডার অসীম নয়, এই সম্পদ দীর্ঘদিন ভোগ করা যাবে যদি জরিপের পর নির্দেশনা মেনে মাছ ধরা হয়।
সরকারের কাছে আমাদের সামুদ্রিক মাছের ভান্ডার সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণাসূত্রে এটুকু জানা যায় যে বঙ্গোপসাগরে আছে ৬৫ প্রজাতির বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। মৎস্যভান্ডার সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত না থাকায় কতগুলো ট্রলারকে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া যাবে অথবা প্রতি মৌসুমে কী পরিমাণ মাছ ধরা যাবে সেটি কোনোভাবেই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ফলে সীমাতিরিক্ত ট্রলারের অবাধ বিচরণের কারণে দ্রুত নিঃশেষ হবে সেখানকার মৎস্য সম্পদ। এখানে কর্তৃপক্ষ হয়তো একটা ভালো যুক্তি দেখাতে পারবে যে অতিরিক্ত সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশের মৎস্য সম্পদও প্রায় নিঃশেষিত। জাপানের মৎস্য সম্পদ ২০ বছরের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু এই যুক্তি দেখানোর আগে বিবেচনা করা উচিত—সে সব দেশের আরও অন্যান্য বহু প্রাকৃতিক সম্পদ আছে যা বাংলাদেশের নেই। অবশ্য তারা সে রকম নেতিবাচক যুক্তি প্রদর্শনের দিকে যায়নি। তাদের মতে, বিগত বছরগুলোর উপাত্ত অনুযায়ী মৎস্য আহরণের পরিমাণ হ্রাস না পেয়ে বরং বেড়েছে—এবং এই বিবেচনাতেই তারা নতুন লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই বৃদ্ধির কারণ জাল, ট্রলার এবং নৌকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা। অর্থাৎ আরও বেশি পরিমাণ বহর ও অস্ত্রপাতি নিয়ে মাছ শিকারের কারণেই মোট আহরণ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝপানিতে মাছ ধরার জন্য অনুমতি দেওয়া ট্রলারগুলো একই সঙ্গে ওপরের পানির মাছও ধরে নিতে পারবে, কারণ এসব বিধিনিষেধ কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট নজরদারির কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের গড়পরতা মানুষের নৈতিকতা এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো, তথা নৌযান, জনবল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির অভাবে সেটি কোনো কাজে আসবে না। অগভীর জলের এসব মাছের সঙ্গে ধ্বংস হবে ইলিশের মতো মাছ ও জাটকা। আমরা জানি প্রতি মৌসুমে আমাদের নদীগুলোতে জাটকা নিধনের বিরুদ্ধে প্রচার এবং সরাসরি অভিযান চালিয়েও মৎস্যজীবী ও দাদনদারদের দৌরাত্ম্য ও আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। আমাদের এ রকম দৌরাত্ম্যের কারণে বঙ্গোপসাগরে আমাদের জলসীমা থেকে অভিবাসী হয়ে ভিন সমুদ্রে পাড়ি জমাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ভারতীয় জলসীমায় ইলিশের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়া এই প্রবণতারই লক্ষণ।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আওতায় রয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। আমাদের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ আসে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ থেকে। এই গবেষণা প্রতিবেদনের হিসাবে দেশের প্রায় ১১ লাখ মৎস্যজীবী সরাসরি মৎস্য আহরণ পেশায় জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছে ভূমিহীন জেলে এবং সম্পন্ন মৎস্যজীবীও। এই পেশাজীবীদের প্রায় ৩৭ শতাংশ জড়িত সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের সঙ্গে। এদের বাইরে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী, যার সংখ্যা এক কোটির ওপর, খণ্ডকালীন মৎস্য আহরণ এবং চাষের সঙ্গে জড়িত। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আমাদের জিডিপির ৩.৭৪ শতাংশ আসে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ থেকে, আর আসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪.০৪ শতাংশ। অথচ দেশের বংশানুক্রমিক জেলে সম্প্রদায়ের সদস্যরা সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর। সামাজিক অবস্থান এবং হিন্দু বর্ণপ্রথায়ও তাঁদের অবস্থান সর্বনিম্নে। এ কারণেই ১৯৯৮ সালে প্রণীত জাতীয় মৎস্যনীতিতে বলা হয়েছিল আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মৎস্যজীবীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা। অবশ্য দুই দফায় ৮০টি লাইসেন্স দেওয়ার কাজটি সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রমের পরিচয় বহন করে না।
বাংলাদেশের তিনটি বৃহৎ নদী অববাহিকা মিলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বদ্বীপে সৃষ্টি করেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এক জলাভূমি। আমরা যখন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, এই বিশাল জলাভূমির মৎস্য সম্পদ হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই নিরাপত্তার একটি প্রধান উৎস, কারণ চাষ এবং পরিচর্যা ছাড়াই এই মৎস্য সম্পদ বেড়ে ওঠে প্রাকৃতিক নিয়মে। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে লালন করতে পারলে এখানে রয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণে মানুষের বিকল্প পেশার অমিত সম্ভাবনা। ফাও-এর হিসাবমতে, (২০০৯) অসামুদ্রিক মৎস্য আহরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বের দ্বিতীয়। নদীগুলোতে অপরিকল্পিত মৎস্য শিকার, প্রাকৃতিক দূষণ এবং নাব্যতা হারানোর কারণে বর্তমানে এই অবস্থান অক্ষুণ্ন আছে কি না, কিংবা ভবিষ্যতে থাকবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অভ্যন্তরীণ নদী ও জলায় মৎস্য সম্পদের অবলুপ্তির কারণে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ব্যাপ্তি ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতির এই সম্পদটিও হুমকির মুখোমুখি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং তাদের বিকল্প পেশার অভাবও অনিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিত সমুদ্রসম্পদ আহরণে মানুষকে প্ররোচিত করছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের লাইসেন্স দেওয়ায় সরকারের যখন এতই আগ্রহ, যথাযথ জরিপ সম্পন্ন করার সঙ্গে সমুদ্রসম্পদ রক্ষার জন্য সরকারের উচিত কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করা, যাতে প্রকৃতির এই সম্পদের যথাযথ সুরক্ষা হয় এবং নিশ্চিত হয় ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে মাছ ধরা ট্রলারের সমুদ্রযাত্রার সময় সীমিত করা, জালের আকার নিয়ন্ত্রণ করা (যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারেন্ট জালের ব্যবহার), মাছ ধরার নির্দিষ্ট গভীরতার বিধিনিষেধ কার্যকর করা, কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা এবং সর্বোপরি মাছ ধরা ট্রলারের সংখ্যা সীমিত করা।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝপানিতে মাছ ধরা ট্রলারের পরিবর্তে এখন প্রয়োজন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিশ্চিত করা। বর্তমানে লাইসেন্সধারী ট্রলারগুলোর ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাছ আহরণ করার অনুমতি থাকলেও সেগুলো ১০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ গভীরতা থেকে আহরিত মাছের যেমন থাকে বৈচিত্র্য, তেমনি থাকে আন্তর্জাতিক বাজারের উচ্চ মূল্য। গভীর সমুদ্রে টিউনা মাছ ধরার বিষয়ে বাংলাদেশের উদাসীনতা বিষয়ে পত্রিকান্তরে রিপোর্টও ছাপা হয়েছে। ভারত মহাসাগরে মাছ ধরার অধিকার সংবলিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। অথচ কেবল ভারত মহাসাগর টিউনা কমিশনের সদস্যপদ এবং সমুদ্রের গভীরতায় মাছ ধরার মতো ট্রলার ও নির্দিষ্ট মাপের জালের অভাবে বাংলাদেশ এই মূল্যবান সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম—এসব দেশ ইতিমধ্যে টিউনা মাছ রপ্তানি করে আয় করছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। ভিয়েতনাম ২০১১ সালের প্রথমার্ধে রপ্তানি করেছে প্রায় ২১ কোটি ডলারের টিউনা। উল্লেখ্য, টিউনা ধরার জন্য এই কমিশনের সদস্য হওয়া সাপেক্ষে কোটা বরাদ্দ করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগানোর মতো সুবুদ্ধি আমাদের সরকার তথা নীতিনির্ধারক মহলের থাকা উচিত। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে রাখতে পারে কার্যকর ভূমিকা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করেছিল, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ভান্ডার সম্পর্কে জরিপ চালানোর আগে নতুন আর কোনো ট্রলারের অনুমতি যাতে দেওয়া না হয়। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে এই সুপারিশ উপেক্ষা করে পরবর্তী সরকারও ২০০২ সালে একইভাবে দিয়েছিল ৫০টি লাইসেন্স। অভিযোগ আছে, এগুলোর বেশির ভাগই দেওয়া হয় রাজনৈতিক এবং দলীয় বিবেচনায়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাগানো এসব লাইসেন্সের অনেকগুলোই আবার অবিশ্বাস্য চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হয় প্রকৃত মৎস্য আহরণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। জানা গেছে, এ বছর নাকি একটা জরিপ জাহাজ কেনা হচ্ছে, অথচ এই জাহাজ পৌঁছার আগেই ৩০টি লাইসেন্স দেওয়া হলো। তবে লাইসেন্সগুলো দেওয়ার পর গত বছরের শেষে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ফলে আমাদের সামুদ্রিক মৎস্যভান্ডার অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডার অসীম নয়, এই সম্পদ দীর্ঘদিন ভোগ করা যাবে যদি জরিপের পর নির্দেশনা মেনে মাছ ধরা হয়।
সরকারের কাছে আমাদের সামুদ্রিক মাছের ভান্ডার সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণাসূত্রে এটুকু জানা যায় যে বঙ্গোপসাগরে আছে ৬৫ প্রজাতির বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। মৎস্যভান্ডার সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত না থাকায় কতগুলো ট্রলারকে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া যাবে অথবা প্রতি মৌসুমে কী পরিমাণ মাছ ধরা যাবে সেটি কোনোভাবেই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ফলে সীমাতিরিক্ত ট্রলারের অবাধ বিচরণের কারণে দ্রুত নিঃশেষ হবে সেখানকার মৎস্য সম্পদ। এখানে কর্তৃপক্ষ হয়তো একটা ভালো যুক্তি দেখাতে পারবে যে অতিরিক্ত সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশের মৎস্য সম্পদও প্রায় নিঃশেষিত। জাপানের মৎস্য সম্পদ ২০ বছরের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু এই যুক্তি দেখানোর আগে বিবেচনা করা উচিত—সে সব দেশের আরও অন্যান্য বহু প্রাকৃতিক সম্পদ আছে যা বাংলাদেশের নেই। অবশ্য তারা সে রকম নেতিবাচক যুক্তি প্রদর্শনের দিকে যায়নি। তাদের মতে, বিগত বছরগুলোর উপাত্ত অনুযায়ী মৎস্য আহরণের পরিমাণ হ্রাস না পেয়ে বরং বেড়েছে—এবং এই বিবেচনাতেই তারা নতুন লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই বৃদ্ধির কারণ জাল, ট্রলার এবং নৌকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা। অর্থাৎ আরও বেশি পরিমাণ বহর ও অস্ত্রপাতি নিয়ে মাছ শিকারের কারণেই মোট আহরণ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝপানিতে মাছ ধরার জন্য অনুমতি দেওয়া ট্রলারগুলো একই সঙ্গে ওপরের পানির মাছও ধরে নিতে পারবে, কারণ এসব বিধিনিষেধ কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট নজরদারির কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের গড়পরতা মানুষের নৈতিকতা এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো, তথা নৌযান, জনবল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির অভাবে সেটি কোনো কাজে আসবে না। অগভীর জলের এসব মাছের সঙ্গে ধ্বংস হবে ইলিশের মতো মাছ ও জাটকা। আমরা জানি প্রতি মৌসুমে আমাদের নদীগুলোতে জাটকা নিধনের বিরুদ্ধে প্রচার এবং সরাসরি অভিযান চালিয়েও মৎস্যজীবী ও দাদনদারদের দৌরাত্ম্য ও আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। আমাদের এ রকম দৌরাত্ম্যের কারণে বঙ্গোপসাগরে আমাদের জলসীমা থেকে অভিবাসী হয়ে ভিন সমুদ্রে পাড়ি জমাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ভারতীয় জলসীমায় ইলিশের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়া এই প্রবণতারই লক্ষণ।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আওতায় রয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। আমাদের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ২২ শতাংশ আসে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ থেকে। এই গবেষণা প্রতিবেদনের হিসাবে দেশের প্রায় ১১ লাখ মৎস্যজীবী সরাসরি মৎস্য আহরণ পেশায় জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছে ভূমিহীন জেলে এবং সম্পন্ন মৎস্যজীবীও। এই পেশাজীবীদের প্রায় ৩৭ শতাংশ জড়িত সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের সঙ্গে। এদের বাইরে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী, যার সংখ্যা এক কোটির ওপর, খণ্ডকালীন মৎস্য আহরণ এবং চাষের সঙ্গে জড়িত। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আমাদের জিডিপির ৩.৭৪ শতাংশ আসে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ থেকে, আর আসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪.০৪ শতাংশ। অথচ দেশের বংশানুক্রমিক জেলে সম্প্রদায়ের সদস্যরা সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর। সামাজিক অবস্থান এবং হিন্দু বর্ণপ্রথায়ও তাঁদের অবস্থান সর্বনিম্নে। এ কারণেই ১৯৯৮ সালে প্রণীত জাতীয় মৎস্যনীতিতে বলা হয়েছিল আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মৎস্যজীবীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা। অবশ্য দুই দফায় ৮০টি লাইসেন্স দেওয়ার কাজটি সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রমের পরিচয় বহন করে না।
বাংলাদেশের তিনটি বৃহৎ নদী অববাহিকা মিলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বদ্বীপে সৃষ্টি করেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এক জলাভূমি। আমরা যখন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, এই বিশাল জলাভূমির মৎস্য সম্পদ হতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই নিরাপত্তার একটি প্রধান উৎস, কারণ চাষ এবং পরিচর্যা ছাড়াই এই মৎস্য সম্পদ বেড়ে ওঠে প্রাকৃতিক নিয়মে। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে লালন করতে পারলে এখানে রয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণে মানুষের বিকল্প পেশার অমিত সম্ভাবনা। ফাও-এর হিসাবমতে, (২০০৯) অসামুদ্রিক মৎস্য আহরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বের দ্বিতীয়। নদীগুলোতে অপরিকল্পিত মৎস্য শিকার, প্রাকৃতিক দূষণ এবং নাব্যতা হারানোর কারণে বর্তমানে এই অবস্থান অক্ষুণ্ন আছে কি না, কিংবা ভবিষ্যতে থাকবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অভ্যন্তরীণ নদী ও জলায় মৎস্য সম্পদের অবলুপ্তির কারণে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ব্যাপ্তি ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতির এই সম্পদটিও হুমকির মুখোমুখি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং তাদের বিকল্প পেশার অভাবও অনিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিত সমুদ্রসম্পদ আহরণে মানুষকে প্ররোচিত করছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের লাইসেন্স দেওয়ায় সরকারের যখন এতই আগ্রহ, যথাযথ জরিপ সম্পন্ন করার সঙ্গে সমুদ্রসম্পদ রক্ষার জন্য সরকারের উচিত কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করা, যাতে প্রকৃতির এই সম্পদের যথাযথ সুরক্ষা হয় এবং নিশ্চিত হয় ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে মাছ ধরা ট্রলারের সমুদ্রযাত্রার সময় সীমিত করা, জালের আকার নিয়ন্ত্রণ করা (যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারেন্ট জালের ব্যবহার), মাছ ধরার নির্দিষ্ট গভীরতার বিধিনিষেধ কার্যকর করা, কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা এবং সর্বোপরি মাছ ধরা ট্রলারের সংখ্যা সীমিত করা।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝপানিতে মাছ ধরা ট্রলারের পরিবর্তে এখন প্রয়োজন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিশ্চিত করা। বর্তমানে লাইসেন্সধারী ট্রলারগুলোর ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাছ আহরণ করার অনুমতি থাকলেও সেগুলো ১০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ গভীরতা থেকে আহরিত মাছের যেমন থাকে বৈচিত্র্য, তেমনি থাকে আন্তর্জাতিক বাজারের উচ্চ মূল্য। গভীর সমুদ্রে টিউনা মাছ ধরার বিষয়ে বাংলাদেশের উদাসীনতা বিষয়ে পত্রিকান্তরে রিপোর্টও ছাপা হয়েছে। ভারত মহাসাগরে মাছ ধরার অধিকার সংবলিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। অথচ কেবল ভারত মহাসাগর টিউনা কমিশনের সদস্যপদ এবং সমুদ্রের গভীরতায় মাছ ধরার মতো ট্রলার ও নির্দিষ্ট মাপের জালের অভাবে বাংলাদেশ এই মূল্যবান সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম—এসব দেশ ইতিমধ্যে টিউনা মাছ রপ্তানি করে আয় করছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। ভিয়েতনাম ২০১১ সালের প্রথমার্ধে রপ্তানি করেছে প্রায় ২১ কোটি ডলারের টিউনা। উল্লেখ্য, টিউনা ধরার জন্য এই কমিশনের সদস্য হওয়া সাপেক্ষে কোটা বরাদ্দ করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগানোর মতো সুবুদ্ধি আমাদের সরকার তথা নীতিনির্ধারক মহলের থাকা উচিত। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে রাখতে পারে কার্যকর ভূমিকা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments