শেকড়ের ডাক-একটি লেখা, একটি বই এবং কিছু প্রশ্ন by ফরহাদ মাহমুদ

দার্শনিক ভলতেয়ার এক ব্রাহ্মণের গল্প বলেছেন। সেই ব্রাহ্মণ আক্ষেপ করছিলেন যে তাঁর গত ৪০ বছরের অধ্যয়ন কেবলই ছিল সময়ের অপচয়। কারণ তিনি জানেন না, পদার্থের তৈরি মানুষের মধ্যে কিভাবে চিন্তার উদয় হয়, বোধশক্তিটা হাঁটাচলার মতো কোনো সহজ প্রক্রিয়া কি না। এসব ভেবে তাঁর মনের শান্তি বিনষ্ট হয়েছিল।


অথচ সেই ব্রাহ্মণের বাড়ির পাশেই থাকতেন এক বুড়ি। জগতের কোনো কিছুই তাঁকে ভাবিত বা পীড়িত করে না। শুধু একবার গঙ্গাস্নান করতে পারলেই তিনি নিজেকে মনে করবেন জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়েমানুষ। গল্পের নায়ক ব্রাহ্মণকে মৃদু তিরস্কার করে বললেন, 'এই বুড়িকে দেখেও কি তুমি কিছু শিখতে পারো না? অযথা বিচিত্র সব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে কেন তুমি মনের শান্তি নষ্ট করছ?' ব্রাহ্মণ অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমি নিজেও আমার মনকে বহুবার এ কথা বলেছি। কিন্তু আমার মন যে বুড়ির মতো সুখ পেতে চায় না।' সেই ব্রাহ্মণের মতো কিছু মানুষ সব সমাজে সবকালেই ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তারা ঘটনার সঙ্গে আপস করে নির্লিপ্ত সুখ চায় না, অসংখ্য প্রশ্নবাণে নিজেকে জর্জরিত করে। তারা নিজে আন্দোলিত হয়, অন্যকেও আন্দোলিত করে। সম্প্রতি একটি লেখা ও একটি বই পড়ে আমার সেই ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়েছে।
গত মঙ্গলবারের (৩ এপ্রিল ২০১২) কালের কণ্ঠে স্বনামধন্য সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম 'কালান্তরের কড়চা' পড়ছিলাম। বর্তমান পর্বের শিরোনাম ছিল, 'ইউনূস সাহেবকে সার্চ কমিটির প্রধানের পদে বসাতে হবে কেন?' লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় যতটা না ইউনূস সাহেব, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ।
লেখাটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি : 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্লজ্জ ও অবৈধ হস্তক্ষেপ কতটা বাড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে, তার প্রমাণ গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগের অনুসন্ধান কমিটিতে ড. ইউনূসকে চেয়ারম্যান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেবের এক ধরনের চাপ প্রদান।' সেই চাপের একটি কৌশল হিসেবে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটিও তিনি উড়িয়ে দেননি। তাঁর মতে, 'এটা এখন আর ড. ইউনূস বনাম বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপার নয়, এটা এখন একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশের ওপর বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ারের প্রভুত্বমূলক ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।' তিনি বলেছেন, 'এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদার কোনো অস্তিত্ব থাকে না।' ড. ইউনূস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, 'সরকার তাঁকে সম্মানজনকভাবে অবসর গ্রহণের এবং অবসর গ্রহণের পর ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিল।...ড. ইউনূস প্রস্তাবটি নাকচ করেন এবং সরকারের সঙ্গে অধিকতর কোনো আলোচনার পরিবর্তে নিজেই উচ্চ আদালতে মামলা করেন। সরকার মামলায় যায়নি।' অন্যত্র লিখেছেন, '...দেশের উচ্চ আদালতে মামলা করে হেরে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী এই ব্যক্তির যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের সম্মান রক্ষা করা উচিত ছিল, তিনি সেখানে তা না করে তাঁর বিদেশি বন্ধু ও অভিভাবকদের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্বে ফিরে আসার চেষ্টা করেছেন।' সরকার যদি এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে, তাহলে কী হবে? তিনি মনে করেন, সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে কোনো অন্যায় আচরণ করেছে কি না, সেটি দেশের মানুষই বিবেচনা করবে, এখানে সুপারপাওয়ারের হস্তক্ষেপ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
২. কিছুদিন ধরে একটি বই পড়ছি। বইটির নাম �Confession of an Economic Hit Man� বা একজন ইকোনমিক হিট ম্যানের স্বীকারোক্তি। বইটির লেখক জন পারকিন্স, যিনি নিজে একজন ইকোনমিক হিট ম্যান বা ইএইচএম হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। প্রকাশক বেরেট-কোয়েলার পাবলিশার্স, ২০০৪। ইএইচএমদের কাজকর্ম নিয়ে তিনি বেশ খোলামেলা আলোচনা করেছেন বইটিতে। অত্যন্ত উচ্চ বেতন ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত ইএইচএমদের রাষ্ট্র সরাসরি নিয়োগ দেয় না, তাদের নিয়োগ দেয় মার্কিন করপোরেট হাউসগুলো। পরে রাষ্ট্র নানা উপায়ে করপোরেট হাউসগুলোর সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। এর উদ্দেশ্য ইএইচএমরা বিদেশে কোনো খারাপ কাজ করলেও তার দায়দায়িত্ব মার্কিন সরকারকে বহন করতে হয় না। ইএইচএমদের প্রধান কাজ হলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ঠকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হাজার হাজার কোটি ডলার আয়ের পথ তৈরি করা। আর তা করতে গিয়ে এরা ব্যবহার করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএসএইড এবং অন্যান্য সাহায্য সংস্থার অর্থপ্রবাহকে। এরা প্রথমে চেষ্টা করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বেশি পরিমাণে ঋণ গেলাতে। ঋণের পরিমাণ যত বাড়বে, এই সব দেশের মেরুদণ্ডের জোর তত কমে আসবে। তখন এই সব দেশের সরকারগুলোকে যেভাবে বলা হবে, সেভাবেই তারা কাজ করতে বাধ্য হবে। তখন সেই সব দেশের তেল, গ্যাসসহ খনিজ সম্পদগুলোর মালিকানা অবাধে চলে আসবে মার্কিন বা তাদের ইউরোপীয় মিত্র কম্পানিগুলোর হাতে। সেসব দেশে কাজ করবে তাদের ঠিকাদারি কম্পানিগুলো। ক্রমান্বয়ে অস্ত্রের বড় বড় চালানও যাবে সেই সব দেশে ইত্যাদি।
অত্যন্ত মেধাবীদের মধ্য থেকেই ইকোনমিক হিট ম্যানদের বাছাই করা হয়। তার পরও কোনো দেশে পাঠানোর আগে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জন পারকিন্স তাঁর প্রশিক্ষণকালীন কিছু অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন। সেখানে তাঁকে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, 'তুমি নিঃশঙ্ক চিত্তে কাজ করে যাবে, ভয় পাওয়ার বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। তুমি মনে রাখবে, তুমি সেখানে একা নও। সিআইএর নিযুক্ত জ্যাকেল বা শিয়ালরা সর্বদা তোমাকে অনুসরণ করবে। তুমি যদি কোথাও ঠেকে যাও, তারা তোমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। তুমি তোমার পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে দেশগুলোর সরকারকে প্রভাবিত করবে, চাপ সৃষ্টি করবে। সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য সেসব দেশের সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও তোমাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। গণমাধ্যমের একটি প্রভাবশালী অংশও নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাবে। এনজিওগুলোও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।'
জন পারকিন্স ইরান, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে কাজ করলেও তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে পানামা ও ইকুয়েডরে। পানামার অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ওমর টরিজো সম্পর্কে র্তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও অনড় প্রকৃতির লোক। তিনি মার্কিন বহুজাতিক কম্পানিগুলোর স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে নানাভাবে বুঝিয়ে, চাপ সৃষ্টি করে, এমনকি হুমকি দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। ইএইচএমরা ব্যর্থ হলে দায়িত্ব নিয়েছিল জ্যাকেলরা। আর জ্যাকেলরা দায়িত্ব নিলে একটা অঘটন ঘটেই। তাই একদিন বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হলেন। পারকিন্স স্বীকার করেছেন, এটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মার্কিন স্বার্থের বিরোধিতা করতে গিয়ে এর মাত্র দুই মাস আগে একই পরিণতি বরণ করেছিলেন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট জেইম রোলডস। পারকিন্সের মতে, জ্যাকেলরাও যদি ব্যর্থ হয়, তখন সেসব দেশে আফগানিস্তান বা ইরাকের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ফলাফল কী হয়েছে? ইকুয়েডরে যে তেল উৎপাদিত হয়, তার ৭৫ শতাংশ নিয়ে নেয় উত্তোলনকারী কম্পানিগুলো। বাকি ২৫ শতাংশের তিন-চতুর্থাংশ দিয়ে দিতে হয় সুদসহ ঋণ পরিশোধের জন্য। এরপর সামরিক বাহিনী ও সরকারের ব্যয় বাদ দিয়ে মাত্র আড়াই শতাংশ থাকে জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য। ফলে প্রচুর তেল থাকার পরও দেশটির দারিদ্র্য কমেনি, বেকারত্ব কমেনি, মানুষের দুর্দশা কমেনি।
৩. দুই দশক আগে এক এনজিও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর এনজিও একটি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, তাতে সরকারের অনুমতি পাওয়া গেছে কি না। তিনি রেগে গিয়ে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বলেছিলেন, 'হু ইজ সরকার, আমরা কি সরকারকে বদার করি নাকি?' কথাগুলো এই মুহূর্তে বড় বেশি মনে পড়ছে। আসলেই তো, গরিব দেশের সরকারকে কে-ই বা 'বদার' করে? যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপারপাওয়ারের তো 'বদার' করার প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে জ্যাকেলদের দিয়ে সরকারই ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই দেশের মানুষ কি এগুলো অবলীলায় মেনে নেবে? দেশের নির্বাচিত সরকারই বা এত দুর্বল হয় কেন? সুপারপাওয়ারের মন জোগাতে পানামা-ইকুয়েডরের মতো এ দেশেও তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ সব তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে? না দিলে তারা কি এখানেও তাঁবেদার সরকার বসাবে? মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। বাংলাদেশের তখনকার ৯৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই স্বাধীনতার জন্য কোনো না কোনোভাবে কষ্ট স্বীকার করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই জীবিত আছেন। তাঁরা কী ভাবেন? তরুণরা বরাবরই প্রতিবাদী হয়। আমাদের তরুণরা কী ভাবছে? এ দেশেও কি উচ্ছিষ্টভোগী শিয়ালরা সক্রিয়? তারা কারা? যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ কিংবা সিআইএর সুবিধাভোগীরা কি এ দেশেও যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার সরকার বসানোর পরিকল্পনা করছে? প্রশ্নগুলো আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.