‘কোপা ওসি’ এবং মুলোর গল্প by মাহবুব মিঠু
কাদেরকে কোপানো ‘কোপা ওসি’ হেলাল উদ্দিনকে জেল হাজতে পাঠাতে দেখে অল্পেতুষ্ট অনেক বাংলাদেশি আনন্দে গদগদ। সাদা চোখে নিরীহ জনগণ ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুলোর ঝাঁঝ একটুও টের পেল না। যে দেশে প্রতিদিন অগণিত অপরাধ সংঘটিত হয় আইন-শৃংখলা বাহিনী হাতে, সেখানে এক ওসিকে জেলে পুরলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ কতোটুকু এগুবে কে জানে!
তবুও মরুভূমির ভেতরে ছুটে চলার সময় এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও অনেক স্বস্তি দেয়। এইতো সেদিন আবারো ক্রসফায়ারের গল্প ফেঁদে ছয় জনকে হত্যা করল র্যাব। কে জানে তারা অপরাধী ছিল কিনা! অপরাধী হলেও র্যাবকে কি রাষ্ট্র বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা দিয়েছে বিচার করার? একটা ছিনতাইয়ের শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড? এ সকল অসংখ্য ঘটনা প্রশমনে বিচার বিভাগের ভূমিকাই বা কতোটুকু? প্রশ্ন অগণিত। কিন্তু জবাব নেই একটারও।
আসলে ‘কোপা ওসি’ যে কাজটি করেছিল, সেটা ছিল ‘ভুল সময়ে’ করা অসংখ্য অপরাধের একটি মাত্র। এ কারণে সে ফেঁসে গেছে। এর চেয়ে কম বা বেশি জঘন্য কাজ নিত্যদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে। ভুল সময়ে করা অপরাধের মাশুল দিচ্ছে এখন সেই ওসি।
‘কোপা ওসিদের’ উদ্ভবের পেছনে যে কারণগুলো থাকে, সেগুলো নিরসনে বিচারপতিদের কোনো উদ্যোগ নেই। সেটা করলে কান টানলে মাথা আসার মতো নিজেরাও ফেঁসে যাবেন। অন্যতম কারণের মধ্যে একটা হচ্ছে— বিচার বিভাগে সীমাহীন দুর্নীতির ফলে অপরাধীদের ছাড়া পাওয়া।
অন্য কারণের মধ্যে ‘কোপা ওসিকে’ বলির পাঁঠা বানিয়ে ধসে পড়া পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি কিছুটা বাঁচানোর চেষ্টা। এতো সব হিসাব বিজ্ঞানের মারম্যাচে পড়ে ‘কোপা ওসি’ শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে কিনা, নাকি সিস্টেমকে সিস্টেম করে বেঁচে যাবে, সেটা দেখতে হলে আমাদের দীর্ঘসূত্রতার কেঁচিকলে আটকানো বিচার বিভাগের রায় পেতে অনন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর মাঝে যথারীতি চলতে থাকবে নতুন ‘কোপা ওসিদের’ নতুন নতুন উৎপাত। র্যাব কর্তৃক নরসিংদীতে ছয় ব্যক্তির খুনের ঘটনা সেটার বড় প্রমাণ। মাঝখানে ওই যে বলছিলাম আমাদের অল্পেতুষ্ট জনগণের কথা! তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলবে, ভাগ্যিস আমাদের বিচার বিভাগের নজরে পড়েনি। নজরে এলে ঠিকই একটা কিছু হতো!
যাই হোক, মুলোর কথা মনে হলেই আমার নানীর কথা মনে পড়ে। নানী মারা গেছেন বহু বছর আগে। আল্লাহ তার বেহেশত নসীব করুন। নানী একটা মুলোর গল্প প্রায়ই বলতেন। বারবার একই গল্প। তবুও ভালো লাগতো। নানীর কোলে মাথা রেখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। গল্পটা ছিলো এরকম—
ছেলেটির নাম মুলো। খুব ছোটবেলায় সে মা-বাবা হারায়। এর ক্ষেতের, ওর ক্ষেতের মুলো খেয়ে তার জীবন চলতো। এভাবেই এক সময় তার নাম মুলো হয়ে যায়। কিন্তু পরের ক্ষেতের মুলো খেয়ে কতোদিন চলে? একদিন সে ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ শব্দে জেগে উঠে দেখে, কে একজন তাকে বলছে, এই মুলোর বিচিটা রাখ। মাটিতে পুঁতলেই হাজারো মুলোর গাছ হয়ে ক্ষেত ভরে যাবে। তুই নিজে খাবি এবং তোর মতো অনাহারীদের খেতে দিবি।
এই হচ্ছে গল্পের সার কথা। মুলোর গল্পটা ভাল লাগার একটা কারণ থাকতে পারে। আমার জীবনের সাথে মুলোর জীবনের কিছুটা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। সততার পুরস্কার হিসেবে সচ্ছলতা ছিল না তার সংসারে। অনেক পিতার মতো তিনি সন্তানদের তেমন কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন না। এজন্য বাবার প্রতি আমার অনেক রাগও ছিল।
কিন্তু যতোই বুঝতে শুরু করলাম, ততোই দেখলাম সেই অভিমান বা রাগের স্থানে ধীরে ধীরে কেমন যেন গাঢ় একটা ভালবাসা, শ্রদ্ধা এসে তিলতিল করে জমা হচ্ছে। বয়সের মধ্যখানে এসে আজ টের পাই বুকের মধ্যিখানে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা মেশানো একটা মায়াবী রঙ। এটা আমার বাবার জন্য। যেটা তৈরি হয়েছে তার সততার কারণে।
দ্বিতীয় মুলোর গল্প
গাধাকে মুলো দেখিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কথা কে না জানে! চতুর গাধার মালিকের ধান্দাই ছিলো গাধাকে না খাইয়ে শুধুই তার কাছ থেকে পরিশ্রম আদায় করে নেওয়া। লাঠির আগায় মুলো ঝুলিয়ে ধূর্ত মালিক গাধাকে লোভ দেখিয়ে মাল টানতে বাধ্য করতো। পথ শেষ হলে গাধার কষ্টটাই সার! মুলোটা মালিক তার গিন্নীকে দিয়ে বলতো, আজ মুলোর তরকারিটা ঝোলঝোল করে রেঁধো কিন্তু! পারলে একটু কাচা লংকা ছেঁচে দিও। গাধা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো।
সে রকমই মুলোর স্বাদ প্রতিদিনই পেয়ে যাচ্ছে আমাদের আমজনতা। তবে তারা গাধা নয়, তারা অসহায়। তাই বুঝেও সহ্য করতে হয় সব কিছু।
এ রকমই আরেকটা মুলোর গল্প বলছি। আমার এক বন্ধুর মুখে শোনা। সে একটা বিদেশি সেবাসংস্থায় কাজ করত, মাঠ পর্যায়ে। হেড অফিসের মতো তেল চকচকে ভাবটা নেই। চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির তত্ত্বের মতো তেমন রসও চুঁইয়ে পড়েনি। রস খেয়ে রসালো হতে কে না চায়। তাই কিছুটা রস পাবার আশায় মুলোর বাহানা।
গ্রামের অনেক লোক প্রতিদিনই অফিসে আসত সেবা নিতে। তাদের স্বাচ্ছন্দের কথা বলে এসি আমদানি করা হয়। কিন্তু যাদের কথা বলে আনা হয়েছিলো, তাদের জন্য এলো হেড অফিসের পুরানো এসিগুলো। গ্রামের লোকদের নামে বরাদ্দকৃত টাকায় কেনা চকচকে নতুন এসিগুলো বসল বসের রুমে। পুরানো রদ্দি মালের যে অবস্থা হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলো না। দুদিন যেতেই শেষ। এরপরে না কোনো সার্ভিসিং, না সেগুলো ঠিক করা। বসের অফিসে লাগানো নতুন চকচকে এসিগুলো ঠিকই চলছে। জানি, নষ্ট হলে সেগুলো ঠিকও হবে।
তো, মুলোটা কোথায়? ওই যে গ্রামের লোক, যাদের কথা বলেই না এসব প্রাপ্তিযোগ!
তৃতীয় মুলোর গল্প
বিএনপি সরকারের আমল। পুলিশের সেবা নিয়ে কথা উঠলো এবং সেই সাথে ওঠানোও হলো। কারণ এখানে যে ব্যবসা জড়িয়ে আছে! ঔপনিবেশিক আমলের খাকি পোশাকের মধ্যে নাকি সব দোষে দুষ্ট ভূতটা লুকিয়ে থাকে। ভূত তাড়াতে হলে পোশাক পাল্টাতে হবে। যেমন গ্রামে ভূত তাড়াতে বট গাছ বা তাল গাছ কেটে ফেলা হয়। অনেকটা সে রকম কনসেপ্ট। পোশাক পাল্টালেই নাকি পুলিশ জনগণের সেবক হয়ে উঠবে। খাকি পোশাক ছেড়ে আমাদের পুলিশ রঙিলা পোশাক পড়ে বেশ স্মার্ট হলো। পাশাপাশি নেতাদের অথবা নেতাদের ঘনিষ্টজনদের কাপড় ব্যবসাও রাতারাতি বাম্পার। কিন্তু পোশাকের মুলোটা যাদের নাম করে ঝোলানো হয়েছিলো সেই জনগণের কি দশা? ক্রসফায়ারের অভিজ্ঞতা এবং প্রতিদিন রাস্তাঘাটে নাস্তানাবুদ হয়ে সেটা সকলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
চতুর্থ মুলোর গল্প
জনগণকে মুলো দেখিয়ে আবারো বেশ কয়েকবার পুলিশের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলো। দ্বিতীয় শ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। বেতন ভাতাও বাড়ানো হয়েছে অনেক। কিন্তু ফলাফলটা কি? পোশাক পাল্টানোতে কিংবা পুলিশের পদোন্নতিতে জনগণের কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু যে যুক্তিতে কাজগুলো করা হলো, সমাজে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর ইতিবাচক প্রভাব কতোটুকু? বরঞ্চ যাদের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ পোশাক পাল্টে স্মার্ট হলো, বেতন বাড়িয়ে পকেট ফোলালো, ছোট স্যার থেকে বড় স্যার হলো, সেই জনগণের ভোগান্তি বাড়া ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা জানা নেই। যেখানে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে স্যার ডেকে জনগণকে অস্থির থাকতে হয়, সেখানে প্রথম শ্রেণী পাওয়া মাঠ পর্যায়ের এই অফিসারদের আচরণ কেমন হবে না বললেও বোঝা যায়!
সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার এই চল্লিশ বছর পরেও পুলিশ কখনো আমাদের বন্ধু হতে পারল না। বিরোধী দলের আন্দোলনে দেখলাম, একজন বিক্ষোভকারীকে পুলিশ পেটাতে পেটাতে ন্যাংটো করে ফেলেছে। সীমান্তে সেই হাবিবের সাথে ওই লোকটা কিংবা বিএসএফের সাথে আমাদের পুলিশের পার্থক্য কতোটুকু?
প্রতিবারই সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু পুলিশের চরিত্র ঠিকই থাকে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে দিবাস্বপ্নে ভাসিয়ে সেই ফাঁকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। জনগণকে মুলো দেখিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের কৌশল বেশ পুরানো হলেও প্রতিবারই আমরা নতুন করে বিভ্রান্ত হই। আমার নানীর মুলোর গল্পটা ছিল ইতিবাচক। কিন্তু ওটা গল্প। বাস্তবের মুলোর গল্পগুলো খুবই নির্মম এবং গণবিরোধী।
কাদেরকে কোপানো কিংবা গুলিতে প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলো কিন্তু জনমনে অশান্তি বা আতংক সৃষ্টির কারণ নয়। এগুলো হলো দেশে বিদ্যমান কিছু ক্রনিক সমস্যার ফলাফল। সমস্যার কারণে হাত না দিয়ে ফলাফল নিয়ে লাফালাফি করলে আপাত স্বস্তি পাওয়া গেলেও বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হবে। সমাজের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায়বিচারের সংকট, এই মূল কারণগুলোতে হাত না দিলে পুরানো ‘কোপা ওসিদের’ কেউ কেউ কেঁচিকলে পড়ে দণ্ডিত হলেও, নতুন নতুন ‘কোপা ওসিরা’ নতুন উদ্যমে কাদেরদের নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
শুরুটা করতে হবে সকল স্থান থেকে। শুধু পুলিশকে সাধু বানানোর পণ করে সমাজের আর সবাইকে তস্কর বানিয়ে রাখার সংকল্প ঠিক নয়। সেটা সম্ভবও নয়। যে কোনো অফিসে গেলে ঘুষ ছাড়া কাজ সমাধান করতে পারা একটা অসম্ভব ব্যাপার। মানুষের বিচার পাবার স্থান সেই আদালতও অনেকাংশে দুর্নীতিগ্রস্ত। সবাই চায় রাতারাতি বড় লোক হতে।
বাংলাদেশের মতো একটা দরিদ্র দেশে সৎ থাকতে চাইলে হয়তো আরাম আয়েশটা মেলে না। সবাই সৎ থেকে দেশটাকে একবার গড়তে পারলে আরাম আয়েশ সবার কাছে এমনিতেই লুটোপুটি খাবে। একা ভালো থাকতে গিয়ে দেশটাকেই পিছিয়ে দিচ্ছি আমরা বারবার। খুব সহজ করে বলে দেওয়া যায়, দেশপ্রেম থাকতে হবে সৎ হতে হলে। যে চরমভাবে অসৎ সেও এটা বলবে এবং বলছে।
লোভাতুর মানুষকে পরিবর্তন করতে হলে একটা কার্যকরী ধাক্কা প্রয়োজন। সেই ধাক্কাটা যতো বেশি কাছের লোকের কাছ থেকে হবে ততো বেশি সেটা কার্যকরী। পরিবারের যে কেউ হোক না কেন, যে কোনো পেশায় থাকুক না কেন, সৎ পরিবারের সদস্যদের জন্য গর্ব করা নয় কেন? বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে সেটা কেন বলব না? কিন্তু সমস্যা হলো, সত বাবার সন্তানেরা গর্ব করে সেটাও বলতে পারে না। কারণ তার গায়ের জামাটা বড়ই সেকেলে, অল্প দামের। বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে চিকেন বার্গার খেতে যেতে পারে না। তার বন্ধুও কম। সেই তো থাকে মুখ লুকিয়ে। সততা যেখানে মুখ লুকাবে, অসৎ লোকের অট্টহাসি ততোই ছড়িয়ে পড়বে।
অন্যদিকে, সম্পর্কে বাবা, ছেলে, মা, বোন, স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান যেই হোক না কেন, সে যদি অসৎ হয়, তার কাজ যদি গণবিরোধী হয়, তবে তাকে ঘৃণা নয় কেন?
লেখাটা কি দিয়ে শেষ করবো ভাবতে ভাবতে একটা গান মনে পড়ে গেল। ‘মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, হঠাৎ কোনো রাতে। মাঝে মাঝে গল্প বলি, নিজেই নিজের সাথে।’ মুলো দেখা জনগণ রাতদিন প্রতিনিয়ত জীবন বদলানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কাজ শেষে মুলো ঝোলানো ব্যক্তির গিন্নীর হাতে রান্না মুলোর স্বাদটা চেখে দেখার সৌভাগ্য কারো হয়নি।
তাই সমাজ পরিবর্তনের গল্পটা নিজের সাথে নয়, বাকিদের সাথে ভাগাভাগি করে বলতে হবে। পরিবারের সৎ সদস্যদের নিয়ে গর্ব করা গল্পগুলো বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে বলতে শিখতে হবে। দামি জামা পরতে মানা করছি না, চিকেন বার্গারও খাওয়া যাবে। কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেই টাকাটার উৎস যেন সৎ রোজগার থেকে আসে।
mahalom72@yahoo.com
আসলে ‘কোপা ওসি’ যে কাজটি করেছিল, সেটা ছিল ‘ভুল সময়ে’ করা অসংখ্য অপরাধের একটি মাত্র। এ কারণে সে ফেঁসে গেছে। এর চেয়ে কম বা বেশি জঘন্য কাজ নিত্যদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে। ভুল সময়ে করা অপরাধের মাশুল দিচ্ছে এখন সেই ওসি।
‘কোপা ওসিদের’ উদ্ভবের পেছনে যে কারণগুলো থাকে, সেগুলো নিরসনে বিচারপতিদের কোনো উদ্যোগ নেই। সেটা করলে কান টানলে মাথা আসার মতো নিজেরাও ফেঁসে যাবেন। অন্যতম কারণের মধ্যে একটা হচ্ছে— বিচার বিভাগে সীমাহীন দুর্নীতির ফলে অপরাধীদের ছাড়া পাওয়া।
অন্য কারণের মধ্যে ‘কোপা ওসিকে’ বলির পাঁঠা বানিয়ে ধসে পড়া পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি কিছুটা বাঁচানোর চেষ্টা। এতো সব হিসাব বিজ্ঞানের মারম্যাচে পড়ে ‘কোপা ওসি’ শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে কিনা, নাকি সিস্টেমকে সিস্টেম করে বেঁচে যাবে, সেটা দেখতে হলে আমাদের দীর্ঘসূত্রতার কেঁচিকলে আটকানো বিচার বিভাগের রায় পেতে অনন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর মাঝে যথারীতি চলতে থাকবে নতুন ‘কোপা ওসিদের’ নতুন নতুন উৎপাত। র্যাব কর্তৃক নরসিংদীতে ছয় ব্যক্তির খুনের ঘটনা সেটার বড় প্রমাণ। মাঝখানে ওই যে বলছিলাম আমাদের অল্পেতুষ্ট জনগণের কথা! তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলবে, ভাগ্যিস আমাদের বিচার বিভাগের নজরে পড়েনি। নজরে এলে ঠিকই একটা কিছু হতো!
যাই হোক, মুলোর কথা মনে হলেই আমার নানীর কথা মনে পড়ে। নানী মারা গেছেন বহু বছর আগে। আল্লাহ তার বেহেশত নসীব করুন। নানী একটা মুলোর গল্প প্রায়ই বলতেন। বারবার একই গল্প। তবুও ভালো লাগতো। নানীর কোলে মাথা রেখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। গল্পটা ছিলো এরকম—
ছেলেটির নাম মুলো। খুব ছোটবেলায় সে মা-বাবা হারায়। এর ক্ষেতের, ওর ক্ষেতের মুলো খেয়ে তার জীবন চলতো। এভাবেই এক সময় তার নাম মুলো হয়ে যায়। কিন্তু পরের ক্ষেতের মুলো খেয়ে কতোদিন চলে? একদিন সে ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ শব্দে জেগে উঠে দেখে, কে একজন তাকে বলছে, এই মুলোর বিচিটা রাখ। মাটিতে পুঁতলেই হাজারো মুলোর গাছ হয়ে ক্ষেত ভরে যাবে। তুই নিজে খাবি এবং তোর মতো অনাহারীদের খেতে দিবি।
এই হচ্ছে গল্পের সার কথা। মুলোর গল্পটা ভাল লাগার একটা কারণ থাকতে পারে। আমার জীবনের সাথে মুলোর জীবনের কিছুটা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। সততার পুরস্কার হিসেবে সচ্ছলতা ছিল না তার সংসারে। অনেক পিতার মতো তিনি সন্তানদের তেমন কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন না। এজন্য বাবার প্রতি আমার অনেক রাগও ছিল।
কিন্তু যতোই বুঝতে শুরু করলাম, ততোই দেখলাম সেই অভিমান বা রাগের স্থানে ধীরে ধীরে কেমন যেন গাঢ় একটা ভালবাসা, শ্রদ্ধা এসে তিলতিল করে জমা হচ্ছে। বয়সের মধ্যখানে এসে আজ টের পাই বুকের মধ্যিখানে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা মেশানো একটা মায়াবী রঙ। এটা আমার বাবার জন্য। যেটা তৈরি হয়েছে তার সততার কারণে।
দ্বিতীয় মুলোর গল্প
গাধাকে মুলো দেখিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কথা কে না জানে! চতুর গাধার মালিকের ধান্দাই ছিলো গাধাকে না খাইয়ে শুধুই তার কাছ থেকে পরিশ্রম আদায় করে নেওয়া। লাঠির আগায় মুলো ঝুলিয়ে ধূর্ত মালিক গাধাকে লোভ দেখিয়ে মাল টানতে বাধ্য করতো। পথ শেষ হলে গাধার কষ্টটাই সার! মুলোটা মালিক তার গিন্নীকে দিয়ে বলতো, আজ মুলোর তরকারিটা ঝোলঝোল করে রেঁধো কিন্তু! পারলে একটু কাচা লংকা ছেঁচে দিও। গাধা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো।
সে রকমই মুলোর স্বাদ প্রতিদিনই পেয়ে যাচ্ছে আমাদের আমজনতা। তবে তারা গাধা নয়, তারা অসহায়। তাই বুঝেও সহ্য করতে হয় সব কিছু।
এ রকমই আরেকটা মুলোর গল্প বলছি। আমার এক বন্ধুর মুখে শোনা। সে একটা বিদেশি সেবাসংস্থায় কাজ করত, মাঠ পর্যায়ে। হেড অফিসের মতো তেল চকচকে ভাবটা নেই। চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির তত্ত্বের মতো তেমন রসও চুঁইয়ে পড়েনি। রস খেয়ে রসালো হতে কে না চায়। তাই কিছুটা রস পাবার আশায় মুলোর বাহানা।
গ্রামের অনেক লোক প্রতিদিনই অফিসে আসত সেবা নিতে। তাদের স্বাচ্ছন্দের কথা বলে এসি আমদানি করা হয়। কিন্তু যাদের কথা বলে আনা হয়েছিলো, তাদের জন্য এলো হেড অফিসের পুরানো এসিগুলো। গ্রামের লোকদের নামে বরাদ্দকৃত টাকায় কেনা চকচকে নতুন এসিগুলো বসল বসের রুমে। পুরানো রদ্দি মালের যে অবস্থা হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলো না। দুদিন যেতেই শেষ। এরপরে না কোনো সার্ভিসিং, না সেগুলো ঠিক করা। বসের অফিসে লাগানো নতুন চকচকে এসিগুলো ঠিকই চলছে। জানি, নষ্ট হলে সেগুলো ঠিকও হবে।
তো, মুলোটা কোথায়? ওই যে গ্রামের লোক, যাদের কথা বলেই না এসব প্রাপ্তিযোগ!
তৃতীয় মুলোর গল্প
বিএনপি সরকারের আমল। পুলিশের সেবা নিয়ে কথা উঠলো এবং সেই সাথে ওঠানোও হলো। কারণ এখানে যে ব্যবসা জড়িয়ে আছে! ঔপনিবেশিক আমলের খাকি পোশাকের মধ্যে নাকি সব দোষে দুষ্ট ভূতটা লুকিয়ে থাকে। ভূত তাড়াতে হলে পোশাক পাল্টাতে হবে। যেমন গ্রামে ভূত তাড়াতে বট গাছ বা তাল গাছ কেটে ফেলা হয়। অনেকটা সে রকম কনসেপ্ট। পোশাক পাল্টালেই নাকি পুলিশ জনগণের সেবক হয়ে উঠবে। খাকি পোশাক ছেড়ে আমাদের পুলিশ রঙিলা পোশাক পড়ে বেশ স্মার্ট হলো। পাশাপাশি নেতাদের অথবা নেতাদের ঘনিষ্টজনদের কাপড় ব্যবসাও রাতারাতি বাম্পার। কিন্তু পোশাকের মুলোটা যাদের নাম করে ঝোলানো হয়েছিলো সেই জনগণের কি দশা? ক্রসফায়ারের অভিজ্ঞতা এবং প্রতিদিন রাস্তাঘাটে নাস্তানাবুদ হয়ে সেটা সকলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
চতুর্থ মুলোর গল্প
জনগণকে মুলো দেখিয়ে আবারো বেশ কয়েকবার পুলিশের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলো। দ্বিতীয় শ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। বেতন ভাতাও বাড়ানো হয়েছে অনেক। কিন্তু ফলাফলটা কি? পোশাক পাল্টানোতে কিংবা পুলিশের পদোন্নতিতে জনগণের কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু যে যুক্তিতে কাজগুলো করা হলো, সমাজে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর ইতিবাচক প্রভাব কতোটুকু? বরঞ্চ যাদের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ পোশাক পাল্টে স্মার্ট হলো, বেতন বাড়িয়ে পকেট ফোলালো, ছোট স্যার থেকে বড় স্যার হলো, সেই জনগণের ভোগান্তি বাড়া ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা জানা নেই। যেখানে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে স্যার ডেকে জনগণকে অস্থির থাকতে হয়, সেখানে প্রথম শ্রেণী পাওয়া মাঠ পর্যায়ের এই অফিসারদের আচরণ কেমন হবে না বললেও বোঝা যায়!
সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার এই চল্লিশ বছর পরেও পুলিশ কখনো আমাদের বন্ধু হতে পারল না। বিরোধী দলের আন্দোলনে দেখলাম, একজন বিক্ষোভকারীকে পুলিশ পেটাতে পেটাতে ন্যাংটো করে ফেলেছে। সীমান্তে সেই হাবিবের সাথে ওই লোকটা কিংবা বিএসএফের সাথে আমাদের পুলিশের পার্থক্য কতোটুকু?
প্রতিবারই সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু পুলিশের চরিত্র ঠিকই থাকে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে দিবাস্বপ্নে ভাসিয়ে সেই ফাঁকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। জনগণকে মুলো দেখিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের কৌশল বেশ পুরানো হলেও প্রতিবারই আমরা নতুন করে বিভ্রান্ত হই। আমার নানীর মুলোর গল্পটা ছিল ইতিবাচক। কিন্তু ওটা গল্প। বাস্তবের মুলোর গল্পগুলো খুবই নির্মম এবং গণবিরোধী।
কাদেরকে কোপানো কিংবা গুলিতে প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলো কিন্তু জনমনে অশান্তি বা আতংক সৃষ্টির কারণ নয়। এগুলো হলো দেশে বিদ্যমান কিছু ক্রনিক সমস্যার ফলাফল। সমস্যার কারণে হাত না দিয়ে ফলাফল নিয়ে লাফালাফি করলে আপাত স্বস্তি পাওয়া গেলেও বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হবে। সমাজের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায়বিচারের সংকট, এই মূল কারণগুলোতে হাত না দিলে পুরানো ‘কোপা ওসিদের’ কেউ কেউ কেঁচিকলে পড়ে দণ্ডিত হলেও, নতুন নতুন ‘কোপা ওসিরা’ নতুন উদ্যমে কাদেরদের নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
শুরুটা করতে হবে সকল স্থান থেকে। শুধু পুলিশকে সাধু বানানোর পণ করে সমাজের আর সবাইকে তস্কর বানিয়ে রাখার সংকল্প ঠিক নয়। সেটা সম্ভবও নয়। যে কোনো অফিসে গেলে ঘুষ ছাড়া কাজ সমাধান করতে পারা একটা অসম্ভব ব্যাপার। মানুষের বিচার পাবার স্থান সেই আদালতও অনেকাংশে দুর্নীতিগ্রস্ত। সবাই চায় রাতারাতি বড় লোক হতে।
বাংলাদেশের মতো একটা দরিদ্র দেশে সৎ থাকতে চাইলে হয়তো আরাম আয়েশটা মেলে না। সবাই সৎ থেকে দেশটাকে একবার গড়তে পারলে আরাম আয়েশ সবার কাছে এমনিতেই লুটোপুটি খাবে। একা ভালো থাকতে গিয়ে দেশটাকেই পিছিয়ে দিচ্ছি আমরা বারবার। খুব সহজ করে বলে দেওয়া যায়, দেশপ্রেম থাকতে হবে সৎ হতে হলে। যে চরমভাবে অসৎ সেও এটা বলবে এবং বলছে।
লোভাতুর মানুষকে পরিবর্তন করতে হলে একটা কার্যকরী ধাক্কা প্রয়োজন। সেই ধাক্কাটা যতো বেশি কাছের লোকের কাছ থেকে হবে ততো বেশি সেটা কার্যকরী। পরিবারের যে কেউ হোক না কেন, যে কোনো পেশায় থাকুক না কেন, সৎ পরিবারের সদস্যদের জন্য গর্ব করা নয় কেন? বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে সেটা কেন বলব না? কিন্তু সমস্যা হলো, সত বাবার সন্তানেরা গর্ব করে সেটাও বলতে পারে না। কারণ তার গায়ের জামাটা বড়ই সেকেলে, অল্প দামের। বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে চিকেন বার্গার খেতে যেতে পারে না। তার বন্ধুও কম। সেই তো থাকে মুখ লুকিয়ে। সততা যেখানে মুখ লুকাবে, অসৎ লোকের অট্টহাসি ততোই ছড়িয়ে পড়বে।
অন্যদিকে, সম্পর্কে বাবা, ছেলে, মা, বোন, স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান যেই হোক না কেন, সে যদি অসৎ হয়, তার কাজ যদি গণবিরোধী হয়, তবে তাকে ঘৃণা নয় কেন?
লেখাটা কি দিয়ে শেষ করবো ভাবতে ভাবতে একটা গান মনে পড়ে গেল। ‘মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, হঠাৎ কোনো রাতে। মাঝে মাঝে গল্প বলি, নিজেই নিজের সাথে।’ মুলো দেখা জনগণ রাতদিন প্রতিনিয়ত জীবন বদলানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কাজ শেষে মুলো ঝোলানো ব্যক্তির গিন্নীর হাতে রান্না মুলোর স্বাদটা চেখে দেখার সৌভাগ্য কারো হয়নি।
তাই সমাজ পরিবর্তনের গল্পটা নিজের সাথে নয়, বাকিদের সাথে ভাগাভাগি করে বলতে হবে। পরিবারের সৎ সদস্যদের নিয়ে গর্ব করা গল্পগুলো বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে বলতে শিখতে হবে। দামি জামা পরতে মানা করছি না, চিকেন বার্গারও খাওয়া যাবে। কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেই টাকাটার উৎস যেন সৎ রোজগার থেকে আসে।
mahalom72@yahoo.com
No comments