প্রকৃতি-দুটি বিপন্ন তরুবীথি by মোকারম হোসেন
ঢাকায় পার্ক বা উদ্যান ব্যতীত অন্য কোথাও অশোক এবং রুদ্রপলাশের কোনো সুদীর্ঘ বীথির কথা মনে পড়ে? না পড়ারই কথা। কারণ, এমন দুটি নান্দনিক বীথি প্রকৃতিকে আলোকিত করার আগেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। কোন প্রকৃতিপ্রেমিক, কখন কীভাবে এই শৈল্পিক নিসর্গের আয়োজন করেছিলেন তার সঠিক কোনো ইতিহাস আজ আর জানা যায় না।
ধানমন্ডির ১৫/এ সড়কে গেলে দেখা যাবে, সড়কের দুই পাশে মাত্র সাতটি অশোকগাছ জরাজীর্ণভাবে বেঁচে আছে। দেখে খুব সহজেই বোঝা যায়, এগুলো প্রতিনিয়ত মানুষের হিংস্রতার শিকার হচ্ছে। কাণ্ড ও ডালপালায় ধুলো জমে হতশ্রী অবস্থা। কোনো কোনো গাছে ডালপালা উপড়ে ফেলারও চিহ্ন রয়েছে। অশোক দুষ্প্রাপ্য কোনো বৃক্ষ না হলেও পথের ধারে কিংবা উন্মুক্ত কোনো স্থানে পরিণত অশোকের পরিকল্পিত বীথি সচরাচর চোখে পড়ে না। ঢাকায় রমনা পার্কে আছে নান্দনিক অশোককুঞ্জ আর বোটানিক গার্ডেনে আছে একটি সুদীর্ঘ অশোকবীথি। অশোক এ অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ। মূলত ফুলের জন্যই গাছটি বিখ্যাত। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ ফুল কিছুটা আলাদা। কারণ, এর কাণ্ড ও ডালপালাজুড়ে ফুল ফোটে। শুধু তাই নয়, এর প্রস্ফুটনকালও অতি দীর্ঘ। অশোক মাঝারি আকৃতির ছায়াসুনিবিড় চিরহরিত্বৃক্ষ। গাঢ় সবুজ পাতাগুলো দীর্ঘ, চওড়া ও বর্শাফলাকৃতির। কচিপাতা কোমল, নমনীয়, ঝুলন্ত এবং তামাটে। ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম বসন্তকাল। অজস্র ফুলে ঘনবদ্ধ অশোকমঞ্জরি বর্ণ ও গড়নে আকর্ষণীয়। তাজা ফুলের রঙ কমলা, কিন্তু বাসি ফুল লাল। পরাগকেশর দীর্ঘ, উিক্ষপ্ত এবং পরাগকোষ গাঢ় লাল। মঞ্জরি পিঁপড়ার প্রিয় আবাস।
একই অবস্থা ধানমন্ডির ৮/এ ও ৯/এ সড়কের রুদ্রপলাশগুলোরও (আফ্রিকান টিউলিপ)। একসময় এ দুটি সড়কে বেশ কিছু গাছ থাকলেও এখন রুগ্ন অবস্থায় মাত্র চারটি রুদ্রপলাশ বেঁচে আছে। এই গাছ সুদূর আফ্রিকা থেকে বেশ আগেই আমাদের দেশে এসেছে। কিন্তু সে তুলনায় ততটা বিকশিত হয়নি। ঢাকায় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদউদ্যান, জাতীয় উদ্ভিদউদ্যান ও ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদউদ্যানে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি গাছ দেখা যায়। বেশ বড়সড় ধরনের গাছ, শাখা-প্রশাখা এলোমেলো, পাতা সংখ্যায় কম। বসন্তে নতুন পাতার সঙ্গে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। ফুল দেখতে অনেকটা মিষ্টি কুমড়ার ফুলের মতো।
প্রকৃতিপ্রেমী প্রিসিলা রাজ দীর্ঘদিন ধরে ধানমন্ডিতে বসবাস করছেন। তিনি উল্লিখিত তিনটি সড়কে আরও অনেকগুলো অশোক ও রুদ্রপলাশ দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এতগুলো গাছ কীভাবে হারিয়ে গেল তা তাঁর কাছেও বিস্ময়। তাঁর কথার সূত্র ধরেই কিছুটা তাগিদ অনুভব করি। স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করি, কিন্তু সঠিক কোনো তথ্য মেলে না। শেষে কথা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আবাসিক সড়কগুলোর তেমন কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। ভবিষ্যতে আমাদের এ বিষয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ঢাকা শহরকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে বিউটিফিকেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। তারা গাছপালা লাগিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা করছে।’ জানি তাঁর এ তথ্যটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশি তথ্য আর কোথায় মিলবে! আমরা আসলেই খুব আত্মবিস্মৃত। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের অনেক কিছুরই এখন আর হদিস নেই। ঘটা করে পালন করা হচ্ছে ঢাকার চার শ বছর। কিন্তু এই শহরে কি চার শ বছরের পুরোনো কোনো বৃক্ষ বেঁচে আছে? একসময় মানুষ বুঝে, না বুঝে বৃক্ষ নিধন করেছে, বন উজাড় করেছে। এখন সময় এসেছে প্রকৃতি সংরক্ষণের। নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে বনবনানী। আমরা যদি প্রকৃতিমনস্ক হই তাহলে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি উপরোক্ত অশোক ও রুদ্রপলাশের বীথিগুলোও বেঁচে থাকবে।
ধানমন্ডির আদি বাসিন্দা বৃক্ষপ্রেমিক সিরাজ আহমদ মনে করেন, ধানমন্ডির এসব গাছপালার অধিকাংশই পাকিস্তান আমলে সরকারের অবাঙালি কর্মকর্তাদের লাগানো। তারা সরকারি সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাড়ি লাগোয়া সড়কের দুই পাশে বৃক্ষসজ্জা করতে চেয়েছিলেন। সময়টা ষাটের দশকের প্রথম ভাগ। তখন ধানমন্ডি এলাকায় এমন আরও অনেক গাছপালা লাগানো হয়। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—কুর্চি, অ্যাভোকাডো, ট্যাবেবুইয়া, জংলি বাদাম, বুদ্ধনারকেল, জ্যাকারান্ডা, বাওবাব, অর্জুন, হরীতকী, বহেড়া, মিলেশিয়া, সোনাইল, ক্যাশিয়া জাভানিকা ইত্যাদি। তবে অসচেতনতা ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ইদানীং অনেক গাছপালাই হারিয়ে গেছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে (বর্তমান ১৬) আছে সুদৃশ্য পরশপিপুল, জ্যাকারান্ডা, নীলমণি আর মহুয়া। জানামতে রাজধানীর সবচেয়ে পুরোনো বাওবাব গাছটি আছে ৮ নম্বর সড়কের রেস্টুরেন্টের পেছনে। এভাবে পুরো ধানমন্ডিতেই বিচিত্র গাছপালার সমারোহ দেখা যায়। ধানমন্ডি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হলেও ক্রমেই সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনার পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। ফলে সেখানকার আবাসিক এলাকার পরিবেশ ক্রমশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আর এসবের প্রভাবে প্রকৃতিও বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পৃথিবীর সব উন্নত শহরের গাছপালাই পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়। কোন সড়কে কোন স্থাপনার পাশে কী ধরনের গাছ মানানসই এবং টেকসই—এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করা হয়। বিভিন্ন সড়কে কতটি গাছ লাগানো হলো, তারও একটি বিশদ বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়। আমাদের দেশেও এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। তাহলে কোন গাছটি কাটা পড়ল, কোনটি ঝড়ে উপড়ে পড়ল, কোনটি চুরি গেল, কোনটি মরে গেল তার একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমাদের হাতে থাকবে।
মোকারম হোসেন : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
tarupallab@gmail.com
একই অবস্থা ধানমন্ডির ৮/এ ও ৯/এ সড়কের রুদ্রপলাশগুলোরও (আফ্রিকান টিউলিপ)। একসময় এ দুটি সড়কে বেশ কিছু গাছ থাকলেও এখন রুগ্ন অবস্থায় মাত্র চারটি রুদ্রপলাশ বেঁচে আছে। এই গাছ সুদূর আফ্রিকা থেকে বেশ আগেই আমাদের দেশে এসেছে। কিন্তু সে তুলনায় ততটা বিকশিত হয়নি। ঢাকায় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদউদ্যান, জাতীয় উদ্ভিদউদ্যান ও ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদউদ্যানে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি গাছ দেখা যায়। বেশ বড়সড় ধরনের গাছ, শাখা-প্রশাখা এলোমেলো, পাতা সংখ্যায় কম। বসন্তে নতুন পাতার সঙ্গে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। ফুল দেখতে অনেকটা মিষ্টি কুমড়ার ফুলের মতো।
প্রকৃতিপ্রেমী প্রিসিলা রাজ দীর্ঘদিন ধরে ধানমন্ডিতে বসবাস করছেন। তিনি উল্লিখিত তিনটি সড়কে আরও অনেকগুলো অশোক ও রুদ্রপলাশ দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এতগুলো গাছ কীভাবে হারিয়ে গেল তা তাঁর কাছেও বিস্ময়। তাঁর কথার সূত্র ধরেই কিছুটা তাগিদ অনুভব করি। স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করি, কিন্তু সঠিক কোনো তথ্য মেলে না। শেষে কথা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আবাসিক সড়কগুলোর তেমন কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। ভবিষ্যতে আমাদের এ বিষয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ঢাকা শহরকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে বিউটিফিকেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। তারা গাছপালা লাগিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা করছে।’ জানি তাঁর এ তথ্যটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশি তথ্য আর কোথায় মিলবে! আমরা আসলেই খুব আত্মবিস্মৃত। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের অনেক কিছুরই এখন আর হদিস নেই। ঘটা করে পালন করা হচ্ছে ঢাকার চার শ বছর। কিন্তু এই শহরে কি চার শ বছরের পুরোনো কোনো বৃক্ষ বেঁচে আছে? একসময় মানুষ বুঝে, না বুঝে বৃক্ষ নিধন করেছে, বন উজাড় করেছে। এখন সময় এসেছে প্রকৃতি সংরক্ষণের। নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে বনবনানী। আমরা যদি প্রকৃতিমনস্ক হই তাহলে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি উপরোক্ত অশোক ও রুদ্রপলাশের বীথিগুলোও বেঁচে থাকবে।
ধানমন্ডির আদি বাসিন্দা বৃক্ষপ্রেমিক সিরাজ আহমদ মনে করেন, ধানমন্ডির এসব গাছপালার অধিকাংশই পাকিস্তান আমলে সরকারের অবাঙালি কর্মকর্তাদের লাগানো। তারা সরকারি সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাড়ি লাগোয়া সড়কের দুই পাশে বৃক্ষসজ্জা করতে চেয়েছিলেন। সময়টা ষাটের দশকের প্রথম ভাগ। তখন ধানমন্ডি এলাকায় এমন আরও অনেক গাছপালা লাগানো হয়। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—কুর্চি, অ্যাভোকাডো, ট্যাবেবুইয়া, জংলি বাদাম, বুদ্ধনারকেল, জ্যাকারান্ডা, বাওবাব, অর্জুন, হরীতকী, বহেড়া, মিলেশিয়া, সোনাইল, ক্যাশিয়া জাভানিকা ইত্যাদি। তবে অসচেতনতা ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ইদানীং অনেক গাছপালাই হারিয়ে গেছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে (বর্তমান ১৬) আছে সুদৃশ্য পরশপিপুল, জ্যাকারান্ডা, নীলমণি আর মহুয়া। জানামতে রাজধানীর সবচেয়ে পুরোনো বাওবাব গাছটি আছে ৮ নম্বর সড়কের রেস্টুরেন্টের পেছনে। এভাবে পুরো ধানমন্ডিতেই বিচিত্র গাছপালার সমারোহ দেখা যায়। ধানমন্ডি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হলেও ক্রমেই সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনার পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। ফলে সেখানকার আবাসিক এলাকার পরিবেশ ক্রমশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আর এসবের প্রভাবে প্রকৃতিও বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পৃথিবীর সব উন্নত শহরের গাছপালাই পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়। কোন সড়কে কোন স্থাপনার পাশে কী ধরনের গাছ মানানসই এবং টেকসই—এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করা হয়। বিভিন্ন সড়কে কতটি গাছ লাগানো হলো, তারও একটি বিশদ বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়। আমাদের দেশেও এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। তাহলে কোন গাছটি কাটা পড়ল, কোনটি ঝড়ে উপড়ে পড়ল, কোনটি চুরি গেল, কোনটি মরে গেল তার একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমাদের হাতে থাকবে।
মোকারম হোসেন : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
tarupallab@gmail.com
No comments