বিশেষ সাক্ষাৎকার : মার্কো ফিশার-জীববিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রাকৃতিক জাদুঘর
মার্কো ফিশার। বিশ্বের নামকরা ট্যাক্সিডার্মিস্টদের একজন। তাঁর তৈরি বিভিন্ন প্রাণীর চর্ম-প্রতিরূপ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান (২০০৮ সালে) এবং ইউরোপে প্রথম (২০১০ সালে) স্থান অধিকার করেছিল। তিনি জার্মানির একটি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে গত তিন বছর ধরে তিনি ছাত্রদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। চলতি মার্চ মাসের প্রথম দিকে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরহাদ মাহমুদ।
কালের কণ্ঠ: কত দিন ধরে আপনি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সঙ্গে জড়িত আছেন এবং চর্ম-প্রতিরূপ তৈরির সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হলেন?
মার্কো ফিশার: আমি এরফার্ট ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের এ পেশায় আছি ২০ বছর ধরে। তবে চর্ম-প্রতিরূপ তৈরির সঙ্গে আমি আমার স্কুল জীবন থেকেই যুক্ত আছি। তখন আমি প্রকৃতিবিজ্ঞানবিষয়ক একটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং সেখানেই আমার প্রতিরূপ তৈরির হাতেখড়ি। সেই স্কুলজীবন থেকেই এ কাজটি আমাকে দারুণভাবে টানত এবং সেই টান আমি এখনো অনুভব করি।
কালের কণ্ঠ: তার মানে এই কাজকে আপনার পেশার পাশাপাশি নেশাও বলা চলে- তাই নয় কি?
মার্কো ফিশার: অনেকটা তাই।
কালের কণ্ঠ: ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রয়োজন বা উপযোগিতা নিয়ে কিছু বলবেন কি?
মার্কো ফিশার: সাধারণভাবে মানুষের কৌতূহল মেটানো, কোনো বিষয় সম্পর্কে জানাশোনা কিংবা নিছক আনন্দ দানের জন্যও জাদুঘরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করা হয়। এগুলোর যেমন প্রয়োজন আছে, প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো, সেটি উদ্ভিদই হোক আর প্রাণীই হোক, রক্ষা করাও একই রকম প্রয়োজনীয়। কাজেই জাদুঘরের এ দিকটা নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো আমরা যেভাবে রক্ষা করি, সেগুলো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ নিদর্শনগুলো এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কোনো শিক্ষার্থী হয় তো কোনো একটি দুর্লভ প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছে। প্রকৃতিতে মাস কিংবা বছর ধরে চেষ্টা করেও হয়তো দুয়েকবারের বেশি তাকে দেখা যায় না, তাও খুব স্বল্প সময়ের জন্য। এই দেখা তাঁর গবেষণার প্রয়োজন কতটা মেটাতে পারবে? জাদুঘরে ওই প্রাণীটির প্রতিরূপ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা গেলে ওই ছাত্র তা দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। সেই প্রাণীটির পরিবেশ জানতে পারবে, কারণ জাদুঘরে সেভাবেই প্রতিরূপটি রাখা হয়। পাশাপাশি আজকাল কম্পিউটারের সাহায্যে প্রাণীটির হাঁটাচলা কিংবা উড়ে বেড়ানো, আচার-আচরণ, খাদ্য গ্রহণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়। কাজেই একজন গবেষক প্রকৃতিতে যা পান না, প্রাকৃতিক জাদুঘরে তার চেয়ে বেশি কিছু পান। আবার উন্নত জাদুঘরগুলো প্রাণীটির জেনেটিক বা কৌলিক তথ্যগুলোও সংরক্ষণ করে, যা একজন গবেষকের জানা খুবই প্রয়োজন। এসব বিষয় জানার পর একজন গবেষক প্রকৃতিতে গিয়ে তাঁর আবাসস্থল ও অন্যান্য বিষয় জানার চেষ্টা করলে তাতে অনেক বেশি লাভবান হবেন। আবার প্রকৃতি থেকে অনেক প্রাণী ইতিমধ্যে হারিয়েও গেছে, ভবিষ্যতেও যাবে। সেই প্রাণীগুলো জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকলে শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা সেই প্রাণীগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবেন এবং গবেষণায় অনেক যোগসূত্র খুঁজে পাবেন।
কালের কণ্ঠ: এভাবে কতদিন ধরে ওই প্রাণীগুলো সংরক্ষণ করা যাবে?
মার্কো ফিশার: বার্লিন জাদুঘরে চার শ বছরেরও বেশি সময় আগে তৈরি করা কিছু প্রাণীর প্রতিরূপও সংরক্ষিত আছে, যদিও সেগুলো এখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এর কারণ তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কিংবা আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছিল না। আজকাল প্রাণী সংরক্ষণের অনেক উন্নত ও কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। তাই এখন যেসব মমি করা হয়, সেগুলোর গুণগত মান যেমন উন্নত হয়, তেমনি এগুলো টিকবেও অনেক দিন, হাজার বছরেরও বেশি তো অবশ্যই।
কালের কণ্ঠ: প্রাণীর প্রতিরূপ করার জন্য জীবিত প্রাণী মারা হলে সেটি কি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা হিসেবে গণ্য হবে না কিংবা বিরল প্রজাতিগুলোর জন্য এটি কি অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে না?
মার্কো ফিশার: একেবারেই না। কারণ, প্রাকৃতিক জাদুঘরের অভিজ্ঞ লোকজন কখনোই বিরল প্রজাতির কোনো বন্য প্রাণীকে হত্যা করবে না। আর নমুনা সংগ্রহের জন্য হত্যা করার প্রয়োজনও নেই। যেসব প্রাণী প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে মারা যায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা যায় অথবা চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত যেসব প্রাণী মারা যায়, সেগুলোর মৃতদেহ সংগ্রহ করেই মমি করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আমাদের এরফার্ট প্রাকৃতিক জাদুঘরের কথাই বলতে পারি। এখানে তিন হাজারের মতো প্রাণী সংরক্ষিত আছে, এর কোনোটিই মেরে সংরক্ষণ করা হয়নি।
কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশে একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর থাকা কতটা প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন?
মার্কো ফিশার: উন্নত দেশগুলোতে এখন প্রাকৃতিক জাদুঘর ছাড়া জীববিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কল্পনাই করা যায় না। জার্মানিতে তো প্রতিটি রাজ্যেই এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর রয়েছে। বাংলাদেশে তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে জীববিজ্ঞান পড়ানো হয়। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রয়োজন মেটানোর জন্য অবশ্যই এখানে এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ইতিমধ্যেই অনেক পাখি, অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে। কিছু প্রাণী সংখ্যায় খুবই কমে গেছে। যেমন ধরুন, শকুনের কথা। শকুন সংখ্যায় খুবই কমে গেছে। অচিরেই প্রকৃতি থেকে হারিয়েও যেতে পারে। অথচ আপনি দেখাতে পারবেন কি বাংলাদেশের কোথাও একটি শকুনকে আধুনিক ও মানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে? তাহলে যে শিক্ষার্থী শকুন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তিনি কী করবেন?
আর শুধু গবেষণার কথাই বা বলি কেন। সাধারণ মানুষকে প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্যও প্রাকৃতিক জাদুঘর একটি অন্যতম উপায়। কারণ, চিড়িয়াখানায় আপনি খুব বেশি প্রাণী রাখতে পারবেন না, যা অনেক কম খরচে একটি প্রাকৃতিক জাদুঘরে অবিকল পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে পারবেন। সত্যিকার পরিবেশে হুবুহু বণ্য প্রাণীকে দেখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী হবে এবং তারা প্রকৃতি সংরক্ষণে সহায়তা করবে। তা না করে প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আপনি নানা রকম আইন করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে, আগ্রহ না থাকলে সেসব আইন খুব একটা বাস্তবায়িত হবে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর থাকাটা খুবই জরুরি।
কালের কণ্ঠ: একেকটি প্রাণী-প্রতিরূপ তৈরিতে কেমন খরচ হয়? এ ধরনের জাদুঘর তৈরিই বা কতটা ব্যয়বহুল ব্যাপার?
মার্কো ফিশার: ব্যয়ের ব্যাপারটি একেক দেশে একেক রকম। আবার কত বেশি মানসম্পন্ন করে বানানো হবে, তার ওপরও নির্ভর করে খরচের ব্যাপারটি। এখানে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় শ্রমঘণ্টার ক্ষেত্রে। উপাদানের খরচ খুব বেশি নয়। যেমন ধরুন- একটি বেজির প্রতিরূপ তৈরি করতে যেসব উপাদান লাগবে, তার দাম হবে পাঁচ থেকে ছয় শ টাকার মতো। কিন্তু আপনি যদি যথেষ্ট মানসম্পন্ন করে বানাতে চান, তাহলে দেখা যাবে একজন অভিজ্ঞ লোকেরও কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। অভিজ্ঞ লোকটির কয়েক মাসের শ্রমের দাম জার্মানিতে অনেক বেশি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক কম হবে। আর জাদুঘর তৈরির খরচও নির্ভর করবে তার সামগ্রিক মানের ওপর। যেমন, আপনি যদি জেনেটিক ডাটাসহ প্রাণীর আচরণ প্রদর্শন করতে চান, তাহলে এক ধরনের খরচ হবে। আবার যদি কেবল নির্দিষ্ট পরিবেশে প্রাণীটিকে রাখতে চান, তাহলে আরেক ধরনের খরচ হবে। তবে তা অন্যান্য জাদুঘরের চেয়ে খুব একটা বেশি হবে না। বরং উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতা থাকলে অনেক কম খরচেই সেটি করা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মার্কো ফিশার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ: কত দিন ধরে আপনি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সঙ্গে জড়িত আছেন এবং চর্ম-প্রতিরূপ তৈরির সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হলেন?
মার্কো ফিশার: আমি এরফার্ট ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের এ পেশায় আছি ২০ বছর ধরে। তবে চর্ম-প্রতিরূপ তৈরির সঙ্গে আমি আমার স্কুল জীবন থেকেই যুক্ত আছি। তখন আমি প্রকৃতিবিজ্ঞানবিষয়ক একটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং সেখানেই আমার প্রতিরূপ তৈরির হাতেখড়ি। সেই স্কুলজীবন থেকেই এ কাজটি আমাকে দারুণভাবে টানত এবং সেই টান আমি এখনো অনুভব করি।
কালের কণ্ঠ: তার মানে এই কাজকে আপনার পেশার পাশাপাশি নেশাও বলা চলে- তাই নয় কি?
মার্কো ফিশার: অনেকটা তাই।
কালের কণ্ঠ: ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রয়োজন বা উপযোগিতা নিয়ে কিছু বলবেন কি?
মার্কো ফিশার: সাধারণভাবে মানুষের কৌতূহল মেটানো, কোনো বিষয় সম্পর্কে জানাশোনা কিংবা নিছক আনন্দ দানের জন্যও জাদুঘরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করা হয়। এগুলোর যেমন প্রয়োজন আছে, প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো, সেটি উদ্ভিদই হোক আর প্রাণীই হোক, রক্ষা করাও একই রকম প্রয়োজনীয়। কাজেই জাদুঘরের এ দিকটা নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু প্রাকৃতিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলো আমরা যেভাবে রক্ষা করি, সেগুলো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ নিদর্শনগুলো এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কোনো শিক্ষার্থী হয় তো কোনো একটি দুর্লভ প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছে। প্রকৃতিতে মাস কিংবা বছর ধরে চেষ্টা করেও হয়তো দুয়েকবারের বেশি তাকে দেখা যায় না, তাও খুব স্বল্প সময়ের জন্য। এই দেখা তাঁর গবেষণার প্রয়োজন কতটা মেটাতে পারবে? জাদুঘরে ওই প্রাণীটির প্রতিরূপ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা গেলে ওই ছাত্র তা দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। সেই প্রাণীটির পরিবেশ জানতে পারবে, কারণ জাদুঘরে সেভাবেই প্রতিরূপটি রাখা হয়। পাশাপাশি আজকাল কম্পিউটারের সাহায্যে প্রাণীটির হাঁটাচলা কিংবা উড়ে বেড়ানো, আচার-আচরণ, খাদ্য গ্রহণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়। কাজেই একজন গবেষক প্রকৃতিতে যা পান না, প্রাকৃতিক জাদুঘরে তার চেয়ে বেশি কিছু পান। আবার উন্নত জাদুঘরগুলো প্রাণীটির জেনেটিক বা কৌলিক তথ্যগুলোও সংরক্ষণ করে, যা একজন গবেষকের জানা খুবই প্রয়োজন। এসব বিষয় জানার পর একজন গবেষক প্রকৃতিতে গিয়ে তাঁর আবাসস্থল ও অন্যান্য বিষয় জানার চেষ্টা করলে তাতে অনেক বেশি লাভবান হবেন। আবার প্রকৃতি থেকে অনেক প্রাণী ইতিমধ্যে হারিয়েও গেছে, ভবিষ্যতেও যাবে। সেই প্রাণীগুলো জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকলে শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা সেই প্রাণীগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবেন এবং গবেষণায় অনেক যোগসূত্র খুঁজে পাবেন।
কালের কণ্ঠ: এভাবে কতদিন ধরে ওই প্রাণীগুলো সংরক্ষণ করা যাবে?
মার্কো ফিশার: বার্লিন জাদুঘরে চার শ বছরেরও বেশি সময় আগে তৈরি করা কিছু প্রাণীর প্রতিরূপও সংরক্ষিত আছে, যদিও সেগুলো এখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এর কারণ তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কিংবা আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছিল না। আজকাল প্রাণী সংরক্ষণের অনেক উন্নত ও কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। তাই এখন যেসব মমি করা হয়, সেগুলোর গুণগত মান যেমন উন্নত হয়, তেমনি এগুলো টিকবেও অনেক দিন, হাজার বছরেরও বেশি তো অবশ্যই।
কালের কণ্ঠ: প্রাণীর প্রতিরূপ করার জন্য জীবিত প্রাণী মারা হলে সেটি কি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা হিসেবে গণ্য হবে না কিংবা বিরল প্রজাতিগুলোর জন্য এটি কি অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে না?
মার্কো ফিশার: একেবারেই না। কারণ, প্রাকৃতিক জাদুঘরের অভিজ্ঞ লোকজন কখনোই বিরল প্রজাতির কোনো বন্য প্রাণীকে হত্যা করবে না। আর নমুনা সংগ্রহের জন্য হত্যা করার প্রয়োজনও নেই। যেসব প্রাণী প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে মারা যায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা যায় অথবা চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত যেসব প্রাণী মারা যায়, সেগুলোর মৃতদেহ সংগ্রহ করেই মমি করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আমাদের এরফার্ট প্রাকৃতিক জাদুঘরের কথাই বলতে পারি। এখানে তিন হাজারের মতো প্রাণী সংরক্ষিত আছে, এর কোনোটিই মেরে সংরক্ষণ করা হয়নি।
কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশে একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর থাকা কতটা প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন?
মার্কো ফিশার: উন্নত দেশগুলোতে এখন প্রাকৃতিক জাদুঘর ছাড়া জীববিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কল্পনাই করা যায় না। জার্মানিতে তো প্রতিটি রাজ্যেই এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর রয়েছে। বাংলাদেশে তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে জীববিজ্ঞান পড়ানো হয়। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রয়োজন মেটানোর জন্য অবশ্যই এখানে এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ইতিমধ্যেই অনেক পাখি, অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে। কিছু প্রাণী সংখ্যায় খুবই কমে গেছে। যেমন ধরুন, শকুনের কথা। শকুন সংখ্যায় খুবই কমে গেছে। অচিরেই প্রকৃতি থেকে হারিয়েও যেতে পারে। অথচ আপনি দেখাতে পারবেন কি বাংলাদেশের কোথাও একটি শকুনকে আধুনিক ও মানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে? তাহলে যে শিক্ষার্থী শকুন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তিনি কী করবেন?
আর শুধু গবেষণার কথাই বা বলি কেন। সাধারণ মানুষকে প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্যও প্রাকৃতিক জাদুঘর একটি অন্যতম উপায়। কারণ, চিড়িয়াখানায় আপনি খুব বেশি প্রাণী রাখতে পারবেন না, যা অনেক কম খরচে একটি প্রাকৃতিক জাদুঘরে অবিকল পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে পারবেন। সত্যিকার পরিবেশে হুবুহু বণ্য প্রাণীকে দেখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী হবে এবং তারা প্রকৃতি সংরক্ষণে সহায়তা করবে। তা না করে প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আপনি নানা রকম আইন করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে, আগ্রহ না থাকলে সেসব আইন খুব একটা বাস্তবায়িত হবে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে এক বা একাধিক প্রাকৃতিক জাদুঘর থাকাটা খুবই জরুরি।
কালের কণ্ঠ: একেকটি প্রাণী-প্রতিরূপ তৈরিতে কেমন খরচ হয়? এ ধরনের জাদুঘর তৈরিই বা কতটা ব্যয়বহুল ব্যাপার?
মার্কো ফিশার: ব্যয়ের ব্যাপারটি একেক দেশে একেক রকম। আবার কত বেশি মানসম্পন্ন করে বানানো হবে, তার ওপরও নির্ভর করে খরচের ব্যাপারটি। এখানে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় শ্রমঘণ্টার ক্ষেত্রে। উপাদানের খরচ খুব বেশি নয়। যেমন ধরুন- একটি বেজির প্রতিরূপ তৈরি করতে যেসব উপাদান লাগবে, তার দাম হবে পাঁচ থেকে ছয় শ টাকার মতো। কিন্তু আপনি যদি যথেষ্ট মানসম্পন্ন করে বানাতে চান, তাহলে দেখা যাবে একজন অভিজ্ঞ লোকেরও কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। অভিজ্ঞ লোকটির কয়েক মাসের শ্রমের দাম জার্মানিতে অনেক বেশি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক কম হবে। আর জাদুঘর তৈরির খরচও নির্ভর করবে তার সামগ্রিক মানের ওপর। যেমন, আপনি যদি জেনেটিক ডাটাসহ প্রাণীর আচরণ প্রদর্শন করতে চান, তাহলে এক ধরনের খরচ হবে। আবার যদি কেবল নির্দিষ্ট পরিবেশে প্রাণীটিকে রাখতে চান, তাহলে আরেক ধরনের খরচ হবে। তবে তা অন্যান্য জাদুঘরের চেয়ে খুব একটা বেশি হবে না। বরং উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতা থাকলে অনেক কম খরচেই সেটি করা সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মার্কো ফিশার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments