চিরকুট-সৃষ্টিসুখের উল্লাস by শাহাদুজ্জামান
‘যা কিছু চাক্ষুষ, আপনি তা দেখে ভাবেন—কেন? আর যা কিছু চাক্ষুষ নয়, আমি তা স্বপ্নে দেখে ভাবি—কেন নয়?’ একবার বলেছিলেন বার্নার্ড শ। এই ‘কেন নয়’-এর প্রোণোদনা থেকেই সৃষ্টি করে মানুষ। যা নেই, কেন তা হবে না? দূর কল্পনার অসম্ভবকে তারা সৃজনশীলতায় টেনে আনেন বাস্তবতার মাটিতে।
চেনা বাস্তবতার ভেতর তৈরি করেন নতুন আরেকটি বাস্তবতা। কেউ সৃষ্টি করেন প্রতিষ্ঠান; কেউ শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান। তবে এই দুই ধরনের কাজের সৃজনশীলতার প্রক্রিয়াটি ভিন্ন। শিল্প-সাহিত্যের সৃজনশীলতার কাজ কিংবা বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার কাজ মূলত নিঃসঙ্গ আর প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি প্রধানত একটি দলীয় কর্মকাণ্ড। অভিনব প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট সৃষ্টি করেছেন বিল গেটস, অভিনব পেইন্টিং ‘স্টারি নাইটস’ সৃষ্টি করেছেন ভ্যান গঘ, আপেক্ষিকতার অভিনব তত্ত্ব দিয়েছেন আইনস্টাইন। প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেওয়া আর মৌলিক শিল্পকর্ম বা বিজ্ঞান ভাবনা জন্ম দেওয়ার কাজ দাবি করে দুই ধরনের ব্যক্তিত্ব।
বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যের নিঃসঙ্গ সৃজনশীলতার পথে যারা হাঁটেন, তাঁরা করোটিতে একটি ভাবনার ঘোর বয়ে বেড়ান একা একা। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা।’ দলে কাজ করা তাঁদের পক্ষে দুরূহ। তাঁদের অনেকে এমন সৃষ্টি হাজির করেন যে পৃথিবী তখনো হয়তো এর জন্য প্রস্তুত নয়। তাঁর জীবদ্দশায় একটি ছবি বিক্রি করতেও কি মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন ভ্যান গঘ। অথচ আজ কেউ তাঁর কোনো একটি ছবির মালিক হতে হলে পকেটে থাকতে হবে কয়েক মিলিয়ন ডলার। এ ধরনের মানুষ সৃষ্টিকর্মটিকে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াটিকে। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেন কিন্তু সাধারণভাবে হয়ে থাকেন উদ্ধত, আত্মকেন্ত্রিক। সাফল্য তাঁরা চান বটে, কিন্তু সেটিই তাঁদের মনোযোগের মূল বিষয় নয়। এই জগৎসংসারে তাঁরা মূলত যেটি চান, সেটি হচ্ছে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা। তাঁরা এমন একটি জায়গা খোঁজেন, যেখানে বসে অসম্ভব সব ভাবনা ভাবা যাবে। সৃজনশীলতার ঘোরগ্রস্ত শিল্পী চরম কোনো ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ভ্যান গঘ নিজের কান কেটে ফেলেন, বেছে নেন আত্মহননের পথ। লেখক কমলকুমার মজুমদার এ ধরনের সৃষ্টিশীল মানুষ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘ইহারা বালকবত্, উন্মাদবত্, পৈশচিকও বটে।’
এ ধরনের মানুষ দিয়ে প্রতিষ্ঠান হয় না। প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য চাই হিসেবি মানুষ। শুধু সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার আনন্দে থাকলে তাঁদের চলে না, সৃষ্টির উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে হয়। ভাবনার ঘোরে তাঁরাও থাকেন। তবে মৌলিক ভাবুক হওয়া তাঁদের জন্য অনিবার্য নয়। বিদ্যমান কোনো ভাবনা বা প্রযুক্তির সৃজনশীল এবং যুগোপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাঁরা। মহাকালে মূল্যায়িত হবে—এই ভাবনায় মাইক্রোসফট গড়েননি বিল গেটস। কম্পিউটার সৃষ্টি করেননি তিনি কিন্তু অ্যালেন তুরিং প্রমুখদের উদ্ভাবিত এবং পরবর্তী সময়ে আরও বিকশিত একটি প্রযুক্তির সৃজনশীল মোড় ঘুড়িয়ে একে করে তুলেছেন যুগোপযোগী। একা নন বিল গেটস, কাজ করেছেন দল নিয়ে। প্রতিষ্ঠান যাঁরা সৃষ্টি করেন, ঝুঁকি তাঁরাও নেন কিন্তু সেই ঝুঁকির ভেতরে থাকে বিস্তর যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। আবেগে নিজের কান কেটে ফেলার মতো ঘটনা কখনোই ঘটাবেন না তাঁরা। তেমনি প্রতিষ্ঠান যাঁরা সৃষ্টি করেন, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং রক্ষায় পারঙ্গম হতে হয় তাঁদের। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে মৌলিক সৃষ্টিতে নিজেদের নিয়োজিত করেন যেসব ব্যক্তি, প্রায়সই তাঁদের সামাজিক দক্ষতা থাকে দুর্বল। সমাজকে তাঁরা অনেকেই প্রত্যাখ্যানও করেন। স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন-যাপনেও প্রায় ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন তাঁরা। নিজের ভেতরে যতটুকু ভালোবাসা, স্নেহ, বাৎসল্য মজুদ আছে; সেটুকু সব নিংড়ে সংসারের বদলে তাঁরা ঢেলে দেন তাঁদের সৃজনশীলতায়। তাঁরা মোমবাতির দুই দিকেই জালান। কম্পিউটারের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটস পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হলেও কম্পিউটারের মৌলিক ভাবুক অ্যালেন তুরিং একাকী ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে স্বনামধন্য হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশকেই বস্তুত নির্ভর করতে হয় এমনি আপাত ব্যর্থ, বেখেয়াল, আত্মঘাতী কোনো মৌলিক ভাবুকেরই ওপর।
শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে সফল মৌলিক সৃষ্টি করেছেন, পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন সফল প্রতিষ্ঠান—এমন উদাহরণ বিরল। মনে পড়ছে কেবল রবীন্দ্রনাথের কথা। বিপুল সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি জন্ম দিয়েছেন অভিনব প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর। একদিকে লিখছেন ‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে’, অন্যদিকে টাকা জোগাড়ে বেরিয়েছেন বিশ্বভারতীর জন্য। টলস্টয়, গ্যেটে বা আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত সৃষ্টি পাহাড়সমান, কিন্তু তাঁরা নিজ হাতে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে পারেননি। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অনন্য।
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে যে নবীনদের চোখ হাসছে, মুখ হাসছে, টগবগিয়ে খুন হাসছে, তাদের চিনে নেওয়া প্রয়োজন নিজেদের যাত্রাপথটি। তারা একেকজন হয়ে উঠতে পারে ব্যর্থ, ছোট, মাঝারি এমনকি প্রমাণ সাইজের ভ্যান গঘ অথবা বিল গেটস কিংবা রবীন্দ্রনাথ।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যের নিঃসঙ্গ সৃজনশীলতার পথে যারা হাঁটেন, তাঁরা করোটিতে একটি ভাবনার ঘোর বয়ে বেড়ান একা একা। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা।’ দলে কাজ করা তাঁদের পক্ষে দুরূহ। তাঁদের অনেকে এমন সৃষ্টি হাজির করেন যে পৃথিবী তখনো হয়তো এর জন্য প্রস্তুত নয়। তাঁর জীবদ্দশায় একটি ছবি বিক্রি করতেও কি মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন ভ্যান গঘ। অথচ আজ কেউ তাঁর কোনো একটি ছবির মালিক হতে হলে পকেটে থাকতে হবে কয়েক মিলিয়ন ডলার। এ ধরনের মানুষ সৃষ্টিকর্মটিকে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াটিকে। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেন কিন্তু সাধারণভাবে হয়ে থাকেন উদ্ধত, আত্মকেন্ত্রিক। সাফল্য তাঁরা চান বটে, কিন্তু সেটিই তাঁদের মনোযোগের মূল বিষয় নয়। এই জগৎসংসারে তাঁরা মূলত যেটি চান, সেটি হচ্ছে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা। তাঁরা এমন একটি জায়গা খোঁজেন, যেখানে বসে অসম্ভব সব ভাবনা ভাবা যাবে। সৃজনশীলতার ঘোরগ্রস্ত শিল্পী চরম কোনো ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ভ্যান গঘ নিজের কান কেটে ফেলেন, বেছে নেন আত্মহননের পথ। লেখক কমলকুমার মজুমদার এ ধরনের সৃষ্টিশীল মানুষ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘ইহারা বালকবত্, উন্মাদবত্, পৈশচিকও বটে।’
এ ধরনের মানুষ দিয়ে প্রতিষ্ঠান হয় না। প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য চাই হিসেবি মানুষ। শুধু সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার আনন্দে থাকলে তাঁদের চলে না, সৃষ্টির উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে হয়। ভাবনার ঘোরে তাঁরাও থাকেন। তবে মৌলিক ভাবুক হওয়া তাঁদের জন্য অনিবার্য নয়। বিদ্যমান কোনো ভাবনা বা প্রযুক্তির সৃজনশীল এবং যুগোপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাঁরা। মহাকালে মূল্যায়িত হবে—এই ভাবনায় মাইক্রোসফট গড়েননি বিল গেটস। কম্পিউটার সৃষ্টি করেননি তিনি কিন্তু অ্যালেন তুরিং প্রমুখদের উদ্ভাবিত এবং পরবর্তী সময়ে আরও বিকশিত একটি প্রযুক্তির সৃজনশীল মোড় ঘুড়িয়ে একে করে তুলেছেন যুগোপযোগী। একা নন বিল গেটস, কাজ করেছেন দল নিয়ে। প্রতিষ্ঠান যাঁরা সৃষ্টি করেন, ঝুঁকি তাঁরাও নেন কিন্তু সেই ঝুঁকির ভেতরে থাকে বিস্তর যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। আবেগে নিজের কান কেটে ফেলার মতো ঘটনা কখনোই ঘটাবেন না তাঁরা। তেমনি প্রতিষ্ঠান যাঁরা সৃষ্টি করেন, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং রক্ষায় পারঙ্গম হতে হয় তাঁদের। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে মৌলিক সৃষ্টিতে নিজেদের নিয়োজিত করেন যেসব ব্যক্তি, প্রায়সই তাঁদের সামাজিক দক্ষতা থাকে দুর্বল। সমাজকে তাঁরা অনেকেই প্রত্যাখ্যানও করেন। স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন-যাপনেও প্রায় ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন তাঁরা। নিজের ভেতরে যতটুকু ভালোবাসা, স্নেহ, বাৎসল্য মজুদ আছে; সেটুকু সব নিংড়ে সংসারের বদলে তাঁরা ঢেলে দেন তাঁদের সৃজনশীলতায়। তাঁরা মোমবাতির দুই দিকেই জালান। কম্পিউটারের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটস পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হলেও কম্পিউটারের মৌলিক ভাবুক অ্যালেন তুরিং একাকী ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে স্বনামধন্য হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশকেই বস্তুত নির্ভর করতে হয় এমনি আপাত ব্যর্থ, বেখেয়াল, আত্মঘাতী কোনো মৌলিক ভাবুকেরই ওপর।
শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে সফল মৌলিক সৃষ্টি করেছেন, পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন সফল প্রতিষ্ঠান—এমন উদাহরণ বিরল। মনে পড়ছে কেবল রবীন্দ্রনাথের কথা। বিপুল সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি জন্ম দিয়েছেন অভিনব প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর। একদিকে লিখছেন ‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে’, অন্যদিকে টাকা জোগাড়ে বেরিয়েছেন বিশ্বভারতীর জন্য। টলস্টয়, গ্যেটে বা আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত সৃষ্টি পাহাড়সমান, কিন্তু তাঁরা নিজ হাতে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে পারেননি। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অনন্য।
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে যে নবীনদের চোখ হাসছে, মুখ হাসছে, টগবগিয়ে খুন হাসছে, তাদের চিনে নেওয়া প্রয়োজন নিজেদের যাত্রাপথটি। তারা একেকজন হয়ে উঠতে পারে ব্যর্থ, ছোট, মাঝারি এমনকি প্রমাণ সাইজের ভ্যান গঘ অথবা বিল গেটস কিংবা রবীন্দ্রনাথ।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments