সেইদিন সন্ধ্যায় ছায়ানট ভবনে by আলী যাকের

এই দু'দিন আগে ছায়ানট ভবনে গিয়েছিলাম আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন সন্্জীদা খাতুনের সংবর্ধনায়। সম্প্রতি তাঁকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশিকোত্তম সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। খুব বেশি মানুষকে এই বিরল সম্মান বিশ্বভারতী প্রদান করে না।


রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য_ সর্বোপরি বাঙালির সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে তাঁর নিরলস কর্ম এবং সাফল্য তাঁকে এই সম্মান এনে দিয়েছে। আমি এবং সারা যখন ছায়ানট মিলনায়তনে পৌঁছুলাম, তখন একেবারে পেছনে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানোর সামান্য একটু জায়গা পেয়েছিলাম। সেইখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করবার আগে, সেই আধো-আলো আধো-অন্ধকারে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম ওই দিনের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ সন্্জীদা আপাকে। দেখলাম, একেবারে সামনের সারিতে ডান দিকের কোণে তিনি বসে আছেন। একটি হালকা আলো বোধ হয় তাঁর ওপরে দেওয়া হয়েছিল। দেশিকোত্তম অর্জন এবং সে উপলক্ষে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য যে অনুষ্ঠান, সেখানে সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপস্থিতি সাধারণত সম্র্রাজ্ঞীর মতোই হওয়ার কথা। কিন্তু লক্ষ্য করলাম যে, তিনি সবসময় যেমন, আজকেও তেমনি একজন শিক্ষাবিদ এবং সংস্কৃতিজনের বিনয় নিয়ে আপন আসনে বসে আছেন।
আমরা যারা সেই ষাটের দশকের প্রথম থেকে তাঁকে জানি, তারা এ বিষয়ে অবগত আছি যে, এই সহজ, অনাড়ম্বর মানুষটি কী ঋজু ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সেই '৬২ সালে এক সম্পূর্ণ বৈরী পরিস্থিতিতে ছায়ানটকে অবলম্বন করে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই নারী। আজ, এই অর্ধশতাব্দী সময় তিনি পার করে দিয়েছেন তাঁর আদর্শ এবং মূল্যবোধকে অবলম্বন করে, আপসহীনভাবে। অসাধারণ এক সন্ধ্যা সেই দিন তাঁর হাতে গড়া ছায়ানট তাঁকে উপহার দিয়েছিল। সঙ্গীত এবং নৃত্যের এমন নিখুঁত উপস্থাপনা আমি দীর্ঘদিন দেখিনি। আমরা অনুষ্ঠান দেখছিলাম আর বারবার চোখ ফেরাচ্ছিলাম সেই নিভৃত কোণে বসে থাকা সন্্জীদা আপার ওপরে। আমার মন বলছিল, যদি পারতাম তার মনের ভেতরে ঢুকতে? তাহলে বোঝার চেষ্টা করতাম সেই মুহূর্তে কী ভাবছে তাঁর মন। এতগুলো বছর শিল্প এবং ভাষার চর্চায় পার করে দিয়েছেন তিনি। এই পথযাত্রায় কত সহযাত্রীর সঙ্গে হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। তাঁদের অনেকেই আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কত শত ছাত্রছাত্রী বেরিয়েছে তাঁর এই পরিশ্রমের ফসল হিসেবে। এই দীর্ঘ পদচারণায় তিনি যেমন সাধুবাদ পেয়েছেন, স্বীকৃতি পেয়েছেন; তেমনি অনেক সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। এই পথচলায় তিনি তবুও আপসহীনভাবে বিবেক নির্দেশিত পথে এগিয়ে গেছেন; অনেক সময় একেবারে একা। আজ তাঁরই সৃষ্ট সংস্কৃতিকর্মীদের হৃদয় জয় করা অনুষ্ঠানে বসে তাঁর চোখে এসেছিল কি আনন্দাশ্রু? হয়তো আসেনি। কেননা, আমি মিনু আপাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। সব শেষে এসে আমি তাকে যে নামে সম্বোধন করি, আনুষ্ঠানিকতার ভূষণ থেকে বেরিয়ে এসে সেই নামটি উল্লেখ করলাম।
এ রকম ধীশক্তিসম্পন্ন, অনমনীয়, সৎ এবং শুদ্ধ দশ ব্যক্তির প্রয়োজন এই মুহূর্তে, এই হতভাগা দেশে। তাহলে আমরা সর্বক্ষেত্রেই দেশটির চেহারা একেবারে পাল্টে ফেলতে পারব। মিনু আপা আরও বহুদিন বেঁচে থাকুন এবং বাংলাদেশবাসীকে শুদ্ধ সংস্কৃতির পথে চলতে অনুপ্রাণিত করুন।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক
ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.