কার্যতালিকার এক নম্বর কাজ by রণজিৎ বিশ্বাস
মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের আমি দুশমন বলি। জাতির দুশমন, দেশের দুশমন। শুনে এক সহকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হওয়ার পরও আমার সঙ্গে কড়ারে মাতলেন। আপনি তো ওদের মানবতার শত্রু কিংবা মুক্তিযুদ্ধের শত্রুও বলতে পারতেন। কিন্তু তা না বলে 'মুক্তিযুদ্ধের দুশমন' বললেন কেন?
আমি তাকে এমন বলার কারণ বললাম। দেখুন, এমনিতে নয়, চিন্তা করেই বললাম। সচেতনভাবেই বললাম। 'দুশমন' আমার মাতৃভাষার শব্দ না হলেও এটি 'শত্রু'র চেয়ে শক্ত ও জোরালো শব্দ। ভাষা ব্যবহারে শব্দের জোরের দিকে তাকাতে হয়। দুশমন ও দুশমনি শত্রু ও শত্রুতার চেয়ে, আমার মনে হয়, স্ট্রং শব্দ। তাই 'মুক্তিযুদ্ধের শত্রু'র পরিবর্তে 'মুক্তিযুদ্ধের দুশমন' ব্যবহার করলাম। 'রাজাকার' বলায় এক জোর, 'রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার' বলায় অন্য জোর, 'হারামি' বললে এক মাত্রা, 'হারামিকা আওলাদ' কিংবা 'হারামির বাচ্চা হারামি' বললে ভিন্ন মাত্রা।
মনে হলো, আমার যুক্তি তিনি একেকবারে ফেলনা মনে করলেন না। বললেন, ঠিক আছে। এবার মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-মিত্রের পার্থক্য বলুন।
বললাম, এই পার্থক্যটা অনেকেই জানতে চায় না। আপনি চাইলেন যখন এগজাম্পল দিয়ে বলি। কয়েকদিন আগে উত্তরের এক জেলায় সম্পন্ন লোকের অতি সুন্দর ও বিশালমনোহর এক বাড়ি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে খাবার নিয়ে হুড়োহুড়ির সময় এক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। এই ছবি যেন আমাদের বিশ্লেষণে বসায়_ একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি-কাড়াকাড়ি করতে হবে! কখন করতে হবে? সোজা উত্তর, করতে হবে তখন, যখন তিনি ঠিকমতো খেতে পারবেন না, যখন তার খাবারের অভাব ঘটবে। এখানেই পাওয়া গেল প্রথম পার্থক্য। এখানে খুঁটি গেড়েই আমরা পার্থক্যসরণি ধরে এগিয়ে যেতে পারি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের অভাব হয়, তারা হাভাতে হয়ে পড়ে, কখনও কখনও তণ্ডুলকণার জন্য_ তারা মোট বয়, রিকশা চালায়, ঠেলা ঠেলে, সবজি বেচে, ভিক্ষায়ও নামতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের এমন দুর্দশা হয় না। তারা একে অন্যকে টেনে তোলে। তারা একাট্টা থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষের মানুষ ও সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা একাট্টা থাকতে পারে না। তারা থাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম_ চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ আর দাঙ্গাবাজ-সন্ত্রাসীরা, মানুষ যেমনই হোক, একটা 'রুলস অব দ্য গেইম' ফলো করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা তেমন করে না।
এই পার্থক্য সন্ধানের ব্যাপারে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে হালের কিছু খবর পড়ে। সর্বশেষটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর। বিস্ফোরক, বোমা বানানোর উপকরণ ও এগুলোর চেয়েও ভয়ঙ্কর মানবতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাবিনাশক কিছু বইপত্র ও পোস্টার-লিফলেট নিয়ে আটক হয়েছে। আটক হয়েছে, আটক আরও হয়েছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারীরা অ্যারেস্ট হতেই পারে। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, অ্যারেস্ট হওয়ার পর এরা হাসাহাসি করে, হাতের মধ্যমা ও শাসনাঙ্গুলির ব্যবহারে 'ভিক্টরি-চিহ্ন' দেখায়। ভাবটা এই, 'আমরা করবো জয় আমরা করবো জয় একদিন।' পাহাড়তলীর ওরা স্বীকার করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টি করার জন্যই তারা গোপন বৈঠক করছিল।
এই চিত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষের লোকদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য নির্দেশ করছে। রাজাকার-আলবদররা আমাদের ছাত্র ও পুত্রের বয়সী তরুণদের ধৌতমস্তিষ্ক বানিয়ে ছাড়ে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা তাদের মাথার খোপ থেকে বর্জ্যভাবনা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সুবাসিত ও গৌরবদীপ্ত বার্তায় প্রণোদিত করার কাজটি যতদিন আমরা কার্যতালিকায় নাম্বার ওয়ান পজিশনে বসাতে ব্যর্থ হচ্ছি, বুঝতে হবে ততদিন আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে কষ্টে আছি। দেশের দুশমনদের মোকাবেলায় কাজটি যত শক্তই হোক এ কাজের সরণিতে আজই আমাদের 'ডে-ওয়ান'।
রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক
মনে হলো, আমার যুক্তি তিনি একেকবারে ফেলনা মনে করলেন না। বললেন, ঠিক আছে। এবার মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-মিত্রের পার্থক্য বলুন।
বললাম, এই পার্থক্যটা অনেকেই জানতে চায় না। আপনি চাইলেন যখন এগজাম্পল দিয়ে বলি। কয়েকদিন আগে উত্তরের এক জেলায় সম্পন্ন লোকের অতি সুন্দর ও বিশালমনোহর এক বাড়ি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে খাবার নিয়ে হুড়োহুড়ির সময় এক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। এই ছবি যেন আমাদের বিশ্লেষণে বসায়_ একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি-কাড়াকাড়ি করতে হবে! কখন করতে হবে? সোজা উত্তর, করতে হবে তখন, যখন তিনি ঠিকমতো খেতে পারবেন না, যখন তার খাবারের অভাব ঘটবে। এখানেই পাওয়া গেল প্রথম পার্থক্য। এখানে খুঁটি গেড়েই আমরা পার্থক্যসরণি ধরে এগিয়ে যেতে পারি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের অভাব হয়, তারা হাভাতে হয়ে পড়ে, কখনও কখনও তণ্ডুলকণার জন্য_ তারা মোট বয়, রিকশা চালায়, ঠেলা ঠেলে, সবজি বেচে, ভিক্ষায়ও নামতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের এমন দুর্দশা হয় না। তারা একে অন্যকে টেনে তোলে। তারা একাট্টা থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষের মানুষ ও সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা একাট্টা থাকতে পারে না। তারা থাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম_ চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ আর দাঙ্গাবাজ-সন্ত্রাসীরা, মানুষ যেমনই হোক, একটা 'রুলস অব দ্য গেইম' ফলো করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা তেমন করে না।
এই পার্থক্য সন্ধানের ব্যাপারে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে হালের কিছু খবর পড়ে। সর্বশেষটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর। বিস্ফোরক, বোমা বানানোর উপকরণ ও এগুলোর চেয়েও ভয়ঙ্কর মানবতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাবিনাশক কিছু বইপত্র ও পোস্টার-লিফলেট নিয়ে আটক হয়েছে। আটক হয়েছে, আটক আরও হয়েছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারীরা অ্যারেস্ট হতেই পারে। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, অ্যারেস্ট হওয়ার পর এরা হাসাহাসি করে, হাতের মধ্যমা ও শাসনাঙ্গুলির ব্যবহারে 'ভিক্টরি-চিহ্ন' দেখায়। ভাবটা এই, 'আমরা করবো জয় আমরা করবো জয় একদিন।' পাহাড়তলীর ওরা স্বীকার করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টি করার জন্যই তারা গোপন বৈঠক করছিল।
এই চিত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষের লোকদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য নির্দেশ করছে। রাজাকার-আলবদররা আমাদের ছাত্র ও পুত্রের বয়সী তরুণদের ধৌতমস্তিষ্ক বানিয়ে ছাড়ে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা তাদের মাথার খোপ থেকে বর্জ্যভাবনা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সুবাসিত ও গৌরবদীপ্ত বার্তায় প্রণোদিত করার কাজটি যতদিন আমরা কার্যতালিকায় নাম্বার ওয়ান পজিশনে বসাতে ব্যর্থ হচ্ছি, বুঝতে হবে ততদিন আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে কষ্টে আছি। দেশের দুশমনদের মোকাবেলায় কাজটি যত শক্তই হোক এ কাজের সরণিতে আজই আমাদের 'ডে-ওয়ান'।
রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক
No comments