মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ও শরিয়াহ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সারাদেশে চলছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা। এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসা মূলত পরিবেশকদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে আমাদের দেশের দরিদ্র ও বেকারদের অনেকেই জড়িয়েছে এমএলএম ব্যবসায়।


যেহেতু এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, সেহেতু তাদের অন্তরে একটি সংশয় রয়েই যাচ্ছে যে, এ ব্যবসাটি শরিয়তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না? ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মতে এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসার মধ্যে শরিয়ত নিষিদ্ধ বহু বিষয় বিদ্যমান। যেমন_ শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম, একটি ব্যবসার চুক্তির জন্য আরেকটিকে শর্ত করা, মাল অর্জিত হওয়া না হওয়ার অনিশ্চয়তা, সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ, জুয়ার সাদৃশ্য, অবৈধ পন্থায় মানুষের সম্পদ ভক্ষণ, প্রতারণা ও ধোঁকা, বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রয় ইত্যাদি।
ফলে এমএলএম ব্যবসাকে সন্দেহের ঊধর্ে্ব বলা যাচ্ছে না। নিম্নে এমএলএম ব্যবসা শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি উলেল্গখ করা হলো। এমএলএম পদ্ধতি শরিয়তের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এতে 'শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম' রয়েছে, যা ইসলামী শরিয়ত কোনোভাবেই সমর্থন করে না। বিনিময়বিহীন শ্রমের বিষয়টি ফুটে ওঠে তাদের প্রচলিত নীতিতে। যেমন_ একজন পরিবেশকের ডান ও বাম উভয় দিকের নেট না চললে সে কমিশন পাবে না। অর্থাৎ কেউ যদি নির্ধারিত পয়েন্টের একজন ক্রেতা জোগাড় করে কিন্তু আরেকজন জোগাড় করতে অক্ষম হয়, তবে লোকটি কমিশন থেকে বঞ্চিত হবে। এমনিভাবে কেউ যদি দু'জন ক্রেতাও কোম্পানিকে এনে দেয়, তবে তারা কোম্পানির নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে কম পয়েন্টের মালপত্র ক্রয় করে, তবে এর জন্যও ওই ব্যক্তি কমিশন পায় না। ফলে এটি বিনিময়বিহীন শ্রমে পরিণত হয়, যা ইসলামী আইনে নিষিদ্ধ।
এ ব্যবসা বৈধ না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এতে হাদিসে নিষিদ্ধ 'একই চুক্তির জন্য আরেকটিকে শর্ত করা'র বিষয়টি রয়েছে। কারণ, এমএলএম পদ্ধতিতে পণ্য ক্রয়ের শর্তেই শুধু পরিবেশক হওয়া যায়। অর্থাৎ কোম্পানি থেকে পণ্য ক্রয় ছাড়া পরিবেশক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখানে পণ্য ক্রয়কে পরিবেশক হওয়ার জন্য শর্ত করা হচ্ছে, যা হাদিসে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'একই চুক্তির জন্য আরেকটিকে শর্ত করা হালাল নয়।'
ইসলামিক স্কলারদের সর্বসম্মতিক্রমে এ ধরনের লেনদেন অবৈধ। অবশ্য কোনো কোনো এমএলএম কোম্পানি উপরোক্ত শরয়ি সমস্যা এড়ানোর জন্য আলাদা আলাদা দুটি ফরমের ব্যবস্থা করেছে। একটি পণ্য ক্রয়ের অর্ডার ফরম, অন্যটি পরিবেশকদের আবেদন ফরম। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছে যে, এখানে পৃথক দুটি চুক্তি হচ্ছে। অথচ বাস্তবে একটি চুক্তির জন্য অন্যটি জরুরি। অর্থাৎ পণ্য ক্রয় ছাড়া পরিবেশক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া দুই ফরমবিশিষ্ট এ ধরনের কোম্পানির নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, 'আপনি কি জানেন যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ক্রয় ছাড়া এখানে পরিবেশক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই?'
এমএলএম ব্যবসা অবৈধ হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, তাতে হাদিসে নিষিদ্ধ 'বাইয়ে গারার' বা মাল অর্জন হওয়া না হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে। ইসলামী পণ্ডিতরা 'বাইয়ে গারার'র সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। আল্লামা কাসানী (রহ.) বলেন, 'গারার হচ্ছে এমন একটি অনিশ্চয়তা, যাতে হওয়া এবং না হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।' আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.) বলেন, 'বাইয়ে গারার ওই কারবারকে বলা হয় যাতে পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে কি-না তা অনিশ্চিত অথবা চুক্তিভুক্ত ব্যক্তি নিজে তা জোগান দিতে অক্ষম অথবা যার পরিণাম অজানা।' আবার কারও কারও মতে, বাইয়ে গারার হলো 'যে কোনো কারবারের চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা।' যেমন_ পুকুরে বা নদীতে মাছ কেনাবেচা, আকাশে উড়ন্ত পাখি বেচাকেনা ইত্যাদি। মোটকথা, যাতে মাল অর্জন হওয়া বা না হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে গারার। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ। বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির ব্যবসা পদ্ধতির দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় যে, সেখানে বহু ধরনের ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বা গারারের উপস্থিতি রয়েছে। একজন পরিবেশক যে চুক্তিতে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, লোকটি তার ডাউনলাইন থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে।
অথচ তার নিজের বানানো দু'জন ছাড়া অন্যদের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনিশ্চিত এবং অন্যের কাজের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, তার নিচের নেটগুলো সংশিল্গষ্ট ব্যক্তিরা অগ্রসর না করলে লোকটি কমিশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে; যে কমিশনকে কেন্দ্র করেই সে মূলত এই এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এমএলএম ব্যবসার সঙ্গে সুদের বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয় বরং সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় এ ব্যবসা নাজায়েজ। এর বাইরে এ ব্যবসা জুয়ার সাদৃশ্য, অবৈধভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ, প্রতারণা ও ধোঁকা এবং বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের বিষয়টি তো রয়েছেই। আর এসবই শরিয়তের নিষিদ্ধ। যে ব্যবসার সঙ্গে এসব থাকবে তাও নিষিদ্ধ।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.