চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-কারাবাসকালে আমার শ্রবণ ও চিন্তন by যতীন সরকার

১৯৭৬-এর মার্চের ৩ তারিখ রাতে গ্রেপ্তার হই, আর এর দুদিন পর ৫ তারিখে নিয়ে যাওয়া হয় জেলখানায়। ময়মনসিংহে জেলের ভেতরে ঢুকে প্রথমেই দেখতে পাই বন্ধুবর আলোকময় নাহাকে। সে আমার মাস তিনেক আগে থেকেই 'রাজ অতিথি'। তারই পেছনে এসে দাঁড়ান আরো সব পরিচিত-অপরিচিত রাজ অতিথিবৃন্দ।


সবাই হাততালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। আমিও হাসিমুখে তাঁদের অভ্যর্থনার প্রতি-উত্তর দিলাম।
কারাবন্দি হয়ে আমি কিন্তু গৌরববোধেই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। কারণ যে সম্মানপ্রাপ্তির কণামাত্র অধিকার আমার নেই, আমি তো সেই সম্মানেই আজ ভূষিত। আমি আজ 'রাজবন্দি!' ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠি!
পরাধীন দেশে যাঁরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতেন, সেসব মহান সংগ্রামীদেরই বিদেশি শাসকরা কারাগারে আটক করে রাখত। বিদেশি শাসনের অবসানের পর স্বদেশি শাসকরাও এমনটিই করে চলছেন। যাঁরা দেশের জাতির সমাজের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগ বা জীবন উৎসর্গ করেন, যাঁরা শোষণ ব্যবস্থার উৎসাদন ঘটিয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম করেন, সে রকম বিপ্লবীরাই তো গণবিরোধী শাসকদের বিচারে রাষ্ট্রদ্রোহী বিবেচিত হয়ে কারাবন্দি হন। সে রকম 'রাষ্ট্রদ্রোহী' বা বিপ্লবী হওয়ার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও যে আমার নেই- সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? হ্যাঁ, আলোচনা সভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুভূত সত্যকে চিৎকার করে বলার অভ্যাস আমার আছে বটে, কিন্তু এ রকম চিৎকার করলেই কি কোনো মানুষ বিপ্লবী হয়ে যায়? 'বকাউল্লা' যারা, তারা সবাই বিপ্লবী? বিপ্লবী হওয়া কি এতই সহজ?
যাতে বিপ্লবী বলে গণ্য হতে পারি, তেমন কোনো কর্মই আমি করিনি, করতে পারিনি, করার সামর্থ্যই আমার নেই। তাই আমি সব মহান বিপ্লবীকে প্রণতি জানিয়েছি, তাঁদের প্রতি সর্বদা সশ্রদ্ধ থেকেছি, তাঁদের সমকক্ষ বলে কেউ আমাকে বিবেচনা করবে- এমন ভাবনা স্বপ্নেও কখনো মনের কোণে ঠাঁই দিইনি। অথচ আজকের বাংলাদেশের উড়ে এসে জুড়ে বসা শাসকরা আমার মতো অভাজনকেও কি না সেই অচিন্তিতপূর্ব মর্যাদাতেই অভিষিক্ত করে ফেলল। তাদের শাসনক্ষমতার প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করেই তারা আমাকে কারাগারের বাইরে রাখতে ভরসা পায়নি। কারাগারে পাঠিয়ে আমার অনেক শ্রদ্ধাভাজন বিপ্লবীর মঙ্গল লাভের সুযোগই শুধু করে দেয়নি তারা, আমাকেও বিপ্লবীর আসনেই বসিয়ে দিল। যে সম্মান আমার কোনোমতেই প্রাপ্য নয়, সেই সম্মানের মুকুটই আমার মাথায় পরিয়ে দিল, কোনো কাজকর্ম না করেই সরকারি খরচে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল এবং এভাবেই আমাকে ধন্য করে তুলল। এ কারণে তারা তো অবশ্যই আমার ধন্যবাদের পাত্র। তাই একান্ত খুশিমনে ও সকৃতজ্ঞচিত্তেই তাদের ধন্যবাদ জানালাম।
এখনো জীবনের উপান্তে পৌঁছেও তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ হয়নি। কারণ তাদের কাছ থেকেই আমি প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছি! স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে বিনা বিচারে আটক থাকার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো পেয়ে থাকেন সারা দুনিয়ার মহান বিপ্লবীরাই।
জেলখানায় আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা-কর্মীকেই সহবন্দি রূপে পেলাম। তখন সবাই এসব দলের সবাইকে একত্রে ব্র্যাকেটভুক্ত করে 'বাকশালি' বলে আখ্যায়িত করত।
'বাকশাল স্রষ্টা' বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যারা ক্ষমতা দখলের সুযোগ পেয়েছে, তারা যে বাকশালিদের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে ফাটকে আটক করে রেখেছে তাতে কেউই তেমন বিস্মিত হয়নি। তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো, যারা বাকশালে যোগ দেয়নি এবং বাকশালিদের ধুমসে গালাগালি করত- তারাও কিন্তু ছিয়াত্তর সালের শাসকদের কোপদৃষ্টির বাইরে থাকতে পারেনি। যেমন- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ভাসানী ন্যাপ কিংবা উগ্র বামদের নানা গোষ্ঠী। তাদেরও বাকশালীদের সঙ্গেই ফাটকে আটক থাকতে হলো। অন্যদিকে পাকিস্তানপন্থী ও বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠীর কেউই আর এখন জেলখানায় নেই। তারা সবাই সসম্মানে কারামুক্ত হয়ে গেছে। ওই সব স্বাধীনতাবিরোধীদেরই স্থলাভিষিক্ত হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষভুক্ত বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পাকিস্তানীকরণের সূত্রপাত যে ঘটে গেছে- এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশের কোনো সুযোগই আর রইল না।
শুধু পাকিস্তানীকরণই বা বলি কেন, পুরো পাকিস্তানকেই ফিরিয়ে আনার প্রয়াসও একান্ত উগ্র হয়ে উঠেছিল তখন। জেলখানায় বসেই খবর পেয়েছিলাম যে বিদেশ থেকে তোয়াব নামক এক কট্টর পাকিস্তানপন্থী বাঙালিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে 'বায়ু সেনাপতি'র পদাভিষিক্ত করা হয়েছে এবং একদল পাকিস্তানপন্থী কুলাঙ্গার মিছিল করে তার কাছে দাবি জানিয়েছে- 'তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই- চাঁদ-তারা নিশান চাই'। এই চাঁদ-তারা নিশানের দাবি মার্চের প্রথম সপ্তাহেই জোরেশোরে উত্থাপন করেছিল একটি বাংলাদেশ বিদ্বেষী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত সিরাতুন্নবী সম্মেলনে তারা দাবি করে যে জাতীয় সংগীত বাদ দিতে হবে, জাতীয় পতাকা বদলাতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আক্ষরিক অর্থে এসব দাবির প্রতিষ্ঠা অবশ্যই ঘটেনি। জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়া হয়নি, জাতীয় পতাকা বদলানো হয়নি, সরাসরি ইসলামী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কিন্তু এসব না করেও 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' নাম বহাল রেখেও যা যা করা হলো সে সবকে যদি 'পাকিস্তানের প্রত্যাবর্তন' আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে কি খুব একটা ভুল হবে? ময়মনসিংহ কারাগারেই রাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধনের যে খবর পেয়েছিলাম, অনেক পরে আবদুল হক সাহেবের রোজনামচা পড়ে এই সংশোধনীটির প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছি। ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল আবদুল হক লিখেছিলেন-
"গতকালই সংবিধানের সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধনে ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করা হয়েছে এবং তার পরিবর্তে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র প্রতি পরম আস্থা ও বিশ্বাস' ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষিত না হলেও এর ফলে কার্যত ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।...
বাংলাদেশ এত দিনে পরিষ্কারভাবেই কার্যত ইসলামী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হলো, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পরিত্যক্ত হলো। প্রগতিবাদীরা কোণঠাসা হলেন।
এই যে কতকগুলো মৌলিক পরিবর্তন, এগুলো একজন ব্যক্তির দ্বারাই করা হলো, কোনো গণপ্রতিনিধি পরিষদ করেনি। এসব একজন স্বৈরাচারী ব্যক্তির কীর্তি মাত্র। এগুলোর পেছনে কোনো বৈধ সমর্থন নেই।"
স্বৈরাচার কোনো দেশে কোনোকালেই কোনোরূপ 'বৈধ সমর্থন'-এর তোয়াক্কা করেনি। তবে একালের স্বৈরাচারীরা তাদের শাসনকে গণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে জনগণের চোখে ধোঁকা দিতে চায়। তারা আস্থা ভোট, গণভোট, অবাধ নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রহসনেরও আয়োজন করে থাকে। জিয়াউর রহমানও তেমনটিই করেছিলেন। 'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর' বইয়ে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন-
"... আন্তর্জাতিক অনুমোদনের জন্য তিনি [জিয়া] ১৯৭৭ সালের মে মাসে একটি লোকদেখানো গণভোট গ্রহণ করেন। বলার প্রয়োজন পড়ে না যে তিনি নিজের পক্ষে 'বিপুল ভোট' পেয়েছিলেন। বস্তুত তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৯৮.৯ ভাগ। আগে থেকে সব জায়গায় কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল যে ভোটদাতার সংখ্যা যেন মোট ভোটদাতাদের ৭০ ভাগের বেশি না হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা নিজেদের উৎসাহ এবং দক্ষতা প্রমাণ করে প্রচুর ভোটই দেওয়া হয়েছিল বলে প্রমাণ করলেন। দেখালেন, এতে ভোট দিয়েছেন ৮৮.৫ ভাগ ভোটদাতা। সুপরিকল্পিত ফলাফল।"
সরকারি কর্মকর্তারা এ রকম অতিউৎসাহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই করে থাকেন। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু বিস্মিত এই পোড়খাওয়া বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার মতো মানুষের আচরণে। তিনিও 'দেশপ্রেমিক' মেজর জেনারেল জিয়াকে গণভোটে সমর্থন দান করেন। আর আমাদের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর আচরণ সম্পর্কে আবদুল হক বেশ কড়া ভাষায়ই তাঁর রোজনামচায় লিখলেন-
'জিয়া সম্প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সংবিধানের মৌলিক সংশোধন করেছেন, (যদিও তিনি তা করতে পারেন না) সে জন্য ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন অভিনন্দন জানিয়েছে। আইন যাঁদের জানার কথা, সেই আইন ব্যবসায়ীরা এরূপ বেআইনি সংশোধন সমর্থন করলেন। বুদ্ধিজীবীদের বেশ্যাসুলভ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।'
বুদ্ধিজীবীদের একটা বৃহদংশের এ রকম মনোভাবের পরিচয় তো ছেলেবেলা থেকেই পেয়ে আসছি। তবু আমাদের সমাজে যে গর্ব করার মতো বুদ্ধিজীবীরও অভাব নেই- সে তথ্যটাই একান্ত স্বস্তি ও আনন্দের। সেই স্বস্তি ও আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য যে আমাদেরই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে- কারাবাসকালে সে বিষয়েই আমি প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিলাম।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.